October 22, 2018 | 3:19 pm
পর্ব- ৩২।।
অনন্তলতা। এক অন্তহীন লতানো ফুলের নাম। অনন্তলতার দেখা পেলেই চলে যাই আমি জীবনানন্দ দাশের “বনলতা সেন” কবিতার মাঝে। অনেক ইচ্ছার পর মাস দুয়েক আগে ছাদবাগানে অনন্তলতাকে দত্তক আনতে পেরেছিলাম। সাধারণত গোলাপী রঙের অনন্তলতার সবখানে দেখা মেলে। আমার অনন্তলতার রঙ সাদা। যেদিন প্রথম ফুলগুলো ফুঁটেছিল, আমি মনে মনে শুধু জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন পড়ছিলাম। এখন প্রতিদিন তাদের একবার করে হলেও ছুঁয়ে দেই, সেই শান্তির নীড়।
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে
মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-অশোকের
ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের
সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের
বনলতা সেন।”
মাঝারী ড্রামে জৈবসার আর মাটির মিশ্রনে তার বাসস্থান করে দিয়েছিলাম। বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তাকে কাঁধ তৈরী করে দিয়েছি কয়েকদিন আগে।
ফুল ফুঁটে যাচ্ছে অবিরত। হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে তাঁর হাঁটবার আকুতি যেন অনন্তকাল ধরে কোন অন্তহীন ঠিকানার খোঁজ, ঠিক যেন অনন্তলতার প্রতিটা ফুলের পাপড়ির ভাঁজে ভাঁজে লুকানো থাকে সেই বনলতা সেনের ঠিকানা। জীবনের ক্লান্তিময় ক্ষণগুলো পার করে কবির জন্য খানিক সময়ের শান্তির নীড় যেন। সবুজ সবুজ ঘন পাতার মাঝে এক গুচ্ছ করে বের হওয়া ছোট্ট সাদা তিন পাপড়ির মাঝে হলুদ কমলা বুটিওয়াল পরাগের আভায় শান্তিময় এক বনলতাকে খুঁজে পাই।
“চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে
দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের
বনলতা সেন।”
সেদিন অনন্তলতা ফুলে একটা কুচকুচে কালো ভ্রমর মধু আহরণে এসেছিল। অনেকক্ষণ ধরে তাকে দেখতে গিয়ে মনে হয়েছিল হয়তো কবি ভ্রমরের বেশে ফিরে এসেছেন। কার্তিকের হালকা কুয়াশার সকালে অনন্তলতার মাঝে দিশা খুঁজে ফিরছিলেন। অন্তহীন ট্রাম লাইনে জীবনানন্দ তাঁর জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন, কেন জানি না। হাজার বছর ধরে, আঁধারকে জয় করে, সমুদ্র পার হয়ে, যার পৃথিবীর পথে হেঁটে বেড়ানোর অভ্যাস, সে কোন অন্তহীন ঠিকানা খুঁজে পাননি, জানা হয়নি কখনও। হয়তো শূণ্য মনে হয়, শূণ্য মনে হয় বোধটি অবোধের মতন মাথায় গেঁথে গিয়েছিল তাঁর।
“সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মত
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে
পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী – ফুরায়
এ জীবনের সব লেনদেন;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার
বনলতা সেন।”
জীবনভর জীবনানন্দ এভাবে জীবনকে ভর করে চলবে, জানা ছিল না আগে। তাঁর জীবনের লেনদেনের হিসেবে আমিও আমার জীবনকে খুঁজে পাই। ভালোবাসার মানুষের মৃত্যুদিন থাকতে নেই। ভালোবাসার মানুষ বেঁচে থাকে তাঁর ছেড়ে যাওয়া ভালোবাসার হৃদ কম্পনে। জীবনানন্দ দাশ বেঁচে আছেন আমার অনন্তলতার প্রতিটি ভাঁজে।
সারাবাংলা/ এসএস