বিজ্ঞাপন

আমালের শাস্তি ও মিশরীয় নারীদের দুরবস্থা

October 17, 2018 | 3:43 pm

সময়টা আমাল ফাতেহ ও তার পরিবারের জন্য একদমই ভালো যাচ্ছে না। ৩৩ বছর বয়সী আমাল ফাতেহ মিশরের একজন সাবেক মডেল ও অভিনেত্রী। ২০১৮ সালের ৯ মে দিনটা মন থেকে ভুলে যেতে চাইবেন আমাল। এইদিন একদিনে দুই দু’বার তাকে সেক্সুয়ালি এবিউজড হতে হয়।

বিজ্ঞাপন

প্রথমে একজন ট্যাক্সি চালক তাকে অনৈতিকভাবে ছুয়ে দেয়। তারপর সেদিনই ব্যাংকে গেলে ব্যাংকের সিকিউরিটিতে নিযুক্ত পুলিশ তাকে খারাপ ভাষায় আক্রমন করে ও তার যৌনাঙ্গ দিয়ে আমালের দিকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি প্রকাশ করে। এই দুই ঘটনার মাঝখানে ব্যাংক কর্মকর্তার কাছে রিপ্লেসমেন্ট ডেবিট কার্ড চাইলে সেখানেও তাকে খারাপ ব্যবহারের সম্মুখীন হতে হয়।

রাতে ঘরে ফিরে আমাল ফাতেহর মনে হল তার জন্য সেদিনের দিনটা একটু বেশিই খারাপ ছিল। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত আমাল আমেরিকায় চালু হওয়া মি টু মুভমেন্টে অনুপ্রাণিত হয়ে ফেসবুকে একটি লাইভ ভিডিও পোস্ট করেন। সেই ভিডিওতে নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘Screw anything that has the name of Egypt in it. Today the policeman at the bank was talking dirty to me while grabbing his penis. Screw the police.’তে হয় তাকে। যৌন হয়রানির ঘটনার মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই প্রতিবাদী ভিডিওর কারণে ১১ মে রাতে সূর্যাস্তের আগে রেইড দিয়ে আমাল ফাতেহকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে মিশরীয় পুলিশ। আমালের সাথেই গ্রেফতার করা হয় তার স্বামী দ্যা ইজিপশিয়ান কমিশন ফর রাইটস এন্ড ফ্রিডমের পরিচালক মোহাম্মদ লুতফিকে। শুধু স্বামী স্ত্রীই নয়, তাদের আড়াই বছরের ছোট শিশুকেও সেদিন থানায় নিয়ে যায় মিশরীয় পুলিশ।

স্বামী ও সন্তানকে কয়েকঘন্টা জেলে রেখে ছেড়ে দেওয়া হলেও আমাল ফাতেহকে পরবর্তী জেরার জন্য গ্রেফতার দেখিয়ে থানায় আটকে করে রাখা হয়। পরে আমালের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের করা হয়। প্রথমটা ছিল সন্ত্রাসী সংগঠনে যোগ দেওয়া ও ইন্টারনেটের সাহায্যে সন্ত্রাসে সাহায্য করা। আর দ্বিতীয়টা ছিল নিরাপত্তা কর্মীকে কাজ করতে না দিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ ও সরকারী দপ্তর ও তার কর্মকর্তাদের ক্ষতি করা।

বিজ্ঞাপন

পরবর্তীতে ২৪ মে এবং ৭ জুন নতুন করে আরও কিছু অভিযোগ আনা হয় আমালের বিরুদ্ধে। এগুলোর মধ্যে ছিল, সরকারের ক্ষতিসাধন করে এমন ভিডিও তৈরি করা, সোশাল মিডিয়ার অপব্যবহার ও মিথ্যে সংবাদ প্রকাশ ইত্যাদি।

এসব অভিযোগের পরও জুনের ১৯ তারিখ তাকে জামিনের আদেশ দেয়া হয়। জামিন দিলেও পরবর্তীতে ৮ আগস্ট ট্রায়ালের কথা বলে আবারও গ্রেফতার করা হয় আমালকে।

এদিকে মিশরীয় পুলিশের পক্ষ থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে ভিডিও প্রকাশের কারণে তাকে গ্রেফতার দেখানো হলেও ধারণা করা হয় এটা একটা প্রতিহিংসামূলক সাজানো মামলা। মানবাধিকারকর্মীদের ধারণা এই প্রতিহিংসামূলক মামলার পেছনে রয়েছে ২০১৬ সালের ইটালিয়ান গবেষক জিউলিও রোজেনির হত্যা। যার হত্যার পিছনে স্বয়ং মিশরীয় সিকিউরিটি সার্ভিসের হাত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়।

বিজ্ঞাপন

অনেকের ধারণা আমালকে গ্রেফতার করা মোহাম্মদ লুতফির প্রতি একধরণের সতর্কতা সংকেত। কারণ, মোহাম্মদ লুতফি জিউলিও রোজেনির হত্যাকাণ্ডের ন্যায়বিচারের জন্য লড়ে যাচ্ছিলেন। তার স্ত্রীকে হয়রানি প্রসঙ্গে এক বক্তব্যে মুহাম্মদ লুতফি বলেন They could not find a way to intimidate me, so they used my wife to give them a way in.

গত ২৮ সেপ্টেম্বর আমাল ফাতেহর বিরুদ্ধে করা প্রথম অভিযোগ অর্থাৎ সরকারি বাহিনী ও সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষতিসাধন ও অপমান করার মামলার রায় হয়েছে। এই রায়ে আমাল ফাতেহকে এক বছরের জেল এবং ১০,০০০ মিশরীয় পাউন্ড জরিমানা করা হয়েছে। মামলার রায়ের পর রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মুহাম্মদ লুতফি বলেন The sentencing is an appalling verdict that contains a message for every harasser, that he is free to harass without fearing punishment, and to every victim of harassment that if she speaks out, she will be jailed (এই রায়ের মাধ্যমে সমস্ত যৌন হয়রানিকারীদের বিরুদ্ধে একটা বার্তা দেওয়া হল যে তারা যে কাউকে যখন তখন হয়রানি করতে পারবে। এবং যে প্রতিবাদ করবে সে উলটে সাজা পাবে)।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এই রায়ের বিরুদ্ধে নিন্দা জানিয়েছে। সংস্থাটির উত্তর আফ্রিকা অংশের ক্যাম্পেইন পরিচালক নাজিয়া বৌনাইম এক বিবৃতিতে জানান, এটা অবিচারের এক চুড়ান্ত নিদর্শন যেখানে অভিযোগকারীর শাস্তি হয় আর হেনস্থাকারী রক্ষা পায়।

আমালের বিরুদ্ধে হওয়া রায়ের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘তিনি (আমাল) একজন human rights defender (মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিবাদ করেছেন) এবং যৌন হয়ারনি সারভাইভার যিনি পৃথিবীর সামনে মিশরে নারীদের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে সত্য প্রকাশ করেছেন। তিনি কোন অপরাধী নন। তার সাহসিকতার জন্য তাকে শাস্তি দেওয়া অনুচিত।’

বিজ্ঞাপন

আমালের বিরুদ্ধে আনা দ্বিতীয় অভিযোগ অর্থাৎ সন্ত্রাসী বাহিনীর সাথে যোগাযোগ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকার মামলার কার্যক্রমও দ্রুতই শুরু হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

উল্লেক্ষ্য, ২০০৮ সালের ৬ এপ্রিল সংগঠিত হওয়া ইয়ুথ মুভমেন্টে একদম প্রথম সারিতেই ছিলেন আমাল। এই আন্দোলনের ফলেই এক পর্যায়ে ক্ষমতাচ্যুত হন মিশরের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি হুসনে মুবারক।

আমাল একাই নন, মিশরে যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা নিয়ে যারাই জনসম্মুখে মুখ খুলেছেন তারাই একইরকম প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হয়েছেন। এবছরের জুলাই মাসে মোনা এল-মাজবোহ নামক একজন লেবানিজ পর্যটককে কাইরো বিমানবন্দর থেকে গ্রেফতার করা হয় ও তাকে আট বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

মোনাও একই ধরণের অভিযোগ করে ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন। গুজব ছড়ানো, সমাজ ও ধর্মের জন্য বিপদজনক ও প্রকাশ্য অশ্লীলতা ইত্যাদি অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হয় তাকে। পরে অবশ্য সাজা কমিয়ে এক বছর করা হয় ও সেপ্টেম্বর মাসে লেবানন ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয় মোনাকে।

২০১৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা মিশরের বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদেল ফাতাহ আল-সিসি ক্ষমতাগ্রহণের পর মিশরের রাস্তায় নারীদের নিরাপদ চলাচল ও নারীদের হয়রানি বন্ধের কথা বলে নারীদের সমর্থন অর্জন করেছিলেন। কিন্তু মিশরীয় নব জাগরনের পর ২০১৩ সালে জাতিসংঘের এক সার্ভে অনুযায়ী ৯৯ শতাংশ মিশরীয় নারীর যৌন হয়রানির অভিজ্ঞতা হয়েছে। ২০১৭ সালে থমসন রয়টার্স ফাউন্ডেশনের এক জরিপে কায়রো কে নারীদের জন্য পৃথিবীর সবচাইতে বিপদজনক মহানগরী হিসেবে অভিহিত করে।

অন্যদিকে মিশরের জাতীয় নারী পরিষদের সভাপতি মায়া মরসি দাবী করেছেন মিশরের মাত্র ৯.৬ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।

 

সারাবাংলা/ আরএফ/ এসএস

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন