বিজ্ঞাপন

উড়াও শতাবতী (১২) মূল: জর্জ অরওয়েল, অনুবাদ: মাহমুদ মেনন

July 7, 2018 | 3:13 pm

শুরু থেকে পড়তে>>

বিজ্ঞাপন

সটকে পড়তে আরেক দফা চেষ্টা চালালো গর্ডন। ভয়াবহ দিকটি হচ্ছে তার মন তখন ফ্ল্যাক্সম্যানের সঙ্গে যেতেই বেশি আগ্রহী। দু ঢোক গিলতে পারলে ভালো হতো- আর ক্রিকটন আমর্সের কথা শুনে তৃষ্ণাটা যেন জেঁকে বসেছে। কিন্তু সে জানে এটা সম্ভব নয়। তার পকেট ফাঁকা। সিঁড়ির উপর হাত আগলে ধরলেন ফ্ল্যাক্সম্যান। ‘পালাচ্ছো কোথা চ্যাপ্পি।’ গর্ডনকে তিনি সত্যিই পছন্দ করেন। ওকে বেশ একটু ‘চালাক’ও ভাবেন। ‘চালাকি’ তার কাছে এক প্রশংসাযোগ্য গুণ। তার ওপর একা একা যেতে ভালোও লাগে না। এমনকি পাব পর্যন্ত হেঁটে যাবে, সেখানেও একজন সঙ্গী তার চাই।

‘কাম অন চ্যাপ্পি! এখন কড়া এক গ্লাস বিয়ারই তোমাকে জাগাতে পারবে। সেলুন বারের নতুন মেয়েটিকে তো দ্যাখোনি! পুরো একটা পিচফল!’

‘আর আর সেই জন্যই বুঝি এই সঙ সাজ?’ বললো গর্ডন আর ফ্ল্যাক্সম্যানের রংচঙা সাজ-পোশাকের দিকে আরেকবার ঠাণ্ডা দৃষ্টি বুলিয়ে নিলো।

বিজ্ঞাপন

‘তুমি বাজি লাগতে পারো চ্যাপ্পি! দারুণ একটা পিচ! ছাইরঙা উজ্জল চুল আর গায়ের সেকি রং!’ আর ছেনালিপনাটা ভালোই রপ্ত করেছে। ওকে একটা সেক্সাপিল ন্যাচারটিন্ট দিয়েছিলাম গত রাতে। সে কী ঢঙ্গি তার! আমার টেবিলের পাশ দিয়ে যখন যাচ্ছিলো ছোট্ট পাছাটা যেভাবে দোলালো। আহা যদি দেখতে একবার! বুকটা এখনো ধকধক করছে।’

ফ্ল্যাক্সম্যানের ভঙ্গিতে লালসা যেন ঝরে ঝরে পড়ছে। বার বার জিভ চলে আসছে ঠোঁটের কাছে। এরপর হঠাৎই, গর্ডনের কোমড় জড়িয়ে ধরলো, আর একটা আদুরে চাপ দিলো যেন সে-ই সেই ছাইকেশী বালিকা। এক ধাক্কায় তাকে সরিয়ে দিলো গর্ডন। এক মুহূর্তের জন্য হলেও ক্রিকটন আর্মস তার মধ্যে লোভ জাগিয়ে তুলেছিলো। এক গ্লাস বিয়ারের লোভ তাকেই জয় ফেলেছিলো প্রায়। মনে হচ্ছিলো আহা যদি গলায় একটু ঢালা যেতো। হয়তো যেতোও যদি তার পকেটে পয়সা থাকতো, এমনকি এক গ্লাসের জন্য দরকার সাত পেন্স, তাও যদি থাকতো! কিন্তু কী হবে এসব ভেবে? পকেটে তার মোটেই দুই পেন্স হাফ পেনি। আর আরেকজন আপনার মদের পয়সা দেবে এমনটা হতেই পারে না।

‘আরে ছাড়ুনতো, ঈশ্বরের দোহাই একা থাকতে দিন!’ এই বলে ছিটকে গিয়ে দ্রুত উপরের সিঁড়ি ধরলো। একবারের জন্য ফিরেও তাকালো না।

বিজ্ঞাপন

মাথায় হ্যাটটি ঠিক করে বসিয়ে নিলেন ফ্ল্যাক্সম্যান, আর কিছুটা আশাহত মনে দরজাপথে পা বাড়ালেন। গর্ডনের মন জুড়ে তখন ভাবনা, আজকাল প্রায়শঃ এমনটাই হচ্ছে। বন্ধুত্বগুলোও ধরে রাখা যাচ্ছে না। আর সে জানে পয়সাই এর জন্য দায়ী, স্রেফ পয়সা।

আপনি যে একটু বন্ধুবৎসল হবেন, একটু সভ্যভব্য থাকবেন তারও উপায় নেই যদি কি না আপনার পকেটে পয়সা থাকে। আত্মশ্লাঘার একটা কম্পন বয়ে গেলো তার গোটা শরীরে। তার হৃদয় তখনও ক্রিকটন সেলুন বারের জন্য আনচান করে চলেছে, বিয়ারের আদুরে গন্ধ, মোলায়েম উজ্জ্বল আলো, হৈ-হুল্লুড়ে কণ্ঠস্বরগুলো, গ্লাসগুলোর টুনটান শব্দ। আহা! পয়সা, স্রেফ পয়সা! ভাবতে ভাবতে অন্ধকারাচ্ছন্ন বোঁটকা-গন্ধী সিঁড়ি পথে এগিয়ে গেলো সে।

বাড়ির সবচেয়ে উঁচু তলায় শীতল একাকীত্বের কামরাটি তার ভাবনা জগতে হিম হয়ে জেঁকে বসলো। দ্বিতীয় তলায় থাকেন লোরেনহেম। কালো, কৃষ, সরিসৃপ প্রকৃতির লোকটির বয়স ও বর্ণ কোনোটিই স্পষ্ট করে বোঝার উপায় নেই। ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের দালালি করে  সপ্তাহে ৩৫ শিলিং পকেটে ঢোকে। লোরেনহেমের দরজার সামনেটা একটু দ্রুতই পার হয়ে যায় গর্ডন। লোকটা সেইসব লোকেদের একজন যাদের প্রকৃতপক্ষে গোটা বিশ্বে একটি বন্ধু মাত্র নেই কিন্তু সঙ্গী পেতে তার আকুতির কমতি নেই। এদের মধ্যে লোরেনহেমের একাকীত্ব এতটাই প্রকট যে, আপনি যদি ওর দরজার সামনে গতিটা সামান্য কমিয়ে আনেন আর রক্ষা নেই। নিজেকে আবিষ্কার করবেন রুমের ভেতরে বসে লোরেনহেমের হাতে কত নারী তার কুকর্মের শিকার হয়েছে তার ঘৃণ্য কাহিনী, আর কত চাকরি সে ছেড়েছে ও ধরেছে তার ফিরিস্তি শুনছেন। ওর কামরাটি এতটাই ঠাণ্ডা যে অতটুকু ঠাণ্ডা করে রাখার অধিকারটিও কারও থাকা উচিত নয়। এখানে ওখানে আধা কামড়ানো রুটি আর মারজারিনের টুকরো পড়ে থাকে। বাড়ির আরেক বাসিন্দা প্রকৌশলী গোছের কিছু একটা হবেন, রাতের শিফটেই তার স্থায়ী কাজ। কালে ভদ্রে গর্ডন তাকে দেখেছে বটে- অতিকায় এক ব্যক্তি, নির্মম, বিবর্ণ একটা মুখ। ঘরে বাইরে সবখানেই একটা বোলার হ্যাট পরে থাকেন।

নিজের কামরার পরিচিত অন্ধকারে ঢুকে পড়লো গর্ডন। গ্যাস-জেটটি হাতড়িয়ে আলো জ্বালালো। মাঝারি আকারের কামরাটি কোনোভাবেই পর্দা টানিয়ে দুই ভাগ করার মতো না। আর একটা ত্রুটিপূর্ণ তেলের কুপির পক্ষে এই ঘর পুরোপুরি উষ্ণ করে তোলাও সম্ভব নয়। উপরের তলায় যতটুকু আসবাব রাখার সুযোগ থাকে ততটাই, তার বেশি নয়। সাদা বিছনা পাতা একটি সিঙ্গল খাট, বাদামি রঙা কার্পেটে মোড়ানো মেঝে, হাত ধোয়ার একটি অতিসস্তা বেসিন ও জগ। জানালার ধারে পাতা ঝকঝকে সবুজ রঙা টবে একটি অতি রুগ্ন শতাবতী গাছ। এর বিপরীতে জানালার নিচে, কালি-ঝুলির দাগ পড়া একটি ছোট্ট টেবিল পাতা। এটা গর্ডনের ‘লেখার’ টেবিল। মিসেস উইসবিচের সঙ্গে রীতিমতো লড়াই করে এই কিচেন টেবিলটি সে আদায় করে নিতে পেরেছিলো। বাড়িওয়ালীর ইচ্ছা ছিলো শতাবতীর টবটি রাখার জন্য স্রেফ একটি বাঁশের তৈরি স্ট্যান্ডই এখানে বসতে পারে তার বেশি কিছু নয়। এ নিয়ে এখনো সীমাহীন ঘ্যানঘ্যান করে চলে মিসেস উইসবিচ, কারণ টেবিলটি গুছিয়ে রাখা কোনো দিনই সম্ভব হয়নি গর্ডনের পক্ষে, অগোছালো ভাবটি এর ওপর স্থায়ী রূপ পেয়েছে। উপরে গাদা গাদা কাগজ, অন্তত দুই শত শিট সারমন পেপার যার প্রায় সবগুলোতেই লিখে হয় আড়াআড়ি দাগে কিংবা ক্রস চিহ্নে কেটে ফেলা হয়েছে। গোটা টেবিলজুড়ে নোংরা হয়ে পেপারগুলো ছড়িয়ে, কারো হাত লাগানোর সুযোগ নেই। প্রতিটি কাগজের চাবি গর্ডনের নিজের হাতে সংরক্ষিত। সবগুলোর ওপর ধুলার একটা আস্তর পড়েছে, আর কয়েকটি নোংরা ট্রে ভরে আছে দুমড়ানো সিগারেটের গোড়ায়। আগুনের চুলার ওপর রাখা গুটিকয় বই ছাড়া এই কাগজের স্তুপে ঢাকা পড়া টেবিলটিই এই ঘরে গর্ডনের ব্যক্তিত্বের প্রকাশ।

বিজ্ঞাপন

বাঘের গায়ে লাগার মতো ঠাণ্ডা পড়েছে। গর্ডন ভাবলো তেলের কুপিটা একটু জ্বালিয়ে নেয়। তুলতে গিয়ে কুপিটা বেশ হালকা বোধ হলো- তেল ফুরিয়ে এসেছে- হতে পারে পুরোই ফাঁকা- মানে হচ্ছে শুক্রবার অবধি তেলও মিলবে না। দেয়াশলাই ঠুকে আলোটা জ্বালালো। শলতের চারিদিকে ঘুরে ঘুরে ক্ষীণ একটা আলো জ্বলতে শুরু করলো। ভাগ্য জোরে ঘণ্টা কয়েক জ্বলতে পারে। দেয়াশলাইটা ছুড়ে রাখতেই গর্ডনের চোখ পড়লো ঘাসসবুজ পাত্রের ভেতর শতাবতী গাছটার দিকে। রোগগ্রস্ত নোংরা একটা গাছ। অনেকবার তার ইচ্ছা হয়েছে গাছটিকে মেরে ফেলে। পানি না দিয়ে শুকিয়ে শুকিয়ে মারা। কখনো মনে হয়েছে জ্বলন্ত আগুনের সিগারেট দিয়ে পাতাগুলো পুড়িয়ে দেয়। মোটেই সাতটি পাতা চারিদিকে ঝুলে আছে। নতুন কোনো পাতা গজানোর লক্ষণ কখনোই দেখা যায়নি।

পরের পর্ব>>

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন