বিজ্ঞাপন

আগস্ট শোকের মাস, ষড়যন্ত্রেরও

August 14, 2018 | 4:20 pm

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন ।।

বিজ্ঞাপন

আগস্ট শোকের মাস। জনক হারানোর শোক, মা হারানোর শোক, ভাই হারানোর শোক, বোন হারানোর শোক, সন্তান হারানোর শোক। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের পরিণতিতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পাকি রাজনৈতিক বীর্যে জন্ম নেওয়া ঘাতকের গুলিতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হন। বিদেশে থাকার কারণে সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান। সেই থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের উল্টো পথ চলা।

সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে আবার পুনর্বাসিত হয়। মুখ থুবড়ে পড়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি। অনেকেই বলেন, জিয়াউর রহমান হলেন আমাদের রাজনীতির ইতিহাসের অন্যতম শীর্ষ ভিলেন।

পঁচাত্তরের আগস্টেই সব ষড়যন্ত্র শেষ হয়ে যায়নি। জামায়াত-বিএনপির শাসনামলে ২০০৪ সালের একুশে আগস্ট আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের সামনে জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। সে হামলায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা অলৌকিকভাবে রক্ষা পেলেও কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ চব্বিশজন নিহত হন, আহত হয়েছিলেন শতশত আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মী। ঢাকার হাওয়া ভবনে জিয়াপুত্র তারেক রহমানের উপস্থিতিতে এই গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয়।

বিজ্ঞাপন

পরের বছর অর্থাৎ ২০০৫ সালের সতেরোই আগস্ট জামায়াতের মদদপুষ্ট জঙ্গী গোষ্ঠী জেএমবির উদ্যোগে সারা দেশের তেষট্টিটি জেলার পাঁচশো স্থানে একযোগে বোমা ফাটিয়ে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদী সন্ত্রাসের উপস্থিতি ঘোষণা করে। ভাদ্র মাস এলে যেমন রাস্তার কুকুরেরা পাগল হয়ে যায় তেমনি আগস্ট মাস এলে বাংলাদেশের এক শ্রেণীর অপরাজনীতিবিদরা অস্থির হয়ে ওঠেন। আগস্ট মাসের পনেরো তারিখে তারা তাদের রাজনৈতিক নেত্রী খালেদা জিয়ার ভুয়া জন্মদিন উদযাপন করতেও লজ্জাবোধ করে না।

এবছর আগস্টেও তারা আবার মরিয়া হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোর ট্রাফিক ব্যবস্থা অনেককাল ধরেই নাজুক। লাইসেন্সধারী বা বিহীন গাড়ি চালকদের স্বেচ্ছাচারিতাসহ বহুবিধ কারণে সড়কগুলো ক্রমাগত অনিরাপদ হয়ে উঠছিল। এরই ফলে গত উনত্রিশে জুলাই কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বিমানবন্দর সড়কের কাছে বাসে উঠতে গিয়ে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের ছাত্র রাজিব এবং ছাত্রী দিয়া নিহত হয়। জাবালে নূর পরিবহনের বাসটি চালক যেভাবে বাসের জন্য অপেক্ষারত ছাত্র-ছাত্রীদের উপর বাস তুলে দিয়েছিল তাকে নিছক দুর্ঘটনা বলা চলে না। সেটা ছিল স্রেফ হত্যাকাণ্ড। এই হত্যার প্রতিবাদে এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে পরবর্তীতে ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের কোমলমতি শিশুরা রাজপথে নেমে এসেছিল। নিরাপদ সড়ক গড়ে তুলবার লক্ষ্যে তারা নয় দফা দাবি পেশ করেছিল। স্বয়ং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু দেশের আপামর জনগণ শিশু-কিশোর এই যৌক্তিক আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। শিশু-কিশোররা দু’তিন দিনের জন্য ঢাকা শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থা নিজেদের হাতে তুলে নিয়ে সবার চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন যে সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ঢাকা শহরে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্ঘটনায় নিহত দিয়া-রাজিবের পরিবার প্রতি কুড়ি লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র দিয়েছেন। একাধিক মন্ত্রী তাদের বাসায় দিয়ে সমবেদনা জানিয়েছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার বক্তব্যেও শিশু-কিশোরদের ন্যায্য দাবি মেনে নেবার সুস্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন। সবাই দেখেছে, কিছু দাবি তাৎক্ষণিকভাবে মেনে নেওয়া হয়েছে এবং বাকি দাবিগুলো মেনে নেবার প্রক্রিয়াধীন। এভাবেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠা একটা সামাজিক আন্দোলন যখন শান্তিপূর্ণ সমাপ্তির পথে, তখন জাতি কিছু অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটতে দেখলো।

বিজ্ঞাপন

তেসরা আগস্ট সন্ধ্যায় কোন কারণ ছাড়াই মিরপুরে পুলিশের কেন্দ্র আক্রমণ করা হল। পরের দিন সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিকভাবেই ছাত্রবেশী একদল তরুণ ঝিগাতলায় জড়ো হয়ে ধানমন্ডি তিনের আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয় আক্রমণে উদ্যত হল। তাদের প্রতিহত করতে গিয়ে সেদিন আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের অসংখ্য নেতাকর্মী আহত হল। অথচ সেই মুহূর্তে পুরো পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশে-বিদেশে শহীদুল আলমের মত বুদ্ধিজীবী কিংবা নওশাবার মত অভিনেত্রীদের দিয়ে চারজন ছাত্রের মৃত্যু এবং চারজন ছাত্রীর ধর্ষিত হওয়ার গুজব ছড়ানো হল। সাথে জামায়াত-শিবিরের অনেক পোষ্যই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক গুজব ছড়াতে লাগল।

গুজবে তাৎক্ষণিকভাবে মানুষ বিভ্রান্ত হলেও একে একে সত্যসমূহ বেরিয়ে আসছে। কোমলমতি শিশু-কিশোরদের আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত করার দিবাস্বপ্ন দেখেছিল জামায়াত-বিএনপি গং। এ লক্ষ্যে সারা দেশ থেকে শিবির সহস্রাধিক ক্যাডারদের ঢাকায় এনেছিল। ছাত্রদলের ক্যাডাররা দিনের আলোয় প্রকাশ্যে সাংবাদিকদের প্রহার করে ছাত্রলীগের নামে দায় চাপানোর অপচেষ্টা করেছে। ফাঁস হয়ে যাওয়া বিএনপি নেতা আমির খসরুর টেলিফোনালাপে আমরা দেখেছি কীভাবে ছাত্রদলের ক্যাডারদের তারা কোমলমতি শিশু-কিশোরদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত করবার অপচেষ্টা করেছে। শিবির-ছাত্রদলের ক্যাডারদের স্কুল-কলেজের ইউনিফর্ম পরিয়ে নানা রকমের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে দেশের পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল। এই সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে তারা কয়েকজন শিশু-কিশোরের লাশ ফেলে দেবার ভয়াবহ ষড়যন্ত্র করেছিল। গোয়েন্দাবাহিনীর হাতে সময়মত ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনাগুলো চলে আসায় আইনশৃংখলা বাহিনীর সর্বাত্মক চেষ্টায় পরিস্থিতিকে শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে।

এবারের এই সংঘর্ষে জামায়াত-বিএনপির প্রবাসী সমর্থকদের তৎপরতাও ছিল লক্ষণীয়। ফেসবুকে একের পর এক লাইভে গিয়ে যা খুশী তাই গুজব রটিয়েছে। আমাদের অস্ট্রেলিয়া থেকে ‘অস্ট্রেলিয়া টোয়েন্টি ফোর আওয়ার’স নিউজ’ এর নামে একটা ভিডিও নিউজ ক্লিপ দেখলাম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সতেরো বছরের অধিককাল অস্ট্রেলিয়া থেকেও কখনো কোনও টেলিভিশন চ্যানেলে এমন গুজবনির্ভর সংবাদ পরিবেশিত হতে দেখিনি। সন্দেহবশত খোঁজ নিতে গিয়ে শঙ্কিত হবার মত তথ্য পেলাম।

এটি আসলে অস্ট্রেলিয়ার নিয়মিত কোন টেলিভিশন চ্যানেলের সংবাদ নয়। জামায়াতের অনুসারী একজন সাংবাদিক টিভি চ্যানেলের সংবাদের মত করে এই ভিডিও নিউজক্লিপটি বানিয়েছেন, সংবাদ পরিবেশনের জন্য একজন সাদা উপস্থাপককে ভাড়া করেছেন। তথাকথিত নিরপেক্ষতার তকমা লাগানো এই জামায়াতী সাংবাদিকটি সিডনির বাংলাদেশি সাংবাদিকদের একটি সংগঠনের সভাপতিও। লন্ডনের জামায়াতীরাও এবার গুজব রটানোয় পিছিয়ে ছিল না।

বিজ্ঞাপন

রাজনীতিতে গুজব রটিয়ে ফায়দা লোটার এই কৌশলটি জামায়াত-বিএনপির জন্য নতুন কিছু নয়। বাংলাদেশের জন্মের সূচনালগ্ন থেকেই স্বাধীনতার পরাজিত শক্তিরা বারবার গুজবের আশ্রয় নিয়েছে। এমনকি সাম্প্রতিককালে যুদ্ধাপরাধী দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে চাঁদে দেখতে পাওয়া, মতিঝিলে রাতের অন্ধকারে হেফাজতের হাজার হাজার কর্মী হত্যা করা থেকে এ মাসেই খুন ও ধর্ষণের গুজব রটিয়ে দেশের মানুষের ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। অঘটন ঘটানোর পাশাপাশি এসব গুজব রটনাকারীদের অন্যতম টার্গেট হল বাংলাদেশে স্বাধীনতার পক্ষের মানুষগুলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জননেত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, অধ্যাপক জাফর ইকবাল, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, এমন কী এ সময়ের সাহসী কণ্ঠস্বর অনুজসম অধ্যাপক মোহাম্মদ এ. আরাফাতও মৌলবাদী-সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দলের গুজবের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এসব চরিত্রহনন এবং গুজবের একটাই লক্ষ্য, দেশে একটা অস্থির হযবরল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে স্বাধীনতার পক্ষের সরকারকে যদি কোনভাবে হটানো যায়। এতকিছুর পরেও গুজব রটনাকারী মৌলবাদী-সন্ত্রাসীদের সাফল্য অত্যন্ত সীমিত।
গুজব রটানোর ফলে রাজনীতিতে সাময়িক লাভ হয়, ক্ষতি হয় দীর্ঘমেয়াদী। জামায়াত-বিএনপি এটা যত দ্রুত বুঝবে ততই তাদের জন্য, জনগণের জন্য এবং দেশের জন্য মঙ্গল।

ড. আবুল হাসনাৎ মিল্টন : আন্তর্জাতিক বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান, বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।

[মত-দ্বিমতে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব]

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন