বিজ্ঞাপন

রিজার্ভ চুরি: পূর্ণ হলো ৩ বছর, টাকা ফেরত আনতে নানা উদ্যোগ

February 4, 2019 | 2:35 pm

।। গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে নেয় হ্যাকাররা। টাকা ফেরতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঘটনার তিন বছর পর বাংলাদেশ সময় গত এক ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে একটি মামলা করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে, এ ঘটনায় দেশে তদন্তের রিপোর্ট আজও প্রকাশ করা হয়নি।

২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থেকে সুইফট কোডের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই অর্থ চুরি করা হয়। চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে শ্রীলঙ্কায় ২ কোটি ডলার এবং বাকি ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার প্রথমে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলায় অবস্থিত রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশন (আরসিবিসি)‘র একটি শাখায় পাঠানো হয়। পরবর্তীতে এই অর্থ আরসিবিসি থেকে চলে যায় ফিলিপাইনের জুয়ার আসরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে চুরি হওয়া অর্থের মধ্যে প্রথম বছরে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ফেরত আনা সম্ভব হলেও বাকি ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার এখনো আনা যায়নি। এই অর্থ ফেরত পেতে গত শুক্রবার (১ ফেব্রুয়ারি) বাংলাদেশ ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা দায়ের করে। মামলায় আরসিবিসি‘র সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং রিজার্ভ চুরির টাকা, যে সব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছে গিয়েছে তাদের আসামি করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

রিজার্ভ চুরির মামলা দায়েরে খরচ তিন কোটি টাকা: রিজার্ভ চুরির ঘটনার তিন বছর পূর্ণ হওয়ার আগ মুহুর্তে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সাউদার্ন ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ১০৩ পৃষ্ঠার মামলার এজাহারে ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, আরসিবিসির সাতটি প্রতিষ্ঠানসহ ২৫ জন অজ্ঞাতনামা লোক‌কে আসামী করা হয়েছে। এই মামলা নিস্পত্তি হতে কমপক্ষে তিন বছর সময় লাগবে বলে জানা গেছে। ইতিমেধ্যে মামলা দায়ের করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের খরচ হয়েছে তিন কোটি টাকা। শেষ পর্যন্ত এই খরচ কত গিয়ে দাঁড়ায় তা নিয়ে এখনই প্রশ্ন উঠেছে।

এ ব্যাপারে রিজার্ভ চুরির মামলার আইনজীবি আজমালুল হোসেন কিউসি রোববার সাংবাদিকদের বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের (ফেড) সঙ্গে মামলার বিষয়ে চু‌ক্তি হয়েছে। তারা মামলার জন্য বি‌ভিন্ন ন‌থি, তথ্য সরবরাহ করার পাশাপাশি সা‌ক্ষ্য দেবে। আমাদের প্রত্যাশা পুরো অর্থ আমরা ফেরৎ পাব।

অন্যদিকে, মামলার খরচ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউর প্রধান রা‌জি হাসান সাংবাদিকদের ব‌লেন, রিজার্ভ চু‌রি মামলা করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৩ কো‌টি টাকার মতো খরচ হয়েছে। মামলার বিষয়ে যেসব কর্মকর্তা কাজ করছেন তারা সরকা‌রি নিয়ম অনুযা‌য়ী খরচ করছেন।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ল’ ফার্মের সঙ্গে আমাদের চু‌ক্তি হয়েছে। তাদের ঘণ্টা হিসেবে অর্থ প‌রিশো‌ধ করা হবে। রা‌জি হাসান বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত অনুসারে মামলা করা হয়েছে। এখানে খরচ মুখ্য বিষয় না। আমা‌দের লক্ষ্য চু‌রি হওয়া পুরো অর্থ ফেরৎ আনা।

প্রথম বছর ফেরত আসে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার: ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি হওয়ার ১০ মাসের মধ্যে ৩ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ফেরত আনা হয়। এর মধ্যে রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার আগেই ২০১৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শ্রীলঙ্কা থেকে ২ কোটি ডলার ফেরত আনা সম্ভব হয়। একই বছরের ১২ নভেম্বর ফিলিপাইন থেকে আরো ১ কোটি ৪৫ লাখ ডলার ফেরত আনা হয়েছে। পরর্বতী ২ বছরের বেশি সময়ে আর কোনো টাকা উদ্ধার করা যায়নি। ফলে, ফিলিপাইনে থাকা অবশিষ্ট ৬ কোটি ৬৪ লাখ ডলার (৫৫৭ কোটি টাকা) এখনো ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। কবে আনা যাবে কিংবা আদৌ আনা যাবে কিনা তা নিয়েও নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।

বানান ভুলের কারনে ১৯৪ কোটি ডলার নিতে পারেনি হ্যাকাররা: ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চুরি করে নেয়া হয়। হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে ১৯৪ কোটি ডলার চুরি করার চেষ্টা করলেও বানান ভুলের কারণে তা সম্ভব হয়নি। বিশ্বব্যাপী আলোচিত বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনা ঘটার এক মাসেরও বেশি সময় গোপন রাখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২০১৬ সালের ৭ মার্চ গণমাধ্যমে রিজার্ভ চুরির ঘটনা প্রকাশ হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা স্বীকার করে নেয়। পরে এই ঘটনায় ১৬ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন, পরে দুই ডেপুটি গর্ভনরও পদত্যাগ করেন।

পদত্যাগ ছাড়া কোন শাস্তি হয়নি : রিজার্ভ চুরির এই ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তৎকালীন গর্ভনর ড. আতিউর রহমান পদত্যাগ করেছেন। আর দুই ডেপুটি গভর্নর নাজনীন সুলতানা ও আবুল কাসেমকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। উল্লেখিত, তিনজন পদত্যাগ ও অব্যাহতি ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকে এই ঘটনা কেনো ঘটলো, কারো কোনো দায়িত্ব অবহেলা রয়েছে কিনা কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা জড়িত ছিল কিনা এখন পর্যন্ত বিষয়টি শাস্তির আওতায় আনা যায়নি। আর এইজন্য বিশিষ্টজনেরা দায়ী করছেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় গঠিত দুইটি তদন্ত প্রতিবেদন দীর্ঘ তিন বছরেও প্রকাশ না হওয়া।

বিজ্ঞাপন

তদন্ত কমিটি গঠন ও মামলা দায়ের : রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর মোহাম্মদ ফরাস উদ্দিনকে প্রধান করে ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত শেষে একই বছরের ৩০শে মে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন। ইতিমধ্যে আড়াই বছরের বেশি সময় পার হলেও এখন পর্যন্ত সরকার তদন্ত প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেনি।

অন্যদিকে রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় দায়ের একটি মামলায় দায়ের করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা এই মামলায় কাউকে আসামি করা হয়নি। মামলাটি তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। ইতিমধ্যে ৩৫ মাস অতিবাহিত হতে চলেছে কিন্তু এখন পর্যন্ত সিআইডির পক্ষ থেকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়নি। তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আদালত থেকে বারবার সময় নিচ্ছে। সর্বশেষ গত ৯ জানুয়ারি আগামী ১০ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে সিইডিকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। মামলাটি তদন্ত তদারকি করছেন সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইমের বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্যা নজরুল ইসলাম।

বাংলাদেশে কারো শাস্তি না হলেও ফিলিপাইনে হয়েছে : বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় এখন পর্যন্ত কাউকে কোনো শাস্তির আওতায় আনা হয়নি। প্রকাশ করা হয়নি সরকারের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী দফায় দফায় তদন্ত করলেও কোনো অর্থ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেও কোনো বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেনি। কোনো কর্মকর্তাকে গাফিলতির জন্য চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হয়নি।

বিপরীতে ফিলিপাইন সরকার একের পর এক পদক্ষেপ নিচ্ছেন। এসব পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে আরসিবিসিকে ফিলিপাইনের সিনেট ২০ লাখ ডলার জরিমানা করেছে। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনায় ফিলিপাইনের রিজাল কমার্শিয়াল ব্যাংকিং কর্পোরেশনের (আরসিবিসি) সাবেক শাখা ব্যবস্থাপক মায়া সান্তোস দেগুইতোকে দোষী সাবাস্ত করে ৫৬ বছরের কারাদন্ডসহ জরিমানা করা হয়েছে। এর আগে আরসিবিসি প্রধান নির্বাহী অপরাধ স্বীকার করে পদত্যাগ করেছেন।

রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এ সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রিজার্ভ চুরির ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়ের করা মামলা তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। একটি তদন্ত চলাকালীন আরেকটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হলে চলমান তদন্তে প্রভাব পড়তে পারে। তিনি আরো বলেন, প্রতিবেদন প্রকাশ করার এখতিয়ার সরকারের। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো করণীয় নেই। তিনি বলেন, সিআইডির প্রতিবেদনের আলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের কোনো কর্মকর্তা দায়ী থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ও রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সরকারের তদন্ত কমিটির প্রধান ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, আমি রিজার্ভ চুরির ঘটনায় তদন্ত প্রতিবেদন যথাসময়ে জমা দিয়েছি। এটা প্রকাশ করা না করার এখতিয়ার সরকারের। তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে, কুটনৈতিকভাবে এবং আইনগতভাবে সরকার পদক্ষেপ নিলে এটা উদ্ধার সহজ হত। কিন্তু অনেক বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তহীনতার কারণে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়নি।

সারাবাংলা/ জিএস/জেএএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন