বিজ্ঞাপন

‘আমি এখন যা করি শুনলে সবাই অবাক হবে’

August 17, 2018 | 5:35 pm

[গত বছরের ২৬ নভেম্বর শিল্পী মুর্তজা বশীরের সাক্ষাৎকার সারাবাংলায় প্রকাশিত হয়েছিল। শিল্পীর ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে লেখাটি পুনরায় ছাপানো হলো]

বিজ্ঞাপন

মুর্তজা বশীর বাংলাদেশের শিল্প আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রজন্মের চিত্রশিল্পী। গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (বর্তমান চারুকলা অনুষদ, ঢাকার বিশ্ববিদ্যালয়)-এর প্রথম ও দ্বিতীয় ব্যাচের শিল্পীদের মধ্যে বেঁচে আছেন একমাত্র তিনি। তাঁর জন্ম ১৯৩২ সালে ১৭ আগস্ট ঢাকায়। বাবা জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্, মা মরগুবা খাতুন। স্বাভাবিকভাবেই এই দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতির অন্দরমহলে প্রবেশ ছিল তাঁর শৈশব থেকেই। ছাত্রাবস্থায় যুক্ত হয়েছেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে। আর্ট কলেজে ভর্তি একটি নিয়মের মধ্যে হলেও ক্যানভাসে তিনি কোনো একটি বিষয় নিয়ে আটকে থাকেননি। মুর্তজা বশীর ইতালিতে শিল্পকলায় উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে আবার থিতু হয়েছেন মাতৃভূমিতে। অধ্যাপনা করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। তার ক্যানভাসে বিষয় বদল করেছেন একের পর এক। এঁকেছেন দেয়াল সিরিজ, এপিটাফ অব মার্টার আবার প্রজাপতির পাখা, কালিমা তাইয়্যিবা। দক্ষ লেখক, মুদ্রসংগ্রাহক হিসেবেও তাঁর সুনাম রয়েছে। কাজ করেছেন পোড়ামাটির টেরাকোটা নিয়েও। চলচ্চিত্র গড়ার কাজও করেছেন দক্ষতার সাথে। মুর্তজা বশীর একজন ভাষাসৈনিক, যুক্ত ছিলেন স্বাধীনতা আন্দোলনেও। মুর্তজা বশীর ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। বরেণ্য এই শিল্পীর বর্তমান সময় ও শিল্পচিন্তা নিয়ে সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মোহাম্মদ আসাদ

সারাবাংলা : অনেক দিন আপনার নতুন কাজ শিল্পপ্রেমীরা দেখতে পাচ্ছে না। এখন কী কাজ করছেন না?

বিজ্ঞাপন

মুর্তজা বশীর : আমার সারাটা জীবন, সেই শৈশবকাল থেকে আজ পর্যন্ত আমি আনন্দের অন্বেষায় ঘুরেছি। ছেলেবেলায় যা কিছু করতাম সেটা ডাংগুলিই হোক, লুকোচুরি খেলাই হোক… সবই কিন্তু আনন্দের জন্য করতাম। বাড়ি থেকে ১৪ বছর বয়সে পালিয়ে গিয়েছিলাম, সেটাও আনন্দের জন্য। আমি রাজনীতি করেছি আনন্দের জন্য। ছবি এঁকেছি, আনন্দের জন্য। কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প লিখেছি আনন্দের জন্য। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি আনন্দের জন্য। প্রেম করেছি আনন্দের জন্য, বিয়েও করেছি আনন্দের জন্য। এখন আমি ছবি আঁকাতে আনন্দ পাই না। যার জন্য আমি দুই বছর ধরে ছবি আঁকছি না। কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস লিখি না প্রায় দশ বছর ধরে। কারণ এতেও এখন আনন্দ পাই না। আমি বন্ধু-বান্ধবের সাথে গল্পকরে আনন্দ পাই না। আমি এখন যা করি শুনলে সবাই অবাক হবে। কিন্তু অবাক হলে তো আমার কিছু যায় আসে না। আমি আমার মতো চলি, আমি কারো মতো চলি না। এখন আমার কোরআন পড়তে খুব ভালো লাগে। আমার বাইপাস মেশিন আমি রাত ১১টায় বাঁধি। সেটা তিন ঘণ্টা পর রাত দুইটার সময় খুলি। আগে ছয় ঘণ্টা রাখতে হতো। এখন আমার ফুসফুস আগের থেকে অনেক ভাল। রাত দুইটার পর আমি কোরআন পড়ি। আমার ছোটবেলায় ১০/১২ বছর বয়সে আমি সাতবার কোরআন শরীফ শেষ করেছিলাম। আমার বাবা আমাকে হাফেজ করতে চেয়েছিলেন। আমার দুই ছিপারা মুখস্ত ছিল। তখন আমি আরবিতে পড়তাম। তখন কোরআনের বাংলা অনুবাদ ছিল না। তাই কী পড়ছি তার মানে বুঝা যেত না। এখন আরবি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা অনুবাদও পড়ি। বাংলাতে পড়ে আমার অনেক ভুল ধারণা পাল্টে গেছে। আমি ২৪ বছর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছি আমার পিতার সঙ্গে। আমার বাবা আমাদের নামাজের ইমামতি করতেন। তারপর ১৯৫৬ সালে আমি ইতালিতে চলে গেলাম। তারপর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল, নামাজ পড়া আর হয়নি। কারণ ইতালি থেকে দু’বছর পর করাচি এলাম। করাচি থেকে লাহোর, লাহোর থেকে ঢাকা, ঢাকা থেকে রাওয়ালপিন্ডি। এই ঘোরাঘুরির মধ্যে আমি আর নামাজ পড়িনি। এমন কি ঈদের নামাজও পড়িনি! আমি এখনো নামাজ পড়ি না। কিন্তু আল্লাহতে বিশ্বাস করি। আল্লাহর ওপর নির্ভরশীল। শুধু বিশ্বাস না তাঁর ওপর আমি সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছি। আমার বিশ্বাস আল্লাহ্ আমার সহায়ক। আমি ২০১৩ সালে ইউনাইটেড হাসপাতালে যখন জীবন-মরণ যুদ্ধে লড়ছি তখন ডাক্তাররা আমাকে লাইফসাপোর্ট দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করেছে। কিন্তু আমি আল্লাহকে ডেকেছি। আমার বড় মেয়ে বাবা বাবা বলে অস্থির হচ্ছে, তখন আমি বলেছি চিন্তা করো না আল্লাহ্ আছেন। আমি সারভাইব করেছি! আমি এই এপার্টমেন্ট কিনেছি ১৯৯৯ সালে। আমার সম্পূর্ণ পেনশন বিক্রি করেছি। সিলেটে বাংলাদেশ ব্যাংকে ম্যুরাল করার টাকা মিলিয়ে আমি এই এপার্টমেন্টটা নিয়েছি। আমি চট্টগ্রাম ছিলাম ৩০ বছর। যখন ২০০৩ সালে ১ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলাম। তখন আমার হাতে ছয় মাস চলার মতো টাকা ছিল। এই দিয়েই আমার সংসার চালাতে হবে। সামনে আবার রমজানের ঈদ পরে গেল। আমি রমজানের ঈদে ছেলে-মেয়েদের দুই হাজার টাকা করে দেই এবং তাদের সন্তানদের আমি এক হাজার টাকা করে দিই। আমি দেখলাম এই টাকা থেকে দিতে গেলে আমার হাত টানাটানি হবে। আমি চিন্তিত হলাম কিন্তু ভেঙ্গে পরিনি। এর মধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ফোন আসল আপনার ‘কলেমা তাইয়্যিবা’ ছবি কি আছে? কলেমা তাইয়্যিবা সিরিজ আমি করেছিলাম ২০০২ সালে। লোক পাঠাল ক্যাটালগের জন্য। সেটা দেখে বলল, এত নম্বর ছবিটা আছে? দাম কত দিবে জিজ্ঞেস করতেই বলল, আপনি বিল করে দেন। আমি বিল করে দিলাম, টাকা পাঠিয়ে দিল। শুধু এটা কেন আরও অনেক ঘটনার কারণে আমার সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস হয়েছে আল্লাহর অস্তিত্বে। আল্লাহকে আমরা দেখি না। বেহেস্ত কেমন আমরা জানি না। এটা বিশ্বাসের ব্যাপার। আমার জীবনের কিছু ঘটনা আছে যা দিয়ে আমি বুঝতে পেরেছি আল্লাহ আছেন। এখন আমি কোরআন পড়ি রাত দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত। তারপর ঘুমাই। সকাল-সন্ধ্যা অজিফা পড়ি। আমার স্ত্রী মারা গেছে তার জন্য দোয়া করি। সকালেও কোরআন পড়ি। আমার পিতা-মাতা, ভাই-বোন এদের কবর কখনও জিয়ারত করিনি। ১৯৬৮ সালে আমার মা মারা যাওয়ার পর তাঁর কবর জিয়ারত করতে যাইনি। আমার পিতা ১৯৬৭ সালে মারা যাওয়ার পর কখনো তাঁর কবর জিয়ারত করতে যাইনি। কারণ আমার একটা ভয় লাগত পিতা-মাতার কবরের সামনে গেলে আমার মন খারাপ হয়ে যাবে, দুঃখবোধ সৃষ্টি হবে। সেখানে আমি দেখলাম, সেটা আল্লাহর সাথে শিরক হয়ে যাবে। যার জন্য আমি যাইনি। এখন আমার স্ত্রীর কবরে আমি যাই প্রতি শুক্রবার। আমি তার কাছে ক্ষমা চাই। আমি জীবিত অবস্থায় নিজের মতো চলেছি। তাকে সেইভাবে দেখাশোনা করিনি। ফলে আমার মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে। সে জন্য আমি যাই আমার ক্ষমা চাওয়ার জন্য।

সারাবাংলা : শেষ বয়সে এসে আপনি কি মৃত্যুর ভয়ে এখন ধর্ম-কর্ম করছেন?

বিজ্ঞাপন

মুর্তজা বশীর : আমার বিষয়টা এ রকম নয়। আমি যৌবনেও ধর্ম-কর্ম করেছি। আমি ২৪ বছর পর্যন্ত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েছি। সেই ব্রিটিশ আমলের কথা, চকবাজার মসজিদের ইমাম ভরা মুসুল্লিদের সামনে আমাকে কোরআন শরীফ প্রেজেন্ট করেছিলেন। আমার বাবা সব ছেলেকে নামাজ পড়তে ডাকতেন এবং হুট করে ঘরে ডুকতেন না। আগে দরজায় টোকা দিতেন। ওনার মৃত্যুর দুই বছর আগে আমাকে ডাকতে আসলেন। দরজায় যখন প্রথম বার টোকা দিলেন, আমি খাটের নিচে লুকিয়ে থাকলাম। আমার বড় মেয়েকে বললাম, যাও বল বাবা ঘরে নেই। আমার মেয়ের বয়স তখন তিন বছর। ও দরজা খুলে বলল, দাদা, বাবা ঘরে নেই। পরে আমার খারাপ লাগল মেয়েটাকে মিথ্যা কথা শিখালাম। পরের দিন যখন আমার বাবা ডাকলেন তখন সরাসরি তার সামনে দাড়িয়ে বললাম, বলেন। তুমি নামাজ পড়তে চল। আমি বললাম কার ভয়ে, আপনার ভয়ে না আল্লাহর ভয়ে? বাবা বললেন, মানে তুমি কি বলতে চাও, তুমি কি আল্লাহকে বিশ্বাস কর না? আমি বললাম, আমি আল্লাহকে বিশ্বাস করি কি করি না, তা তো বলিনি। আমি আরও বললাম, আমি যদি নামাজ না পড়ি তাহলে আপনি বাড়ি থেকে বের করে দিবেন? আমি বৌ, মেয়েদের নিয়ে কোথায় যাব? কারণ আমার জীবনে প্রথম চাকরি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তখন আমার বয়স ৪১ বছর। তার আগে তেমনভাবে চাকরি করিনি। তবে সাদেক খানের ‘লুব্ধক’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য, শিল্পনির্দেশনা এবং প্রধান সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছি। ‘কারওঁয়া’ নামে একটি উর্দু চলচ্চিত্রের কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছি। হুমায়ূন কবিরের ‘নদী ও নারী’ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছি। ‘ক্যায়সে কাহু’ ফিল্মের স্কিপ্ট লিখেছি, সেট ডিজাইন করেছি। লাহোর, করাচি, রাওয়ালপিন্ডি গিয়েছি। প্রদর্শনী করেছি। আবার ঢাকায় ফিরে এসেছি। কিন্তু রেগুলার চাকরি বলতে যা বুঝায় সেটা আমি করিনি। আমি সব-সময় আল্লাহকে বিশ্বাস করেছি। আমাকে অনেকে বলে, আপনি মার্কসিস্ট, আপনি ধর্ম করেন? আমার মনে আছে ১৯৮০ সালে সাপ্তহিক বিচিত্রায় আমাকে নিয়ে কভার স্টোরি করেছিল। তখন ইন্টারভিউ নিয়েছিল মুনতাসীর মামুন। সেখানে সে প্রশ্ন করেছিল, আপনি মার্কসিস্ট হয়ে ধর্মকে বিশ্বাস করেন? আমি বলেছি, ধর্ম বিশ্বাস করা যাবে না সেটা কোথায় বলা আছে? যে কথাটা প্রচলিত আছে, মার্কস বলেছে ধর্ম হচ্ছে আফিমের মতো। আমি ১৯৯৯ সালে যখন বিলেতে, তখন আমার কোনো কাজ ছিল না। আমি তখন লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। ঘুরে ঘুরে কোথায়-কে বাস করতেন সেগুলোর ছবি তুলতাম। হাই-গেটে মার্কসের কবরে গিয়ে ছবি তুললাম। আমি তখন জানতে চাইলাম মার্কস কবরস্থ হল কেন? তখন আমি মার্কসের ওপর পড়াশোনা করলাম। দেখলাম মার্কস যখন ডাস ক্যাপিটাল গ্রন্থটা লিখছে তখন তার সন্তানদের মৃত্যু হচ্ছে। সন্তানদের তিনি কবরস্থ করছেন এবং নিজে মারা যাওয়ার পর কবরস্থ হয়েছেন। তার বন্ধু এঙ্গেলসকে নিশ্চয় বলেছিলেন তাকে কবরস্ত করকে। এঙ্গেলসের সমাধি আমি খুঁজে পাইনি। এঙ্গেলস বলেছিল তার মুত্যুর পরে দেহ পুড়িয়ে ছাই সমুদ্রে ফেলে দিতে। মার্কস যদি ধর্ম বিশ্বাস না করতেন তাহলে তার সন্তানদের কেন কবরস্থ করলেন? কেন তিনি নিজে কবরস্থ হলেন? পৃথিবীতে যেকোনো ভাষাভাষীদের কাছে ধর্ম এসেছে মানুষের মঙ্গলের জন্য। পরে শাসকরা জনসাধারণকে শোষণের জন্য একে হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু ধর্মের উৎপত্তি কিন্তু মানুষের কল্যাণের জন্য। আমি বৃদ্ধ বয়সে এসে ধর্ম-কর্ম করছি এটা সঠিক নয়। আমি সব-সময় আল্লাহকে বিশ্বাস করতাম। আমি কখনো বলিনি আমি নাস্তিক। আমার স্ত্রীর মৃত্যুর পর আমি যখন গভীরভারে পড়াশোনা করলাম তখন কবর আযাব, বেহেস্ত-দোজখ এগুলো যখন পড়লাম। একটু ভয়ই পেলাম। কেউ বলবে আগামী পৃথিবী আছে কিনা। আমি তো সেটা বিশ্বাস করি। আমার বাবাকে জিজ্ঞাস করেছিলাম ‘আপনি এত জ্ঞান আহরণ করলেন আপনি সমাজকে আপনি কিছু সেইভাবে দিয়ে গেলেন না। স্বার্থপরের মতো নিজের ভিতরেই সঞ্চিত করে রাখলেন। তিনি যে কথাটা বললেন, ইহকাল আমার কাছে ক্ষণস্থায়ী, আমার আসল জীবন হল পরকালে। সেই পরকালের কাজ আমি করছি। তাঁর বিরুদ্ধে লোকজন অভিযোগ করতেন তিনি মিলাদ পড়াতেন, ওয়াজ করতেন। এটা একটা বিশ্বাস। ওই যে আমি যখন বললাম, আপনার ভয়ে আমি নামাজ পড়ি? তখন বললেন, তুমি কি আল্লাহকে বিশ্বাস কর না? তখন বাবা আমাকে বললেন ‘আমি কে? আমি তো থতমত খেয়ে গেলাম। বললাম আপনি মানে? মানে হল আমি কে? তোমার কী আমি? আমি বললাম, আপনি আমারা বাবা। তুমি কী করে জান, আমি তোমার বাবা হই? তোমার তো জানার কথা না। তোমাকে ছোটবেলা থেকে বলা হয়েছে আমাকে বাবা ডাকতে, তাই তুমি আমাকে বাবা ডাক। তোমার মা জানে তোমার বাবা কে। এই যে তুমি আমাকে বাবা ডাক এটা তোমার বিশ্বাস। সে রকম আল্লাহ আছে সেটা বিশ্বাস।

সারাবাংলা : আপনার শিল্পকর্ম, সাহিত্য, গবেষণা, সংগ্রহ কোনটাকে প্রধান হিসেবে দেখেন?

মুর্তজা বশীর : আমি কিন্তু ওয়ান ট্রাক ম্যান। আমি যখন গল্প লিখেছি, তখন কবিতা লিখিনি। যখন কবিতা লিখেছি, তখন ছবি আঁকিনি। যখন ফিল্মের সাথে জড়িত ছিলাম। তখনো কিন্তু আমি ছবি আঁকিনি। আমি যখন গবেষণা করেছি ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ নিয়ে। আমার এই বই লিখতে সাত বছর লেগেছিল। এই সাত বছর ছবি আঁকিনি। টুকটাক কিছু কাজ করেছি সংসার চালানোর জন্য। তখন বেতন তো খুব কম ছিল। এখন প্রফেসররা যেমন ৬০/৭০ হাজার টাকা বেতন পায়। আমাদের সময়ে তেমন ছিল না। সিলেকশন গ্রেডে যারা ছিল তাদের বেতন ছিল দশ হাজার টাকা। দশ হাজারের মধ্যে বাড়ি ভাড়া দিতাম তিন হাজার টাকা। এই দিয়ে সংসার তো চলে না। সাথে ওষুধপত্র আছে। আবার আমার স্ট্যাম্প, কয়েন্স কেনার শখ আছে। এভাবেই আমার সংসার চালাতে হয়েছে। আমার জন্ম যেহেতু তথাকথিত সোনার চামচ মুখে নিয়ে। আমি কলেজ জীবন পর্যন্ত নিজে ঢেলে পানি খাইনি। ডাইর্নিং টেবিলে গ্লাস রয়েছে, পানির জগ রয়েছে আমি কাজের লোককে ডেকেছি, সে পানি ঢেলেছে। আমি যখন ১৯৫৯ সালে করাচিতে ছিলাম তখন ভিক্ষুকের সাথে বসে খেয়েছি। সেখানে আমার মেঝ ভাই থাকতেন। সে করাচি ডকইয়ার্ডের ইঞ্জিনিয়র ছিল। আমার বাবা-মা থাকতেন সেখানে। কিন্তু আমি নাট্যকার সাঈদ আহমেদের সার্ভিসেস ক্লাবে উঠেছিলাম। আমি তার বিছানায় ঘুমাতাম না যদি পিঠ ব্যথা করে কার্পেটে ঘুমাতাম। আমি বলেছি, তুমি আমাকে সেল্টার দাও আমি ছবি আঁকব, প্রদর্শনী করব। আমি মাসের পর মাস গভর্নমেন্ট এপ্রুব হলুদ রঙের মধ্যে কালো রং দিয়ে লেখা চার আনায় ভিখিরিদের সাথে খেতাম। দু’আনার রুটি, দু’আনার শিক কাবাব। আমি তো সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছি, আমার তো এসব করার কথা না। আমার বাবা আমাকে লেখাপড়া করিয়েছেন ব্যাস শেষ, কেন যাব কারো কাছে। আমি ১৯৫৪ সালে পাস করার পর নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে ড্রইং মাস্টারের চাকরি করতাম। ১০০ টাকা বেতন। আমি মাকে ৩০ টাকা দিতাম। মা বললেন আমাকে হাত খরচ দিলি। আমি বলেছি না আমি যে তিনবেলা আপনার বাড়িতে খাই এ জন্য দিলাম। আমার আত্মসম্মানবোধ আছে। আমার সারা জীবনে যত কাজ করেছি তার সবগুলিই আমার কাছে সমান ভালবাসার। তার মধ্যে পেইন্টিংস আমাকে অর্থকড়ি দিয়েছে। আমার প্রধান পরিচয় আমি চিত্রশিল্পী। আমার দ্বিতীয় পরিচয় এগুলো কেউ জানেও না। আজ থেকে পাঁচ ছয় বছর আগে ভোরের কাগজ পত্রিকার ঈদ সংখ্যায় জন্য একটা ইন্টারভিউ নিয়েছিল। সেখানে প্রশ্ন করেছিল, আপনার মৃত্যুর পরে আপনি কি হিসেবে বেঁচে থাকবেন? আমি কোনো রকম দ্বিধা ছাড়া বলেছিলাম, আমি লেখক হিসেবে বেঁচে থাকব। আমি হাবশী সুলতানদের ওপর যে ইতিহাসটা লিখেছি এ দেশে মুসলিম সুলতানদের ওপর লেখায় আব্দুল করিম পথিকৃত। আমি নতুন ইন্টারপেট করেছি। যারাই বাংলার স্বাধীন সুলতানদের ওপর লিখেছে। তার জন্য মৌলিক চারটা বই আছে। কারণ এই সময়ে কোনো ইতিহাসবিদ ছিল না। এই চারটি বই থেকে সবাই কপি করে। আব্দুস সেলিমের ‘রিয়াজুস সালাদীন, স্টুয়াডের হিস্ট্রি অব বেঙ্গল, ফেরেস্তা মূল গ্রন্থ যার সাহায্য সবাই নিয়েছে। কিন্তু আমি যেহেতু ছবি আঁকি, আমি যা দেখি তা তো আঁকি না। আমি সেটার ইন্টারপেট করি। ঠিক সেই রকম আমি ইতিহাস লিখেছি। যেমন সুলতান সাইফুদ্দীন সম্পর্কে বলা হচ্ছে তিনি অনেক প্রজাবৎসল ছিলেন, গল্পটা হল টেবিলের ওপর প্রচুর সোনার মোহর। তিনি যখন যাচ্ছেন তখন দেখে বললেন এইগুলো কার? তখন আমির ওমরাহরা বলছে এইগুলো আপনার। সুলতান বলছে ঠিক আছে এইগুলো গরিবদেরকে বিতরণ করে দাও। এইগুলো তার প্রজার প্রতি ভালবাসার উদাহরণ। তখন ফুটনোটে বলা হচ্ছে, আমির-ওমরাহরা বলছে— এইগুলোতো এই হাবশী নিজে সংগ্রহ করেনি। সুলতানও বলেনি তাকে। এইগুলো সংগ্রহ করেছে ওর পূর্বসূরিরা। কারণ সে ছিল কালো। এই যে ঘৃণাটা এটা আমি ইন্টারপেট করেছি। ইংরেজিতে একটা কথা আছে ‘ওয়ার্ড বিটুই লাইন’ এই লাইনের মাঝখানে যে ওয়ার্ড সেটা আমি ছবি আঁকি বলেই দেখেছি।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা : যতই আপনার সাহিত্যের কথা বলেন আপনার পরিচয় চিত্রশিল্পী, আপনার কাজ আমাদের এ দেশের শিল্পকলা আন্দোলনে অনেক নতুনত্ব যোগ করেছে…

মুর্তজা বশীর : সত্যিকথা বলতে কি, আমার মূল্যায়ন হয়নি। আমি যখন ট্রান্সফারেন্সি করলাম ১৯৫৭-৫৮তে। ইতালিতে বসেই করেছি। আমরা বলি কোনো বিষয়ের ব্যাকগ্রাউন্ড। ধরো, একটি মেয়ে বসে আছে চেয়ারে, সামনে টেবিল। পিছনে একটা জানালা। জানালায় একটা পর্দা। তারপর আকাশ দেখা যাচ্ছে। আবার এটাও তো সত্যি, জানালার পিছনে আকাশ, তার সামনে একটা জানালা। জানালায় খোলা একটি পর্দা। তার সামনে একটি মেয়ে। মেয়েটা টেবিলের সামনে একটি চেয়ারে বসে আছে। অতএব আমি বললাম, তথাকথিত ব্যাকগ্রাইন্ড বলে কিছু নেই। বিষয়গুলোগুলো সব অঙ্গা-অঙ্গীভাবে জড়িত। তখন আমি কি করতাম, বস্তুর যে রং তা দিয়ে লাইন দিতাম। পরবর্তীকালে লাইনের বদলে রঙের নানা রকম স্তর করে কাজ করলাম। তারপর ছবিটা এক্সরের মতো ট্রান্সফারেন্ট হয়ে গেল। এটা পৃথিবীতেই কেউ করেনি। আমি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের ওপর ভিত্তি করে পাথরের নূড়িকে ভিত্তি করে এপিটাফ অব মার্ডার করলাম। আমার দুর্ভাগ্য যে আমি জন্মেছি এই দেশে। ইউরোপে জন্ম হলে হলে আমাকে নিয়ে অনেক আলোড়ন হতো। আমি আর্টকে নতুনভাবে ইন্টাপেট করেছি। রিয়ালিজম কী? যেটা চেনা যায়। তোমার পোর্টেটে তোমার চেহারা মিললে বলবে এটা আসাদ। চেহারা না মিললে বলবে একজন মাথায় কাপড় বাধা মানুষ। আমি হুবহু ফটোগ্রাফিক্যাল ফিনিশ করলাম। এগুলো দেখে চেনা যায় না। পাথর আঁকলাম, প্রজাপতির ডানা, দেয়াল আঁকলাম। একটা ক্ষুদ্র অংশ আমি এনলার্জ করে ক্যানভাসে এনেছি। এইগুলোকে আমি নাম দিলাম অ্যাবাস্ট্রাক-রিয়ালিজম বা বিমূর্তবাস্তবতা। বিমূর্তবাস্তবতা বলে কিছু ছিল না। অ্যাবস্ট্রাক-এক্সপ্রেসনিজম আছে। তবে আমি যা কিছু করেছি, এপিটাফ করেছি, উইং করেছি একজন রেনেসা শিল্পীর দৃষ্টি নিয়ে আর ইম্পেশনিস্ট শিল্পীর মেজাজ নিয়ে ছবি এঁকেছি। যেমন রেনেসা পেইন্টাররা একটা হলুদ লাগিয়েছে। আমি সেখানে নানা রকম হলুদ লাগিয়েছি। লেমন, ক্যারমিয়াম, ক্রোম ইত্যাদি হলুদ লাগিয়েছি। এটা ইম্পেশনিস্ট শিল্পীদের কাজ। আমি এই দুইয়ের সংমিশ্রণ করেছি।

সারাবাংলা : ছবি আঁকা নিয়ে আপনার নতুন কোনো পরিকল্পনা …?

মুর্তজা বশীর : আমার স্ত্রী মারা গেছে এ বছরের ১৩ মে। আমার ইচ্ছা ছিল ২৬ অক্টোবর একটা প্রদর্শনী করার। জ্যামিতিক আকারের বিষয় নিয়ে। একটা মাথা মানে সার্কেল বা বৃত্ত। একটা শরীর মানে আয়তক্ষেত্র। কিন্তু সেটা আর আঁকা হয়নি। আমি এখন আঁকা-আঁকিতে আনন্দ পাই না। আমার বয়স ৮৬ চলছে। কতদিন বাঁচব জানি না। আমার ইচ্ছা আমার স্ত্রীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে একটা প্রদর্শনী করব। কী আঁকব জানি না, যা ইচ্ছা তা-ই আঁকব। সেটা এপিটাফও হতে পারে, দেয়ালও হতে পারে, সেটা উইংও হতে পারে, আবার ফিগারেটিভও হতে পারে। যা আমার ইচ্ছা হবে আঁকব। সেটা আমার স্ত্রীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করব।

সারাবাংলা : সাধারন মানুষ ছবি চিত্রিত করা সমস্যা মনে করেন কেন?

মুর্তজা বশীর : আমার পিতাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ১৯৬০ সালে। আমি তখন লাহোর থেকে করাচি গেছি। বাবা তখন করাচিতে উর্দু ডেভলপমেন্ট বোর্ডের প্রধান সম্পাদক। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, অনেকে বলে আপনি মুসলমান হয়ে ছবি আঁকেন কেন? ছবি আঁকা কি নিষেধ? আল্লাহ নিষেধ করেছেন? বাবা বললেন, না। তুমি আমার ছবি আঁকতে পার কিন্তু সে ছবি দেখে যদি তোমার মধ্যে ভাবেব সৃষ্টি হয় তাহলে শিরক হবে। আমি ডাকটিকেট সংগ্রহ করি। তখন ডাকটিকেটে কোনো প্রতিকৃতি থাকত না। কিন্তু আজ? মুদ্রা, কাগজের নোট, ডাকটিকেট এখন সৌদি বাদশাহর প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে। বাবার মৃত্যুর আগে তাঁর চার-পাঁচটা ড্রইং করেছিলাম, পেইন্টিং করিনি। সেগুলো করিছি দূর থেকে দেখে। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখেছি উনি পড়ছেন। ১৯৬৯ সালে ১৩ জুলাই বাবা মারা যান। মৃত্যুর সাতদিন আগে আচকান পরে, টুপি পরে এসে বললেন, আমার একটা ছবি আঁক। একজন প্রফেশনাল মডেলের মতো তিনি বসলেন, আমি ছবি আঁকলাম। বললাম, ডানে তাকান, বায়ে তাকান। আমি তাঁর ড্রইং করলাম। তিনি আমাকে ইতালিতে পড়িয়েছেন।

সারাবাংলা : ইউরোপের রঙের সাথে আমাদের রঙের কোনো পার্থক্য আছে?

মুর্তজা বশীর : ইউরোপের রঙের সাথে আমাদের রঙের পার্থক্য সেইভাবে নাই। আমাদের রং বলতে উষ্ণ রং। হলুদ, লাল, কমলা, সবুজ। ইউরোপে ধূসর রংটা দেখা যায়। তার কারণ হল কুয়াশা। পাসপেক্টিভ আমরা পাশ্চাত্যের অনুকরণ করেছি। আমাদের মধ্যে এস এম সুলতান এরিয়াল পাসপেকটিভে কাজ করত। একটু উপর থেকে দেখা। সুলতানের কাছে প্রাচ্যের পাসপেকটিভ ছিল। জাপানিজ, চাইনিজ, মোঘল, রাজপুত, কাংড়া চিত্রকর্মের পানপেটিভের মতো।

মুর্তজা বশীরের আঁকা একটি ছবি

সারাবাংলা : আপনার সংগ্রহগুলো নিয়ে আপনার ভাবনা…?

মুর্তজা বশীর : আমার সংগ্রহের মধ্যে স্ট্যাম্প ধরলে অনেক দুর্লভ স্ট্যাম্প আছে। সপ্তম অ্যাডওয়ার্ডের ভারতের ২৫ টাকা দামের স্ট্যাম্পটা আমার জানা মতে বাংলাদেশে কারো কাছে নেই। আমি ১৯৬৩ সালে আড়াই শ’ টাকা দিয়ে এটা কিনেছি। তখন সোনার ভরি ছিল ৮০ টাকা। এই কথা আমার স্ত্রীকে ৫/৬ মাস বলিনি। তখন ফিলিপসের ২৪ ইঞ্চি টেলিভিশনের দাম ছিল ১০০ টাকা। সেই জায়গায় আড়াই শ’ টাকা দিয়ে একটা স্ট্যাম্প কেনা কঠিন বিষয়। আনন্দের জন্য স্ট্যাম্প কিনেছি। আমার মুদ্রার যে সংগ্রহ, আমি মোগলদের দেখিনি, সুলতারদের সময়ে জন্মি নাই। কিন্তু তাদের মুদ্রা দেখে অনেক কিছুই জানতে পারি। আমি তো নিউগিনি কখনো যাইনি। পাপুয়া নিইগিনি কখনও যাইনি। অথবা জামাইকায় যাইনি। ওই দেশের কারেন্সি নোট কেমন হয়, কয়েন্স কেমন হয় এসব জানার ইচ্ছা থেকেই মুদ্রা সংগ্রহ শুরু করি। আমার বইপত্র যেগুলো আছে। আমার ছেলে-মেয়েদের বলেছিলাম আমি জীবিত থাকতেই এইগুলো জাতীয় জাদুঘরে দান করে দিতে চাই। আমার বড় মেয়ে না করল। বললাম থাক। মৃত্যুর পর কী হবে জানি না। ওরা বিক্রি করতে চাইলে বিক্রি করবে। আমার ছেলে-মেয়েদের ইচ্ছা আমার এই ফ্ল্যাটটা একটা জাদুঘর বানাবে।

সারাবাংলা : সমাপ্তি প্রশ্ন, আপনি সব মিলিয়ে কেমন আছেন?

মুর্তজা বশীর : আমি শারীরিকভাবে ভালো আছি। কিছু দিন আগে রক্তচাপ একটু বেড়ে গিয়েছিল। এখন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে আছে। অর্থের একটু চিন্তা আছে। আমি যেহেতু আল্লাহকে বিশ্বাস করি, আল্লাহই পথ দেখাবেন। আমার কিছু অর্থকড়ি ছিল সেটা দিয়ে আমার স্ত্রীর নামে এশিয়াটিক সোসাইটিকেতে ‘আমীনা বশীর স্মৃতি ট্রাস্ট ফান্ড’ করেছি। সেখানে প্রতিবছর একটি বক্তৃতার আয়োজন করা হবে। কিন্তু আমার মেয়েরা বলল, বাবা আপনি আম্মার জন্য যেটা করার দরকার সেটা তো করলেন না। আমি বললাম যেমন? মসজিদে দান খয়রাত করা যেত। আমি একটি মসজিদে পানির ট্যাংকির জন্য টাকা দিয়েছি।

সারাবাংলা : আমাদের সময় দেয়ার জন্য ধন্যবাদ।

মুর্তজা বশীর : তোমাকেও ধন্যবাদ।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন