বিজ্ঞাপন

হাজারো ‘কর্মবীরের’ ঘামে-শ্রমে রচিত হচ্ছে কর্ণফুলীর নতুন ইতিহাস

February 10, 2019 | 1:08 pm

রমেন দাশগুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প থেকে ফিরে: সাগর, নদী আর পাহাড়ের মিলন মোহনায় গড়ে ওঠা শহর চট্টগ্রাম। পাহাড়ের পা ছুঁয়ে যেখানে কর্ণফুলী নদী গিয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে, তার অদূরেই রচিত হতে যাচ্ছে এক নতুন ইতিহাস। নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম সুড়ঙ্গপথ, তা-ও আবার নদীর তলদেশে। শুধু কি দেশেই প্রথম? দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নদীর তলদেশ দিয়ে সড়কপথ নির্মাণের ইতিহাস প্রথম সৃষ্টি করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

আরও পড়ুন: যেভাবে টানেলের যুগে ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশ

সম্প্রতি চট্টগ্রাম নগরীর পতেঙ্গায় গিয়ে দেখা মেলে নতুন ইতিহাস সৃষ্টির এই কর্মযজ্ঞে যুক্ত দেশি-বিদেশি প্রকৌশলী, কর্মকর্তা-কর্মচারী আর হাজারোশ্রমিকের। হাজারো মানুষের ঘামে-শ্রমে লুসাইকন্যা কর্ণফুলীর পাড়ে উন্মোচিত হচ্ছে সভ্যতার নতুন দিগন্ত। ভিন্নরকমের আবেগ, ভিন্নরকমের অনুভূতি সবার মধ্যে। বিশাল এই কর্মযজ্ঞের সঙ্গে একাত্ম সবার হৃদয়।

বিজ্ঞাপন

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক হারুনুর রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি এই প্রকল্পের জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। এই প্রকল্পে ১০০০ থেকে ১২০০ লোক কাজ করছে। এতবড় একটি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত থাকা নিয়ে শুধু আমি কেন, সবার মধ্যেই গর্ববোধ আছে। তবে আমি তো কর্মকর্তা। আমার কাছে আবেগের চেয়ে বাস্তবতাটাই বেশি প্রাধান্য পায়। সময়মতো সুন্দরভাবে এই প্রকল্পের কাজ যাতে শেষ করতে পারি, সেটাই আমার প্রধান লক্ষ্য।’

২০০৮ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে এক জনসভায় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় গেলে কর্ণফুলীতে টানেল নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ক্ষমতায় আসার পর প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় আওয়ামী লীগ সরকার।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্তাবধানে চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি প্রকল্প বাস্তবায়নের দায়িত্ব পেয়েছে। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে আট হাজার ৪৪৭ কোটি টাকা। এরই মধ্যে চীন অর্থায়ন করছে প্রায় চার হাজার ৮০০ কোটি টাকা। বাকি টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দিচ্ছে।

 কর্ণফুলীর তলদেশ যেভাবে কাটবে দৈত্যাকৃতির টিবিএম

২০১৬ সালের অক্টোবরে চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর কর্ণফুলী নদীর নেভাল একাডেমি থেকে আনোয়ারা প্রান্ত পর্যন্ত সোয়া তিন কিলোমিটার দীর্ঘ টানেলের কাজ এগিয়ে চলছে। এখানেই নদীর তলদেশের ১৮ থেকে ৪৩ মিটার গভীর দিয়ে নির্মিত হচ্ছে টানেল। এরই মধ্যে প্রকল্পের ২৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ২০২২ সাল নাগাদ টানেল নির্মাণ শেষে গাড়ি চলাচল শুরুর কথা রয়েছে।

নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে এখন কর্ণফুলীর পাড়ে বিরামহীনভাবে চলছে কাজ। কেউ পাথরের গায়ে শাবল চালাচ্ছে, কেউ যন্ত্র দিয়ে কেটে টুকরো করছেন লোহার পাত, কেউ-বা আবার মাটির গভীরে গিয়ে যন্ত্র চালিয়ে তুলে আনছেন মাটি। এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ ! আর তাদের কার্যক্রম সুচারুভাবে সম্পন্ন করতে দিন-রাত প্রকল্প এলাকায় অবস্থান করে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা দিয়ে যাচ্ছেন একদল প্রকৌশলী।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, টানেল নির্মাণের কাজে যুক্ত মোট শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ৮০০। এর মধ্যে চীনের শ্রমিক আছেন সাড়ে তিনশ’র মতো। বাকিরা দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে এই কাজে যোগ দিয়েছেন।

প্রকল্পের পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের অধীনে কাজ করছেন কমপক্ষে ৪০ জন, যাদের অধিকাংশই সেতু প্রকৌশলী। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারি মিলিয়ে আছেন ২৫ জনেরও বেশি। এছাড়া অস্থায়ীভাবে বিভিন্ন কাজে প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছেন আরও কমপক্ষে ৩০০ শ্রমিক।

তিন পালায় বিভক্ত হয়ে ২৪ ঘন্টা কাজ করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারি ও শ্রমিকরা।

নদী জানবেও না তলদেশে নির্মাণযজ্ঞের খবর!

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, ‘বুয়েট থেকে পাশ করা ১৪ জন প্রকৌশলীকে আমরা প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত করেছি। কারণ টানেল নির্মাণের অভিজ্ঞতা একেবারে নতুন। তারা এই অভিজ্ঞতা নিচ্ছে চীনের অভিজ্ঞ প্রকৌশলীদের কাছ থেকে। ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে তরুণ প্রকৌশলীরা তাদের অভিজ্ঞতা তুলে ধরবেন। টানেল নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা একদল অভিজ্ঞ প্রকৌশলীও তৈরি করে নিচ্ছি।’

কাজের মান নিয়ে কথা হয় কয়েকজন শ্রমিক ও কর্মকর্তার সঙ্গে। নাম প্রকাশে আপত্তি আছে তাদের। তারা জানালেন, তিন ধাপে কাজের মান পরীক্ষা করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে আছেন একেবারে মাঠপর্যায়ে কাজে যুক্ত চীন ও বাংলাদেশের প্রকৌশলীরা। এরপরের ধাপে আছে চীনের একটি সুপারভিশন টিম। সবার উপরে আছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ।

প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় যুক্ত একজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশি যেসব শ্রমিক আছেন, তাদের সেতু কর্তৃপক্ষের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা নিয়মিত ব্রিফ করছেন। এই প্রকল্প যে দেশের অন্যান্য নির্মাণ প্রকল্পের মতো গতানুগতিক কিছু নয়, এর সঙ্গে যে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে, সেটি তাদের বোঝানো হয়েছে। একইভাবে চীনের প্রকৌশলীরাও তাদের শ্রমিকদের নিয়মিত বোঝাচ্ছেন। কাজের মান যাতে শতভাগ ঠিক থাকে, সেটা নিশ্চিত করাই একমাত্র চ্যালেঞ্জ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন উপ-প্রকল্প পরিচালক সারাবাংলাকে বলেন, ‘দেশের অনেক ব্রিজ-কালভার্ট, সড়কসহ নানা ধরনের উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। কিন্তু টানেলের মতো একটা প্রকল্প বাংলাদেশে প্রথম। আমাদের মধ্যে যেমন এই প্রকল্প নিয়ে অন্যরকম আকর্ষণ আছে, তেমনি শ্রমিক-কর্মচারিদের মধ্যেও আছে। সবাই এই কাজে যুক্ত হতে পেরে গর্ববোধ করেন।’

শুধু নির্মাণকাজে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হাজারো মানুষ একাত্ম হয়েছেন এই কাজে, তা নয়। টানেলের একপ্রান্তে নগরীর পতেঙ্গা এবং আরেকপ্রান্তে আনোয়ারা উপজেলার সাধারণ মানুষও তো কেউ জমি দিয়ে, কেউ শ্রম দিয়ে যুক্ত হয়েছেন এই কাজে। কর্ণফুলী যেন নতুন স্বপ্নের হাতছানি দিয়ে ডাকছে পুরো চট্টগ্রামকে, পুরো দেশকে!

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতেও ভুললেন না তারা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা এভাবেই বলেন, ‘আমরা এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু যিনি এই স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং জনগণকে দেখিয়েছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার অবদান সবচেয়ে বেশি।’

সারাবাংলা/আরডি/এমএম

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন