বিজ্ঞাপন

‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১১

December 11, 2018 | 11:49 pm

।।ফারুক ওয়াহিদ ।।

বিজ্ঞাপন

বিজয় মাসের ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ দিনটি ছিল শনিবার। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে পাকিস্তানি হানাদার ঘাতকদের পরাজয় এক রকম সুনিশ্চিত হয়ে যায়। মার্কিন সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগর অভিমুখে- ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান লে. জেনারেল নিয়াজির কাছে এক বার্তায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জানান, মার্কিন সপ্তম নৌবহর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। চীনও যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে- নিজেদের শক্তি শেষ তাই শেষ আশা ভরসায় হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কিন্তু একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের বিপদের বন্ধু রাশিয়া বঙ্গোপসাগর অভিমুখে মার্কিন সপ্তম নৌবহরের টাস্কফোর্স-এর অভিযান থামিয়ে দেয়।

ঢাকায় বিকেল ৩টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। জাতিসংঘের অনুরোধে বিদেশি নাগরিক তথা ঢাকার বিদেশি দূতাবাসের কর্মকর্তাদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য তেজগাঁও বিমানবন্দরের রানওয়ে মেরামত ও আন্তর্জাতিক বিমান অবতরণের সুযোগ করে দেওয়া হয়। এ জন্য বিমানবন্দরে মুক্তিবাহিনীর বিমানবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর বিমান হামলা বন্ধ রাখে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকার প্রত্যেক এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার চার পাশে মিত্রবাহিনী নির্দিষ্ট এলাকায় রাতে ছত্রীসেনা অবতরণ করায়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী বীরবিক্রমে ঢাকা অভিমুখে এগিয়ে চলছে। জাতিসংঘে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তার। যুদ্ধ বিরতির জন্য প্রাদেশিক সরকারের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘ সদর দফতরে জরুরি বার্তা প্রেরণ করেন।

বিজ্ঞাপন

 

আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ১০

এদিকে প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর মুক্ত হলো জামালপুর, ময়মনসিংহ, হিলি, গাইবান্ধা, ফুলছড়ি, বাহাদুরাবাদ। জামালপুরেই ৫৮১ জন পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করেছে এবং অনেক সৈন্য হতাহত হয়। এদিকে মতলবে পাকিস্তানি সেনারা আত্মসমর্পণ করে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে মিত্রবাহিনীর বিমান বাহিনীর আক্রমণ ছিল প্রচণ্ড আকারে। জাতিসংঘের অনুরোধে ঢাকা থেকে বিদেশিদের যাওয়ার সুযোগ করে দিয়ে মুক্তি-মিত্রবাহিনীর বিমান সেদিন কোনো বিমান আক্রমণ করেনি। মৌলভীবাজারের পতন আর নরসিংদী মিত্র-মুক্তিবাহিনী দখল করে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়।

বিজ্ঞাপন

 

আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৯

এদিন জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব মেনে নেওয়ার জন্য জোর দাবি জানায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদিন হোয়াইট হাউজের একজন মুখপাত্র বলেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক।

 

আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৮

বিজ্ঞাপন

আজ ১১ ডিসেম্বর মিত্র-মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর কুষ্টিয়া মুক্ত হয়। কুষ্টিয়ায় মিত্রবাহিনীর ট্যাংক বাহিনীর সাথে হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের মুখোমুখি প্রচণ্ড ট্যাংক যুদ্ধ সংঘটিত হয়। মিত্র বাহিনীর বিমান হামলায় বিধ্বস্ত হয় পাকিস্তানি হানাদারদের শক্ত ঘাঁটি। এ লড়াইয়ে যোগ দেয় মুক্তিযোদ্ধাসহ জেলার সাধারণ মানুষ। প্রচণ্ড তোপের মুখে পড়ে ১১ ডিসেম্বর খুব ভোরে পালিয়ে যায় পরাজিত পাকিস্তানি বাহিনী। মুক্ত হয় কুষ্টিয়া- দীর্ঘ ৯ মাসে কুষ্টিয়ায় ছোট বড় অনেকগুলো যুদ্ধ সংঘটিত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে কুষ্টিয়াবাসী গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করে।

১১ ডিসেম্বর যশোরের মুক্তভূমিতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ সর্বস্তরের মানুষকে স্বাধীনতাযুদ্ধের চেতনায় দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, এ মুহূর্তে কাজ হলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ে তোলা। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এক সংবাদ সম্মেলনে যশোর সার্কিট হাউজে বলেন, তারা তাড়াতাড়ি সংবিধান রচনা করবেন সভায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, ২৫ মার্চের আগের মালিককে সম্পত্তি ফেরত দান, সব নাগরিকের সমঅধিকার এবং চারটি রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধকরণ।

 

আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৭

আজ ১১ ডিসেম্বর লাকসাম মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এ দিনে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের হটিয়ে লাকসাম-মনোহরগঞ্জকে শত্রুমুক্ত করে। পাকিস্তানি সেনাদের সাথে লাকসামসহ আশপাশের এলাকায় মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু হয়। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজিত হয়ে চাঁদপুরের দিকে পালাতে থাকে।

 

আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৬

১৯৭১ এর এই দিনে নান্দাইল থানা পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়েছিল। ভৌগোলিকভাবে নান্দাইল থানার তিন দিক ঘিরে রয়েছে নরসুন্দা নদী। ১০ ডিসেম্বর রাতে নান্দাইল থানার তিন দিক ঘিরে অবস্থান করেন মুক্তিযোদ্ধারা। একাত্তরের এদিন হিলি সীমান্তে যৌথবাহিনী প্রচণ্ড প্রতিরোধের মুখোমুখি পড়ে। সন্ধ্যায় গোবিন্দগঞ্জে হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ ও সারারাত যুদ্ধ শেষে ভোরে তাদের পতন ঘটে। এদিকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর ফ্লাগ অফিসার মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের মহাসচিব উ-থান্টের নিকট এক বার্তা পাঠান- “আমাদের দেশে ফিরে যাবার ব্যবস্থা করুন, প্রাণে বাঁচান।”-বিবিসি

 

আরও পড়ুন:  ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৫

আজ ১১ ডিসেম্বর, পাকিস্তানিদের বর্বরতার বীভৎসতার এক নারকীয় স্বাক্ষর এখনও রয়েছে, তবে মিত্রবাহিনীর আন্তরিক চেষ্টায় যুদ্ধবিধ্বস্ত মুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লোকজন ঘরে ফিরে আসতে শুরু করেছে। মিত্রবাহিনীর শিখ সৈন্যরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাকিস্তানিদের অত্যাচারের চিহ্ন এবং শহরের অবস্থা দেখে অশ্রুসংবরণ করতে পারেননি- ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তাদেরকে অশ্রসিক্ত নয়নে বলতে শোনা যায়- “শোচ মাৎ ভাইয়া যো হোগিয়া তো হোগিয়া- দুষমন কা বদলা লেনে হাম হ্যায়। বদলা তো লেগা জরুর।” (‘দৈনিক সংবাদ’ আগরতলা, ডিসেম্বর ১২, ১৯৭১) শহরের কাচারী প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অসামরিক প্রশাসন চালু করা হয়। প্রায় ১০ হাজার মুক্তিকামী মানুষের উপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জহুর আহমেদ চৌধুরী মুক্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

 

আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৪

১১ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার থেকে প্রকাশিত জনগণের উদ্দেশে এক নির্দেশনামায় বলা হয়, “ঐ খুনীগুলোকে (ধরা পড়া বা সারেন্ডার করা পাকিস্তানি সৈন্য) তোমরা মেরো না, মুক্তিবাহিনীর হাতে ওদের হস্তান্তর কর। হয়ত ওদের বিনিময়ে আমরা জাতির পিতাকে উদ্ধার করতে পারি।”

 

আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ৩

মুজিবনগর সরকারের আহ্বানে সারা দিয়ে মুক্তাঞ্চলের জনগণের নিকট ধরা পরা হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর কাছে জনগণ ‘জয়বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিয়ে হস্তাস্তর করছেন অন্ততপক্ষে এই আশায়- “বঙ্গবন্ধু আবার যখন ফিরবেন/ পদ্মাপারের নৌকা করে ভিড়বেন।”

এই দিনে ঢাকার উপকণ্ঠে মিত্রবাহিনীর ছত্রীসেনার অবতরণ এবং বিভিন্ন এলাকায় ছত্রীসেনাদের সাথে পাকিস্তানি সেনাদের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এদিকে হানাদার পাকিস্তানিদের ফ্লাগ অফিসার লে. জে. রাও ফরমান আলীর উদ্দেশে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ’র অস্ত্র সম্বরণ ও আত্মসমর্পণ করার শেষ ঘোষণা দেন। [চলবে]

আরও পড়ুন: ‘বিজয় নিশান উড়ছে ওই’ ডিসেম্বর ২

লেখক: ফারুক ওয়াহিদ, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ভারতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন