বিজ্ঞাপন

উপবৃত্তি, মোবাইল ব্যাংকিং এবং কিছু দুঃখের কথা

January 9, 2018 | 12:24 pm

২০০৮ এর জাতীয় নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ দিনবদলের সনদ নামে একটা ম্যানিফেস্টো জনগণের সামনে পেশ করলো। তাতে বলা হল, ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীতে তারা বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চায়। ইলেকশন হল, আওয়ামী লীগ একধরণের ল্যান্ডস্লাইড বিজয় নিয়েই সরকার গঠন করলো।

বিজ্ঞাপন

ঘটনা হচ্ছে, এই ডিজিটাল শব্দটা ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করলো চারপাশে। ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দুভাবেই, তবে জাতি হিসেবেই আমরা যেহেতু ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ পছন্দ করি তাই সরকারের কোন একজায়গায় গাফিলতি পেলেই তার নামের আগে ডিজিটাল জুড়ে দেয়া শুরু হল। ডিজিটাল দুর্নীতি, ডিজিটাল মারামারি এইরকম আর কি।

তো মেঘে মেঘে অনেক বেলা গেল। সময়টা ২০১৮, দ্বিতীয় মেয়াদের ক্ষমতারও শেষ বর্ষে আওয়ামী লীগ। প্রশ্ন হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশের যে স্বপ্ন তারা দেখিয়েছিল, কি অবস্থায় আছে সেটা?

প্রথম কথা হচ্ছে, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিষয়টা কি? নানা মুনির নানা মত থাকতে পারে, আমার কাছে মনে হয়, ডিজিটাল বাংলাদেশ হচ্ছে নাগরিক যত সুযোগ-সুবিধা আছে সেগুলো মানুষের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক ঝুটঝামেলা ছাড়াই তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া। চিন্তা করে দেখেন, যে আপনি জ্যামে বসে ঘন্টার পর ঘণ্টা কাটাতেন, আজ “পাঠাও” এর কল্যাণে সেই জ্যামকেও জয় করা গিয়েছে। রাতের বেলা এয়ারপোর্টে সিএনজি বা গাড়িভাড়া করতে গেলে, একে তো ভাড়া বেশি চাইতো আর সাথে নিরাপত্তার অভাব তো ছিলই। সে সমস্যা পূরণ করে দিয়েছে “উবার”। গার্মেন্টস এর দরিদ্র মেয়েরা দালাল ধরে বাড়িতে তাদের কষ্টার্জিত উপার্জন পাঠাতো। সে টাকার পুরোটা পৌঁছাত না বাড়িতে। আজ “বিকাশ” এসে থামিয়ে দিয়েছে সে দালালদের দৌড়াত্ম। বিকাশের গল্পটা অবশ্য একটু অন্যরকম আরো অনেক কারণেই।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে মোবাইল ব্যাংকিং এর শুরুটা ২০১০ এ। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে ২৮টি ব্যাঙ্ককে মোবাইল ব্যাংকিং চালু করার অনুমতি দেয়। মাত্র ৭ বছরে এই খাতের গ্রোথ দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত মোবাইল ব্যাংকিংয়ের নিবন্ধিত গ্রাহক দাঁড়িয়েছে ৫ কোটি ৭৮ লাখ। এর মধ্যে চালু রয়েছে মানে গত তিনমাসে একবার হলেও কাজ করেছে এমন আছে ২ কোটি ৮০ লাখ অ্যাকাউন্ট। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে অক্টোবরে মোট ২৭ হাজার ৬৩৪ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। অর্থাৎ গত অক্টোবর মাসে দৈনিক গড়ে লেনদেন হয়েছে ৮৯১ কোটি টাকা। আরো অবাক করা ব্যাপার হচ্ছে এই লেনদেনের সিংহভাগ নিয়ন্ত্রণ বিকাশের হাতে। এর কারণ কি?

প্রধান এবং প্রথম কারণ হচ্ছে, বিকাশের ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল। অন্যান্য মোবাইল ব্যাংকিং সেবা মূলত ব্যাঙ্ক এবং এটিএম বুথের উপর নির্ভরশীল ছিল। সে জায়গাটায় সুবিধাবঞ্চিত মানুষের প্রবেশ্যতা ছিল না। কারণ বাংলাদেশ এমন এক দেশ যেখানে আমার দেশের ৮০-৯০% মানুষের ফর্মাল ইকোনমিতে পা ই রাখা হয় নি। বিকাশ এই জায়গাটাতেই অন্যদের চেয়ে ভালো করেছে। দেশজুড়ে ১০০র ও বেশি ডিস্ট্রিবিউটর আর ১লক্ষ ১৭ হাজারের বেশি রিটেইল শপের মাধ্যমে বিকাশ এমন এক নেটওয়ার্ক বানিয়েছে যা ঢাকায় এবং প্রত্যন্ত গ্রামে একইধরনের সেবা নিশ্চিত করেছে। ব্যাঙ্ক বা এটিএম এর বাইরে গিয়ে এই ১ লক্ষ ১৭ হাজার মানুষের ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল তৈরি করা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত দুরূহ একটি কাজ। এ কাজের স্বীকৃতি ও মিলছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বিকাশের গ্রাহক ২১.২ মিলিয়নের কাছাকাছি যা কিনা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ১২.৫% এবং খুব শীঘ্রই এটি গ্রাহক সংখ্যার দিক দিয়ে ফর্মাল ব্যাংকিং খাতকেও ছাড়িয়ে যাবে। গত বছরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোবাইল ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রির ৬২% বিকাশ একা নিয়ন্ত্রণ করছে।

তো এ পর্যন্ত বিকাশের গল্পটা থাকুক। এবার গল্পটা হবে বাংলাদেশ সরকারের একটা প্রকল্প নিয়ে। নামটা সবারই শোনা, উপবৃত্তি কার্যক্রম। মানব সম্পদ উন্নয়নে এযাবৎকালে সরকার কর্তৃক যে সকল গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি গৃহীত হয়েছে, তারমধ্যে উপবৃত্তি প্রদান কর্মসূচি অন্যতম। বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক নারী যারা দারিদ্র্য, বাল্যবিবাহ, আর্থ-সামাজিক ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, ধর্মীয় গোঁড়ামী ইত্যাদি কারণে শিক্ষালাভ হতে বঞ্চিত ছিল বিধায় দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে তাদের যথাযথ অংশগ্রহণ বাধাগ্রস্থ হচ্ছিল। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রায় ১৬ লক্ষ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

আগে আমরা প্রায়ই পত্র-পত্রিকায় দেখতাম, প্রধান শিক্ষক বা প্রশাসনের কোন কর্তাব্যক্তির হাতটানের কারণে সরকারের দেয়া পুরো টাকাটা ছাত্রীদের পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই সরকার নিয়ে এলো মোবাইল ব্যাংকিং। একেবারে স্টেট টু পিপল যাকে বলে। কিন্তু না, এবারও ঝামেলা। সরকার বরাদ্দ দেয় সরকারি ব্যাংককে কিন্ত্য সরকারি ব্যাংকের আবার মোবাইল ব্যাংকিং এ এক্সপারটিজ না থাকায় তারা কাজটা করিয়ে নেয় কোন প্রাইভেট ব্যাংক থেকে, যারা কিনা দরিদ্র ছাত্রীদের পকেট থেকেই সার্ভিস চার্জ এর নামে টাকা বের করে আনছে। যেমন, খবর হয়েছে এই বছরে এই কাজটি পেতে যাচ্ছে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মোবাইল ব্যাংকিং পদ্ধতি রকেট যারা কিনা উপ-বৃত্তির প্রতি এক হাজার টাকা দিতে অন্তত ৯ টাকা চার্জ নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। এর পাশপাশি রয়েছে বৃত্তির টাকা তোলার বাড়তি ভোগান্তি। ভোগান্তির কারণ হল, ডাচ বাংলার এটিএম বুথ বা এজেন্ট এর কাছ থেকে। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে তো এটিএম বুথ বা ডাচ বাংলার এজেন্ট দুটোই দুর্লভ। ফলে, একদিকে সার্ভিস চার্জ এবং অন্যদিকে উত্তোলনে সমস্যা সরকারের এই মহতী উদ্যোগের সাফল্য বাংলাদেশের গ্রামের দরিদ্র ছাত্রীদের পর্যন্ত পৌঁছাতে দেবে না।

অথচ বিকাশ এই সেবাটি দিতে চেয়েছিল বিনামূল্যে, কোন রকম এজেন্ট বা সার্ভিস চার্জ ছাড়া। বিকাশের রয়েছে ১,১৪,০০০ রিটেইল আউটলেট যার মাধ্যমে এরা ছড়িয়ে গেছে বাংলার প্রতিটি পথে প্রান্তরে অথচ গত ২৪ ডিসেম্বর মাধ্যমিক ও উচ্চ-মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের সদ্যবিদায়ী মহাপরিচালক মো. ওয়াহিদুজ্জামান তার অবসরগ্রহণের আগেরদিন এক মিটিং এ রকেটকে এ কাজ পাইয়ে দেবার সিদ্ধান্ত নেন। সে মিটিংয়ে বিকাশের নাম প্রস্তাবই করা হয় নি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে বিকাশ কোন নির্দিষ্ট ব্যাংকের সাথে এফিলিয়েটেড নয়। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি পরিপত্রের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, উপেক্ষা করা হয়েছে ডেপুটি গভর্নর সাক্ষরিত নোটিশ যেখানে ব্যাংকের পাশাপাশি স্পষ্ট ভাষায় মোবাইল ফিনানসিয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, স্নাতক পর্যায়ে উপবৃত্তি বিতরণে ডাচ বাংলা ব্যাংকের অবহেলা এবং অসহযোগিতার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। মূলত, শিক্ষার্থী, শিক্ষক, ব্যাংক এবং প্রশাসনের সমন্বয়হীনতা তৈরি হয়েছে উত্তোলনজনিত জটিলতার কারণে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য সর্বাধিক বিস্তৃত ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেলের অধিকারী এবং মার্কেট লিডার কোম্পানি যখন বিনা পয়সায় দরিদ্র মানুষকে একটি সার্ভিস দিতে চাইছে, সেখানে বিতর্কিত একটি কোম্পানিকে শিক্ষার্থীর বৃত্তির টাকায় ভাগ বসানোর সুযোগ করে দিতে কারা এত উদগ্রীব? মূলত এ গোষ্ঠীটির কারণেই সরকারের বহু উন্নয়ন প্রকল্পের সুফল মানুষ পর্যন্ত পৌঁছায় না। তাই এ বিষয়ে, সরকার এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি কামনা করছি।

শিক্ষার্থীদের বৃত্তি পৌঁছাতে চার্জ চায় রকেট, বিকাশ নেবে না

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন