বিজ্ঞাপন

আমার শুধু একটি কথা আছে

December 16, 2018 | 4:00 am

এ গল্পে দুটি চরিত্র বর্তমান। সাগুফতা আর তোতা মিয়া। সাগুফতা। বয়স প্রায় ৪৭ বছর। নৃত্যশিল্পী। আন্তর্জাতিকভাবেও সম্মানিত। প্রতিষ্ঠিত। নান্দনিক। কিছুটা আড়াল রাখতে পছন্দ করেন ব্যক্তিগত জীবনে। মানুষ যাকে দাম্ভিকতা ভেবে ভুল করে। তাতে উনি চিন্তিত বা বিচলিত নন। উনি ভাবুক ধরনের। সে ভাবনা নিজের সাথে নিজের। আশেপাশে কে কি ভাবে, কেন ভাবে – এই ভাবনা তাকে ছোঁয়না।

বিজ্ঞাপন

উনি ভাবেন, প্রায়ই ভাবেন, কিংবা বিশ্বাস করেন বোধহয়, তার একটি ঘুড়ি ছিল। লাল হলুদ নীল মেশানো রংচঙে এক ঘুড়ি। ঘুড়ির নাটাই তার হাতে, কিন্তু সেই ঘুড়ি উড়তে উড়তে সময়ের কোন কোণে যে আটকে আছে, লুকিয়ে আছে, নাটাই হাতে নিয়ে ঘুরে ঘুরেও তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছেনা, যায়না। জন্মের পর, যখন থেকে বুঝতে শিখেছেন, তিনি সেই লুকিয়ে থাকা ঘুড়ি খুঁজছেন, খুঁজেই যাচ্ছেন।

ঘুড়িটি আটকে আছে, ৪৭ বছর আগের এক মে মাসে। ১৫ তারিখ। সাল ১৯৭১। বাগেরহাট। সেই সকাল দুপুরের মাঝামাঝি রোদ পোয়ানো সময়ে, আনিসুজ্জামান যখন বাড়ির খোলা উঠোনে বসে দিনের দ্বিতীয় দফা চা খাচ্ছিলেন। এর পরের গল্পটি বোধহয় অনেকের জানা, প্রায় সবার। পরিচিত। সত্য আসলে পুরোনোই হয়, পরিচিতও। আনিসুজ্জামান’কে খোলা উঠোনে ঘিরে ধরেছিলো পাক-বাহিনী। অপরাধ গুরুতর। মুক্তিযুদ্ধদের সাহায্য করবার গুরুতর অপরাধ। নিয়ে গিয়েছিলো তাকে, ফিরে আসেননি তিনি।

লোকমুখে শোনা, রাইফেল তাক করবার পর, আনিসুজ্জামান শুধু একটি কথা বলেছিলেন, “আমার শুধু একটি কথা আছে ….” কথা শেষ হয়নি। শেষ করতে দেয়া হয়নি।

বিজ্ঞাপন

আর ঠিক তিন মাস পর জন্ম হয় সাগুফতার। বাবার সাথে দেখা হয়নি তার। বাবার গল্প তার কাছে এটুকুই। আর সেই থেকে তার রংচঙে ঘুড়িটা আটকে আছে, পেঁচিয়ে আছে, বাবার অসমাপ্ত শব্দে, “আমার শুধু একটি কথা আছে ….”

এই গল্পের আরেক যে চরিত্র, তার নাম তোতা মিয়া। সে ভারী মজার। বয়স টেনেটুনে ৪০। কুচকুচে কালো তেলমাখা চুল বাং দিকে সিঁথি কেটে পরিপাটি আঁচড়ানো। মাঝারি উচ্চতার তোতা মিয়ার চেহারা জুড়ে সুখী ভাব। সাগুফতার বাড়ির উল্টোদিকের রাস্তায় মাদুর পেতে বসেন, মাথার উপর এক বড় ছাতা কায়দা করে টাঙানো। তুমুল ঝড়ের দিন ছাড়া, রোদ হোক কিংবা হালকা বৃষ্টিতে তোতা মিয়া মাদুর পেতে বসে থাকেন। এমনকি ঈদে চাঁদেও।

তোতা মিয়া একজন গল্প বলিয়ে। অনর্গল, সারাক্ষন তিনি গল্প বলে কাটাতে পারেন। ফ্রি’তে নয় যদিও। তার কাছে যেয়ে মাদুরে আরাম করে বসে, সময় নিয়ে যদি গল্প জানতে চাওয়া হয়, তিনি গল্প বলেন। ভবিষ্যতের গল্প জুড়ে দেন সাথে। গল্পের গুরুত্ব বুঝে পারিশ্রমিক নির্ধারণ হয়।

বিজ্ঞাপন

তোতা মিয়া কে আপাতদৃষ্টি তে ধান্দাবাজ মনে হচ্ছে? তা এই জীবনের ধান্দার চক্করে কে আর ধান্দাবাজ নয়? তোতা মিয়া গল্প বলেন টাকা নেন। অসৎ কিছু তো করেন না। এমন করেই ভাবেন তোতা মিয়া। তবে তিনি জানেন, মানুষ গল্প ভালোবাসে। তিনি সেই গল্পই বলেন, যা শুনতে মানুষ ভালোবাসে। তিনি বানিয়ে কিছু বলেন না। তিনি ততটুকুই বলেন যা শ্রুতিমধুর। বাকিটুকু উহ্য থাকে গল্পে। তিনি মানুষকে আনন্দ দেন।

সাগুফতা প্রতিদিন তোতা মিয়া কে দেখেন। সকালে যখন প্রাতঃভ্রমণে বের হন সাগুফতা। তখন তোতা মিয়া মাদুর পাতার আয়োজনে ব্যস্ত। চোখাচোখি হয় তাদের। হাসি বিনিময় বোধহয় হয়না। কিন্তু কৌতূহল জন্ম নেয় সাগুফতার মনে। যে মানুষ ভবিষ্যতের গল্পের ধান্দা করেন, অতীতের আটকে থাকা ঘুড়ির গল্প কি তার জানা? সাগুফতা প্রায়ই ভাবেন। কিন্তু সামাজিক সংকোচ তাকে আটকে রাখে। রাস্তার ওপার ডিঙিয়ে তোতা মিয়ার মাদুরে আসন পেতে তার আর বসা হয়না।

কিন্তু প্রতিদিন এক রকম হয়না দেখেই, অন্যদিনে গল্পের জন্ম হয়। শীত শীত ভাব নিয়ে যে সকাল এলো, সেই সকালে সাগুফতা যখন প্রতিদিনের মতন হাঁটতে বেরিয়েছেন, উল্টোদিকের রাস্তায় তোতা মিয়া মাদুর পেতে বসে আছেন ততক্ষণে। আজ গল্প হবে বলেই হয়তো দৃষ্টি বিনিময়ের সাথে বিনিময় হয় হাসি। হাসির সম্মোহনে, কিংবা গল্পের টানে, আজ সাগুফতা সোজা যান না। আজ সাগুফতা রাস্তার এপার অতিক্রম করেন। ওপারে যান। আজ তিনি তোতা মিয়ার মাদুরে আসন পেতে বসেন। আজ তিনি লুকিয়ে থাকা রংচঙে ঘুড়ির গল্প বলেন তোতা মিয়াকে।

তোতা মিয়া বিজ্ঞ গল্প বলিয়ে। তিনি গল্প বলেন সত্যি, কিন্তু তার চেয়ে বেশি মন দিয়ে অন্যের গল্প শোনেন। না শুনলে, আসলে বলা যায়না কিছু।

বিজ্ঞাপন

ঘুড়ির গল্প শেষে, তাই সাগুফতা যখন বলেন, “বলেন তো তোতা মিয়া, সেদিন বাবা “আমার শুধু একটি কথা আছে ….” এরপর কি বলতে চেয়েছিলেন? কি সেই কথা?

হাসে তোতা মিয়া, “মা, আপনি কি সেই কথা জানেন না, জানেন না উনি কি বলতে চেয়েছিলেন?”

এক লম্বা ঢোঁক গিলে হাসে সাগুফতা, “আপনি বলেন শুনি।”

আপনার বাবা সেদিন বলেছিলেন, “আমার শুধু একটি কথা আছে, স্বাধীনতা কিন্তু আসবেই।”

সাগুফতা: স্বাধীনতা এলো তো, বাবা যদি আমাকে আজ দেখতে পেতেন, আহা..

তোতা মিয়া: খুব অবাক হতেন আপনার আব্বা। আপনার মাথায় হাত রেখে বলতেন, ” মা তুই কবে এতো বড় হলি?”

সাগুফতা: আর আমি বলতাম, “বাবা তুমি তো আর বড় হলেনা।”

এমন করেই লুকিয়ে থাকা ঘুড়িকে খুঁজে ফেরার গল্প করে সাগুফতা আর তোতা মিয়া। “আমার শুধু একটি কথা আছে”র পরের গল্প। কুয়াশার শীতশীত সকাল তখন বিদায় নিচ্ছে। চারপাশে রোদ ফুটছে। সোনারঙা স্বাধীন রোদ।

আগের গল্পগুলো পড়ুন এখানে-

**নাম তার বাবুলাল

** আহা মন, আহারে মন

** বাক্সবন্দি

** এ গল্পের নাম জানিনা

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন