বিজ্ঞাপন

‘ইয়া পাখিটি’র কতটা যন্ত্রণা

March 15, 2018 | 8:07 pm

।।শামীম রিজভী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট।।

বিজ্ঞাপন

আদর করে নাবিলা তার মেয়েকে ডাকতেন ‘ইয়া পাখি’। তবে ওর নাম ইনাইয়া ইসলাম হিয়া। মায়ের পুরো নাম শারমিন আক্তার নাবিলা। গত সোমবার (১২ মার্চ) ইউএস-বাংলার যে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হয় তার কেবিন ক্রু হিসাবে নাবিলা ছিলেন। নাবিলা যে আর নেই তা এখন সবাই জানে। জানেনা কেবল তার ‘ইয়াপাখি’। সেই থেকে তার মুখে কেবলই মায়ের জন্য আর্তি… মা…মা…মা। তুমি কই!

হিয়ার সে প্রশ্নের উত্তরে একেকজন একেক কথা বলছে। সবই মনভোলানো কথা। কিন্তু সদ্য মা হারানো হিয়াকে নিয়ে তার পরিবারের মানুষগুলো যা করেছে, তাও কি অমানবিকতাকে হার মানায় না? পারিবারিক টানা-হেচঁড়ায় অনেক যন্ত্রণা, অনেক ভোগান্তি, অনেক ধকল গেছে দুই বছরের এই ছোট্ট শিশুটির উপর।

বিজ্ঞাপন

‘মা গিয়েছে স্বর্গে আমার… বাবা জেলে। এমন ভাগ্য কোথায় বলো পায় কোন ছেলে’ এখন ঠিক সেই ভাগ্যই বরণ করেছে হিয়া নামের মেয়েটি।

পরিবারে সঙ্কট আগে থেকেই ছিল। কিন্তু ব্যক্তিগত সেসব বিষয় নিয়ে কারো মাথাব্যাথা ছিল না। তবে কাঠমান্ডুতে বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার পর হিয়ার জীবনে নেমে আসে নতুন অমানিশা। তাতে সে তার মাকে হারায়। পাশাপাশি পরিবারের সদস্যরা তাকে নিয়ে শুরু করে টানা হেঁচড়া।

প্রথমেই খবর এলো হিয়াকে অপহরণ করে নিয়ে গেছে তাদের বাসার গৃহকর্মী হয়ে ছিলেন যে নারী তিনি। সে নিলে শুরু হলো খোঁজাখুঁজি। গৃহকর্মীকে ধরে আনা হলো। আর তার সূত্র ধরেই জানা গেলো হিয়ার নানী ও দাদী এরই মধ্যে ঝগড়ায় লিপ্ত, কার কাছে থাকবে হিয়া। কেবল তাই নয়, হিয়াকে লুকিয়েও রাখা হলো। পরে জানা গেলো সে রয়েছে তার দাদীর কাছে। সেখানে গিয়ে জানা গেলো এরই মধ্যে অনেক করুণ কাহিনীর সাক্ষী হয়েছে ছোট্ট এই শিশুটি।

বিজ্ঞাপন

চার বছর আগে ভালোবেসে শারমিন আক্তার নাবিলা ওরফে নিশাত বিয়ে করেন হাসান ইমাম নামের এক যুবককে। নাবিলার পরিবার বিয়ে মেনে না নিলেও হাসানের পরিবার তাদের এই বিয়ে মেনে নেয়। সংসার শুরুর দেড় বছরের মধ্যে তাদের ঘর উজ্জ্বল করে জন্ম নেয় ছোট্ট হিয়া। ঠিকঠাকই চলছিল সবকিছু, সন্তান জন্মের পর নাবিলা ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সে চাকরি শুরু করেন। হিয়া সব সময় তার দাদী বিবি হাজেরার কাছেই থাকত। চরাই-উৎরাই পেরিয়ে যেমন সবাইকে এগুতে হয় তেমনি নাবিলা-হাসানের সুখের সংসারেও আসে ঝড়।

মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন হাসান। একদিন পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। হাসান এখন আছেন গাজীপুর কাশিমপুর কারাগারে। স্বামী জেলে যাওয়ার পর নাবিলা আলাদা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করেন। ইয়া পাখি হয়ে ওঠে নাবিলার পুরো দুনিয়া। নাবিলা যখন ফ্লাইটে যেতেন তখন হিয়াকে রেখে যেতেন গৃহকর্মী রুনার কাছে। এভাবেই চলছিল দিন।

কিন্তু গত সোমবার বেলা আড়াইটায় ৬৭ যাত্রী আর ৪ ক্রু নিয়ে বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়া ইউএস-বাংলার বিএস-২১১ উড়োজাহাজটি কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন বিমানবন্দরে বিধ্বস্ত হওয়ার পর নাবিলার মৃত্যু নিশ্চিত করেছে ইউএস-বাংলা।
ওই দিন সন্ধ্যায়ই খবর ছড়িয়ে পড়ে এই ফাঁকে হিয়াকে অপহরণ করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

খবর যেভাবে ছড়ায়

দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর সোমবার সন্ধ্যায় উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে নাবিলার বাসা থেকে হিয়াকে তার দাদী ও চাচী আনতে গেলে বাসা তালা বন্ধ পান। উদ্বিগ্ন দাদী বিবি হাজেরা উত্তরা পশ্চিম থানায় ওই রাতেই জিডি (জিডি নম্বর-৯০২) করেন। জিডির সূত্র ধরে নাবিলার গৃহকর্মী রুনাকে (২৮) এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

রুনা পুলিশকে জানায়- নাবিলার রুমমেট নুসরাত জোর করে হিয়াকে তার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন। পরে পুলিশ অনুসন্ধানে জানতে পারে, নুসরাত হিয়াকে তার নানী নীলা জামানের কাছে রেখে গেছেন। পুলিশ নানী নীলার সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে। কিন্তু নানী পুলিশকে সাড়া দিচ্ছিলেন না। এমন সময় পুলিশ অন্য একটি সোর্সের মাধ্যমে জানতে পারেন- হিয়ার নানা ও নানী তাকে নিয়ে মিরপুরের পল্লবীতে কেএফসিতে গেছে। পুলিশ সময় মত সেখানে গিয়ে সবাইকে থানায় নিয়ে যায়।

থানায় হিয়াকে আনার পর ছোট্ট শিশুটিকে নিয়ে তার দাদী ও নানীর মধ্যে শুরু হয় টানাহেচঁড়া। হিয়াকে নিজেদের কাছে নেওয়ার জন্য শুরু করেন কাদা ছোড়াছুড়ি।

সারাবাংলাকে দাদী বিবি হাজেরা বলেন, নাবিলার মা এই বিয়ে মেনে নেয়নি। নাবিলা তো তার মা’র কাছেই যেতই না। আমরা এই বিয়ে মেনে নিয়েছি। হিয়া জন্মের পর থেকেই আমার কাছে থেকেছে। তাদের হঠাৎ এখন দরদ এসে পড়ল।

তিনি বলেন, বাসায় গিয়ে হিয়াকে না পেয়ে কত কেঁদেছি। আমি বয়স্ক মানুষ রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত নাবিলার বাসার নিচে বসে অপেক্ষা করেছি। তাদের নম্বর যোগাড় করে কল করেছি। অথচ তারা কেউই সাড়া দেয়নি।’

বিবি হাজেরা বলেন, বউমা জীবিত আছে কিনা জানি না। কিন্তু এত দিন যে মেয়েকে তারা মেনে নেয়নি, সেই মেয়ের সন্তানকে নিয়ে কেন টানাটানি করছে?

পাল্টা অভিযোগ করছিলেন নানী নীলা জামান বলেন, আমি আমার ছোট মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বাসায় আসার পরও টিভি দেখিনি। হঠাৎ এক জন ফোন করে টিভি দেখতে বলেন। তখনই দুর্ঘটনার কথা জানতে পারি। সবাই চেষ্টা করি নাবিলার খোঁজ নেওয়ার। এমন সময় সন্ধ্যায় নাবিলার রুমমেট নুসরাত আমাকে কল করে জানায়- হিয়া এখন আমার কাছে আছে। নাবিলা আমাকে বলে গিয়েছিল, কখনো আমার যদি কোন কিছু হয়, তাহলে আমার মেয়েকে তার নানীর কাছে দিয়ে এসো।

নীলা জামান বলেন, ‘নাবিলা বেঁচে আছে কি না জানিনা, তবে তার ইচ্ছা ছিল, তার সন্তান আমার কাছে থাকবে। আমি হিয়াকে কিছুতেই দেব না।

দাদী বিবি হাজেরার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তাদের এই ঝামেলায় আমি আমার মেয়েরই খবর নিতে পারি নি। তাছাড়া নাবিলার স্বামী মাদকাসক্ত ছিল। নাবিলাকে নির্যাতন করত। আমার সম্মতিতে সে বিয়ে করেনি।’

তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে যেভাবেই থাকুক না কেন তাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দিন। আর হিয়াও আমার কাছে থাকবে। কারণ এটা নাবিলার শেষ ইচ্ছা।’

এদিকে, নানী-দাদীর লড়াইয়ে বিন্দুমাত্র মনযোগ ছিল না ইয়া পাখির। সে তার চাচাতো বোন রামিসার সঙ্গে খেলছিল। কখনো মোবাইলে কার্টুন দেখছিল। মিশুক প্রকৃতির শিশুটি হিয়াকে সবাই আদর করছিলেন। হিয়া সবার আদরে সাড়াও দিচ্ছিল।

অবশেষে বরফ গলতে শুরু করে। তবে তা একটি খবরের ওপর ভিত্তি করে। মঙ্গলবার (১৩ মার্চ) রাতে নাবিলার মা নীলা জামান হিয়াকে দাদীর কাছে দিতে রাজি হন। তার ভাষ্য ছিল, আমরা জানতে পেরেছি নাবিলা জীবিত রয়েছে। কাঠমান্ডু মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড টিচিং হসপিটালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। নাবিলার ফুপি ডা. নিলুফার পারভীন মিতুর এক ছাত্রী ওই হাসপাতালের চিকিৎসক। নেপাল থেকে তিনি জানিয়েছেন, আমার মেয়ে এখনও জীবিত। আমরা চাই, নাবিলা ফিরে আসুক। যেহেতু আমার মেয়ে জীবিত আছে, তাই হিয়া তার দাদীর বাড়িতেই থাকবে।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে দাদি বিবি হাজেরা বলেন, তাদের যখন মন চাইবে তখনই হিয়াকে দেখতে আসতে পারবে। আমাদের দরজা তাদের জন্য সব সময় খোলা।

তবে মুখে ইয়াপাখি ডাক নিয়ে নাবিলার ফেরার যে আর কোনও সম্ভাবনা নেই সে কথা নিশ্চিত করেই জানিয়েছে ইউএস-বাংলা। তারা জানিয়েছে, ওই দিনের ফ্লাইটে ইউএস-বাংলার যে চারজন ক্রু ছিলেন তাদের সবাই নিহত হয়েছেন।

নাবিলা ফিরবেন না, কিন্তু ছোট্ট নাবিলার জীবন যাতে যন্ত্রণাযুক্ত থাকে সেটাই কামনা।

সারাবাংলা/এসআর/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন