বিজ্ঞাপন

অংক, পরিসংখ্যান, বাজেট ও উন্নয়ন

May 21, 2018 | 11:18 am

সাইফুল হাসান ।।

বাংলাদেশ, স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল হবার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে। ২০২৪ সালেই উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়ে যাবে, আশা করা যায়। সন্দেহ নেই, এ এক বিশাল অর্জন। এতে শুধু অর্থনৈতিক সামর্থ্যই নয়, বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রমাগত উন্নতির দাবীও প্রতিষ্ঠিত হয়।
এখন লক্ষ্য, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা। যা অর্জনে, পুরো দেশকে উন্নয়নের চাদরে মুড়ে দিতে চায় সরকার। উন্নয়নের ধারনা ব্যাপক হলেও, মানুষ এখানে ‘উন্নয়ন’ বলতে শুধু অবকাঠামো বোঝে। যদিও, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক-পরিবহন, প্রযুক্তি, বিদ্যুত-জ্বালানী, পরিবেশ-প্রকৃতি, আইন-শৃংখলা, সুশাসন, নিরাপত্তা, অর্থনীতি-রাজনীতি সহ আরো অনেককিছুর সমষ্টিগত উন্নতি হচ্ছে ‘উন্নয়ন’।

বিজ্ঞাপন

তবে, উন্নয়নের উষ্ণতায় থাকা মানুষ যখন সেমাই চিনির জন্য (চট্টগ্রামে) পায়ের নীচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়, তখন ধাক্কা খেতে হয়। প্রশ্নবিদ্ধ হয় ‘উন্নয়ন’। প্রমাণিত হয়, ‘উন্নয়ন’ শব্দটি সব নাগরিকের জীবনে সমান অর্থ বহন করে না; এমনকি সমান সুযোগও তৈরি করে না। যদি করতো, তবে ‘রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ পদদলিত হতো না। চট্টগ্রামের ঘটনা একটি উদাহরণ মাত্র। অভাবী এমন মানুষের সংখ্যা দেশজুড়ে নেহাতই কম নয়।
শুধু উন্নয়ন দিয়ে অভাব ও ক্ষুধা দূর হয় না। এজন্য চাই, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সুযোগের সুষম বন্টন। উন্নয়নের সুফল, সমবন্টন। এটা হয় না বলেই বৈষম্য প্রকট হয়েছে। ধনী আরো ধনী হচ্ছে। গরীব, ডুবে যাচ্ছে দারিদ্র্যের গভীরে। বৈষম্য বাড়ছে এটা সবাই স্বীকার করলেও, তা কমাতে যথেষ্ট পদক্ষেপ নেই। সরকারি হিসেবে, দেশের নাগরিকদের গড় মাথাপিছু আয় প্রায় ১৮’শ ডলার। প্রশ্ন হচ্ছে, ঢাকার শিল্পপতি আর কুড়িগ্রামের কৃষকের মাথাপিছু আয় কি সমান? গড় অংক আর পরিসংখ্যান বলবে সমান। বিখ্যাত লেখক মার্ক টোয়েন বলছেন, ‘দুনিয়াতে তিন ধরণের মিথ্যে আছে। এগুলো হচ্ছে মিথ্যা, ডাহা মিথ্যা এবং পরিসংখ্যান।’

৭ জুন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট পেশ করবেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত। এর মাধ্যমে টানা ১০টি বাজেট দেবার রেকর্ড ও গৌরব অর্জন করবেন। সম্ভবত এটাই তার শেষ বাজেট। যার আকার ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশী। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসুচী (এডিপি) ১ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার। রাজস্ব সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। যা গত বছরের তুলনায় ৩৫ শতাংশ বেশী। বাজেট ঘাটতি হবে ১ লাখ ২৭ হাজার কোটি টাকার।

বাজেট, অর্থনীতি ব্যাপারটাই অংক এবং পরিসংখ্যানের ক্যাচক্যাচানি। এখানে সবাই সংখ্যার কারবারি। সংখ্যা ব্যবহার করে, যে যার সুবিধা অনুযায়ী গল্প বলার চেষ্টা করছে। মেক্সিকান-অ্যামেরিকান লেখক লুইস আলবার্তো উরেয়া বলছেন, ‘মোটের ওপর সংখ্যা (অংক) কখনও মিথ্যে বলে না। একই সংখ্যা সাধারণত আলাদা আলাদা গল্প বলে, নির্ভর করছে গল্পটা কে বলছে।’

বিজ্ঞাপন

অংক ও পরিসংখ্যানের বিষয় হলেও, বাজেট মূলত সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব। নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়া-কমা ছাড়া, বাজেট নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ খুব কম। বেশীরভাগ জানেই না বাজেট কি? তাদের জীবনে এর প্রভাবই বা কি? তাই বাজেট বাস্তবায়ন নিয়ে সাধারণ মানুষের দিক থেকে কোন চ্যালেঞ্জ থাকে না। তবে, প্রভাবশালী রাজনীতিক ও ব্যবসায়ী, কর্পোরেটসহ নানা গোষ্ঠীর দাবী-দাওয়া বিবেচনা করতে হয় অর্থমন্ত্রীকে। কারণ, তারাই রাজনীতি-অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক, খেলোয়াড় ও সুবিধাভোগী। বাজেট তৈরির প্রক্রিয়ায় এদের ব্যাপক ভূমিকা থাকলেও সাধারণের অংশগ্রহণের সুযোগ কম।

সরকার ও জনগণের চাহিদা বাড়ছে। তাই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা, এডিপিসহ মোট বাজেটের আয়তনও বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। বাড়ছে না শুধু বাজেট বাস্তবায়নের মান, সক্ষমতা ও দক্ষতা। গত ৪৭ বছর এই ধারা অব্যাহত আছে। কোন বছরই টাকা খরচ হয় না কিন্তু বরাদ্দ বাড়ে। বাজেট এবং এডিপি সংশোধন হয়। অর্থবছরের শেষভাগে শুরু হয় টাকা খরচের প্রতিযোগিতা। তড়িঘড়ি করে প্রকল্প করার নামে, রাজধানীসহ সারাদেশেই চলে প্রচুর ‘উন্নয়ন খোড়াখুড়ি’। এতে মানসম্মত প্রকল্প তো হয়ই না বরং বিপুল অর্থের অপচয় হয়।

প্রথম আলোর এক রিপোর্টে বলছে, চলতি অর্থবছরের শেষ দু’মাসে এডিপির ৭৪ হাজার ৯৯১কোটি টাকারও বেশী খরচ করবে সরকার। যা সংশোধিত এডিপি’র প্রায় অর্ধেক। এ হিসেবে প্রতিদিন খরচ করতে হবে প্রায় ১২ শো ৫০কোটি টাকা। ভাবা যায়!?

বিজ্ঞাপন

২০১৮ নির্বাচনের বছর। ধারনা করা হচ্ছে, আসন্ন বাজেটও ‘নির্বাচনী বাজেট’ হবে। বাজেটে কর ছাড়, প্রনোদনা সহ জনতুষ্টিমূলক নানা প্রকল্প ও পদক্ষেপ থাকবে। রাজনৈতিক সরকারের জন্য সেটাই স্বাভাবিক। কেননা, তাদের লক্ষ্য ভোটারদের তুষ্ট রাখার মাধ্যমে নির্বাচনে পাশ করা। আগামী বাজেটে প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশ। তবে আসল লক্ষ্য কি বাজেট ঘোষণা হলে বোঝা যাবে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ হিসাব অনুযায়ী, দেশে এখন বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ (প্রকৃত পক্ষে আরো অনেক বেশী)। যা এ যাবতকালের সর্বোচ্চ। প্রতিবছর ২০ লাখ মানুষ কর্মবাজারে যুক্ত হতে চায়। কর্মসংস্থান হয় মাত্র ১০ থেকে ১২ লাখের। বাকিরা কোন না কোনভাবে টিকে থাকে। লাখ লাখ মানুষ কর্মহীন থাকলে দারিদ্র্য কিভাবে দূর হবে? সরকারের দাবী, প্রতিবছর উল্লেখযোগ্যহারে দারিদ্র্য কমছে। যদিও দারিদ্র্য আর গরীব মানুষ কমা এক নয়। দারিদ্র্য পরিমাপ হয় অংক ও পরিসংখ্যানে, গরীবি জীবনযাপন দিয়ে।

বিদেশী বিনিয়োগের অবস্থা এক দশক ধরে ২ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। স্থানীয় বিনিয়োগও আশাব্যাঞ্জক নয়। নতুন বিনিয়োগ না হলে, নতুন কর্মসংস্থান হবে না। গরীবি দূর হবে না। আর গরীবি থাকলে, উন্নয়ন, প্রবৃদ্ধি কোনটাই টেকসই হবে না। যার ধকল পোহাতে হবে অর্থনীতিকে।
প্রতিবছর আয়করের চাহিদা বাড়ছে। সেই তুলনায় বাড়ছে না কর প্রদানকারীর সংখ্যা। এ অবস্থায় আগামী বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা। যেখানে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা দুই লাখ আটচল্লিশ হাজার কোটি। এই লক্ষ্যমাত্রাও পুরণ হবে না, সেখানে প্রায় তিনলাখ কোটি টাকা আদায় হবে কিভাবে? আশংকা হচ্ছে, রাজস্ব বোর্ড, নিয়মিত করদাতাদের কাছ থেকেই বাড়তি কর আদায়ের চেষ্টা করবে।
প্রতিবছরই রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ও আদায়ের মধ্যে বড় ধরণের ঘাটতি হচ্ছে। তারপরও উচ্চাভিলাসী লক্ষ্যমাত্রা ধরা হচ্ছে। মানুষ এমনিতেই কর দিতে চায় না। করযোগ্য বহু মানুষ করজালের বাইরে। এ অবস্থায় নিয়মিত করদাতাদের ওপর বাড়তি চাপ দিলে হিতে বিপরীত হতে পারে। বরং মানুষ যেন কর দিতে উৎসাহ বোধ করে রাজস্ব বোর্ডকে এমন কর্মসুচী নিতে হবে। তবে, নতুন নতুন খাত চিহ্নিত, করজাল বাড়ানো, হয়রানি ও দুর্নীতি কমানো গেলে রাজস্ব আয় অবশ্যই বাড়বে।

প্রবাসী ও রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কিছুটা ইতিবাচক হলেও, সন্তোষজনক নয়। এ দু’খাতেই আয় বাড়াতে জরুরী পদক্ষেপ প্রয়োজন। বিশেষ করে নতুন নতুন শ্রম ও রফতানি বাজার খুঁজে বের করা দরকার। বিশ্ববাজার প্রায় সবদিক থেকে অনুকুলে থাকলেও সুফল পাচ্ছে না সাধারণ ভোক্তারা। আর তাই অর্থনৈতিক ঝুঁকিগুলো ওইভাবে চোখে পড়ছে না। বাজারের কারণে জনগণের বাজেট ঘাটতি হলে, জীবন ওষ্ঠাগত হয় সংসার চালাতে। এর দায় পড়ে সরকারের ওপর, প্রভাব পড়ে ভোটে। তাই, জনগণ যেন বাজারের সুফল পায় সে উদ্যোগ, তদারকি ও নিশ্চয়তা সরকারকেই দিতে হবে।

বিজ্ঞাপন

আসছে বাজেটে মানবসম্পদ উন্নয়ন, সড়ক ও পরিবহন, অবকাঠামো, বিদ্যুত-জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ, স্বাস্থ্য, শিক্ষার মত খাতগুলো গুরুত্ব পাবে। বিদ্যুতের দাম বাড়বে বলে আগেই সতর্ক করেছেন অর্থমন্ত্রী। ভ্যাটের আওতায় আসবে অনেক খাত ও পণ্য। ব্যবসায়ীদের খুশী করতে কর্পোরেট কর কমানোর ঘোষনা রয়েছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে এক মিলিয়নেরও বেশী রোহিঙ্গা শরনার্থীর চাপ। তাদের জন্য আলাদা বরাদ্দ রাখতে হবে। সবমিলিয়ে হিসাব মেলাতে হিমশিম খেতে হবে অর্থমন্ত্রীকে।

জ্যাকব লিউ নামক একজন অ্যামেরিকান লেখক একবার বলেছিলেন, ‘বাজেট শুধুমাত্র অনেকগুলো সংখ্যার (অংক) সমষ্টিই নয় বরং জনগণের মূল্যবোধ ও আকাংখার বহিঃপ্রকাশও বটে।’

বাজেট মানেই সংখ্যা, পরিসংখ্যান ও দারুণ সব কথার ফুলঝুরি। এসব সংখ্যা বা কথার মধ্যেই লুকিয়ে থাকে সরকারের ভবিষ্যত লক্ষ্য, রাজনীতি ও কৌশল। জনজীবনের মানোন্নয়ন, নিয়ন্ত্রিত বাজার, সামষ্টিক অর্থনীতির শৃংখলা আর উচ্চ প্রবৃদ্ধির নিশ্চয়তা পেলে- ‘নির্বাচনী বাজেট’ই ভালো। স্বাগত জানাতে বসে আছি।

সাইফুল হাসান : সাংবাদিক, saiful.hasan@gmail.com
[মত-দ্বিমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব]

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন