বিজ্ঞাপন

অণুগল্প : আমার সমুদ্র বিকেল 

April 2, 2018 | 5:22 pm

কিযী তাহনিন 

চোখ বন্ধ করুন। বড় করে শ্বাস নিন। আরো গভীর করে। প্রিয় কোনো জায়গার কথা ভাবুন। ভাবুন, আপনি সেখানে অবস্থান করছেন। শান্তি। ভাবুন।

বিজ্ঞাপন

ঠিক এমন সময়গুলোতে ভাবতে গেলে আমি যে জায়গার কথা ভাবি, আমি এখন ঠিক সে জায়গাতেই বসে আছি। আসনপিঁড়ি হয়ে, সহজাত ভঙ্গিমায়। প্রকৃতিতে কৃত্রিমতা টেকেনা। ভেসে যায়।  আর যে হাঁসের ডিমের মতন প্রবাল পাথরে বসে আছি, তাতে কৃত্রিমভাবে বসবার কোনো সুযোগই নেই। সেখানে বসতে হবে, এভাবেই, সহজাতভাবে, আসনপিঁড়ি হয়ে। মুখোমুখি ডুবিডুবি সূর্য আমার ডান চোখের মনি বরাবর। একটুকরো রশ্মি নাকফুল ছুঁয়ে যাচ্ছে ঝিলিকে ঝিলিকে।  আমি সেই স্থানের মুখোমুখি, যে স্থানের কথা আমি চোখ বন্ধ করে ভাবি। চোখ খুলে সেই স্থানকেই বারবার দেখতে চাই। বারবার, প্রতিবার।

উড়োজাহাজ উড়বার আগখান দিয়ে যখন মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে, আমার চোখ তখন ঘুমঘুম। ঘুমের ঢুলুনিতে চোখ বুঁজে আসছিলো বারবার। আর তখন পাশে বসে থাকা বন্ধু বলে উঠলো, ‘এই প্লেন কিন্তু বাই রোড যাচ্ছে, জানো?’ তন্দ্রাভাব থেকে জেগে উঠে বোকাভাব নিয়ে তার দিকে তাকাই।

আমার ভুরুজোড়ায় অবাক প্রশ্ন। সে কৌতুক মাখিয়ে উত্তর দেয়, ‘নাহ, মানে এতক্ষন ধরে রানওয়েতে হাঁটছে তো , আমি ভাবলাম বাই রোড যাচ্ছে কিনা।’

বিজ্ঞাপন

সে মুহূর্তে আমার হাসি, বিরতিহীন হাসি, বিমান উড়বার গম্ভীর নীরব মুহূর্তে ছন্দপতন ঘটায়। হাসি সংক্রামক। হেসে ওঠেন সামনের সিটের অপরিচিত সহযাত্রীও। আমি হাসি, আর নিজের হাসিতে কান পাতি। বুঝি, আমি হাসছি, না ভেবে, না মেপে, খিলখিল। আমি বুঝে যাই আমার ছুটি শুরু। আমার সমুদ্র ছুটি।

সূর্য আমার চোখের মণি বরাবর নেই এখন আর। ডিমের নরম কুসুমের মতন গলে গলে আকাশের সাথে মিশছে। আকাশ আর সূর্যের নরম রং মিলমিশ হয়ে যে নতুন রং তৈরী করছে, আমি তার নাম জানিনা। আমি তাকে চিনি শুধু, আমি সে রং ধারণ করতে পারি।

আমি কাঁকড়ার তৈরী নকশা করা বালুর আসনে, এক পাথরে বসে আছি, আমার মতন করে। ছোটবেলায় শুনেছিলাম কাঁকড়া আর সমুদ্র নাকি বন্ধু। শুনেছিলাম এক কাঁকড়া সমুদ্রের পার ধরে হেঁটে বেড়াচ্ছে। সমুদ্রের বালিতে তার শরীরের ছাপে যে নকশার সৃষ্টি হচ্ছে, তা দেখে  কাঁকড়া নিজেই মুগ্ধ হয়। মুগ্ধ কাঁকড়া হেঁটে বেড়ায়, নকশা সৃষ্টির আনন্দে বিভোর। কিন্তু মুগ্ধ সময়ের আয়ু বুঝি বেশি দীর্ঘ হয়না। কাঁকড়া পেছন ফেরে দেখে, নকশাগুলো মুছে দিয়েছে সমুদ্রের বেহিসেবি ঢেউ। অভিমান হয় কাঁকড়ার।

বিজ্ঞাপন

সমুদ্রকে বলে, ‘কেন এমন করলে? আমার আনন্দের এই সৃষ্টিকে মুছে দিলে কেন? তুমি না আমার বন্ধু?’

সমুদ্র বলে, ‘দূরে তাকিয়ে দেখো, জেলের দল আসছে তোমায় নিতে, তোমার পায়ের ছাপ খুঁজে খুঁজে, পায়ের ছাপগুলো তাই মুছে দিলাম, তোমায় যাতে খুঁজে না পায়, তুমি এবার নিশ্চিত থাকো।’

কাঁকড়া সমুদ্রের মাঝে আশ্রয় নেয়। মুগ্ধ সময় ফিরে আসে ঢেউয়ের টানে টানে।

আমিও মুগ্ধ সময়কে জড়িয়ে পেঁচিয়ে জুবুথুবু হয়ে বসে সমুদ্রের সূর্যডোবা রং দেখি।

বিজ্ঞাপন

মন বলে, ‘বলতো মানুষ কেমন? সমুদ্র কেমন?’

আমি বলি, সময়ের সাথে ভেসে আসা মানুষগুলোকে দূর থেকে দেখলে বোঝা যায়না সে কাছে এসে ছুঁয়ে দিবে কিনা। কিন্তু দূর থেকে ভেসে আসা ঠিক কোন সমুদ্র ঢেউটি কাছে এসে ছুঁয়ে যাবে, ঠিক বুঝি, আগে থেকেই।

মন গুনগুন করে, ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন দিনে মন খোলা যায়…’

আমি ও সুর মেলাই, ‘জগতে কেহ যেন নাহি আর’।

এমন শুকনো দিনে এমন মন ভেজা গান আমরা কেন গাই জানিনা। জানার চেষ্টাও করিনা। সমুদ্রের পাশে এসে কেউ কারণ খুঁজেনা। সমুদ্রকে খোঁজে, কিংবা নিজেকে। অথবা সমুদ্রের মাঝে নিজেকে।

আমি বসে আছি, কিংবা আমরা। চারপাশে হয়তো অনেকে আছে, কিংবা নেই। আমি ক্রমশ ঘন হয়ে আসা চারপাশে, কাউকে খুঁজিনা। আমি সমুদ্র দেখি। আমি নিজেকে খুঁজি। আমার চোখ ভরা সূর্যডোবা রং, যে রঙের নাম আমি জানিনা। কিন্তু আমি সে রং চিনি। আমি সে রঙের আলোয় নিজেকে আরেকবার ভালোবাসি।

সমুদ্র’কে দেখবার এ গল্প প্রতিবার নতুন করে একইরকম হয়। আমাদের সবার সমুদ্র দেখবার গল্প আসলে একটাই।

সারাবাংলা/পিএম

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন