বিজ্ঞাপন

এই আমাদের অগ্নিঝরা মার্চ

March 1, 2018 | 9:45 am

অগ্নিঝরা-রক্তঝরা-অশ্রুঝরা-রোদনভরা বাঙালির গৌরবের আবেগময় স্বাধীনতার মাস মার্চ- যা ঋতুরাজ ভরা বসন্ত তথা ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে চৈত্রের মাঝামাঝি পর্যন্ত। মার্চ মাস তথা বসন্ত ঋতুর সাথে বাঙালির আবেগ জড়িত যা বিশ্বের আর কোথাও দেখা যায় না এবং বিশ্বের সকল জাতির কাছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মার্চ শুধু বছরের তৃতীয় একটি মামুলি মাসের নাম- এছাড়া আর কিছুই নয়- কিন্তু বাঙালির কাছে মার্চ (ফাল্গুন-চৈত্র) শুধু একটি মামুলি সাধারণ মাস নয়- এটা অগ্নিগর্ভ উত্তপ্ত মাস, প্রতিবাদের মাস, প্রতিরোধের মাস, স্বাধীনতার মাস, রক্তিম মার্চ, আগুন হাওয়ার মার্চ, অগ্নিস্ফুর্লিঙ্গের মার্চ, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি জেগে উঠার মার্চ, ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠার মাস- এই মার্চ আবহমান বাঙালির বীরত্ব গাথার মর্মবেদনার মাস- এই মার্চ বীরের রক্ত স্রোত, মাতার অশ্রুঝরার মাস। বাঙালির জীবনে আজ নানা কারণে মার্চ মাস অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস।

বিজ্ঞাপন

এই মার্চ ’৭১-এ বাঙালিরা হানাদার বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল। এই মার্চ অসহযোগ আন্দোলনের মাস- বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলার মাস, বাঙালির স্বপ্ন দেখার ইচ্ছার মাস। এই মার্চ বাঙালির স্বাধীনতার অস্তমিত সূর্য পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার মাস।

এই উত্তপ্ত মার্চে জনমহাসমুদ্রে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, শতাব্দীর মহাপুরুষ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা পৃথিবী কাঁপানো ভাষণের টগবগে রক্তে আগুন জ্বলা বজ্র কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” উত্তাল ৭ মার্চে মাত্র ১৯ মিনিটের এই পৃথিবী কাঁপানো বজ্রকণ্ঠের ঐতিহাসিক জ্বালাময়ী ভাষণ ছিল বাঙালির হাজার বছরের আবেগ, হাজার বছরের স্বপ্নের বাণী, হাজার বছরের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন- যা ছিল বাঙালিকে মুক্ত করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

এই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণই বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে-নির্দেশে মুক্তিপাগল বাঙালি জাতিকে হানাদার পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে মহান মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছিল এবং এই ভাষণের মধ্য দিয়েই বাঙালির ভবিষ্যত ভাগ্য স্পষ্ট নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল- ঐতিহাসিক মার্চের এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণটি ছিল একটি নতুন দেশের অভ্যুদয় বার্তা।
এই মার্চ সশস্ত্র প্রতিরোধের মাস- বাঙালির আত্মত্যাগের মাস। এই মার্চে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া প্রকম্পিত করে গর্জে উঠেছিল-
– ‘তোমার দেশ আমার দেশ- বাংলাদেশ বাংলাদেশ’,
– ‘তোমার আমার ঠিকানা- পদ্মা মেঘনা যমুনা’,
– ‘পিন্ডি না ঢাকা- ঢাকা ঢাকা’,
– ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’,
– ‘জয়বাংলা- জয়বাংলা’।

বিজ্ঞাপন

এই মার্চেই গাঢ় সবুজের মধ্যে রক্তিম সূর্য সম্বলিত বাংলাদেশের স্বর্ণালি মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের নতুন পতাকা উড়ানো হয়। এই মার্চেই বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে” গানটি বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং পরবর্তীতে তা পৃথিবীর সবচেয়ে মধুরতম জাতীয় সংগীত হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

এই উত্তাল মার্চ তথা কোকিল ডাকা রক্তিম পলাশ-শিমুল ফোটা মধুর বসন্তের দক্ষিণা বাতাসে জ্বলে উঠেছিল বিক্ষুব্ধ বাংলা বর্ণমালার চার অক্ষরের একটি অতি প্রিয় শব্দ ‘স্বা-ধী-ন-তা’।

এই মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভারি অস্ত্র, ট্যাঙ্ক-কামান নিয়ে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে এ দেশের ছাত্র-জনতাসহ নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে নির্মম গণহত্যায় মেতে ওঠে। অগ্নিঝরা রক্তঝরা উত্তাল অগ্নিগর্ভ এই ঝঞ্ছা-বিক্ষুব্ধ রক্তিম মার্চেই বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছিল এবং শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ- এবং যার ফলশ্রুতিতে আমরা লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে- আর কোটি মানুষের ত্যাগের মাধ্যমে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পেয়েছি।

বিজ্ঞাপন

যার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, আমরা একটি নতুন পতাকা পেতাম না, একটি মানচিত্র পেতাম না, একটি জাতীয় সংগীত পেতাম না- আর এই মার্চ তথা ঋতুরাজ বসন্তেই সেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, শতাব্দীর মহাপুরুষ বাংলার অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

মার্চ মাস বীর বাঙালির জীবনে ঐতিহাসিক ‘অগ্নিঝরা মার্চ’ হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে আছে এবং থাকবে। এই রোদনভরা মার্চ তথা চৈতালি বসন্তেই মহান মুক্তিযুদ্ধে বিপদের বন্ধু একাত্তরের রণাঙ্গনের সহযোদ্ধা ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে আমরা অশ্রুসিক্ত নয়নে ‘যেতে নাহি দিব’ বলে বিদায় জানিয়েছিলাম।

“রোদনভরা এ বসন্ত সখী, কখনো আসেনি বুঝি আগে।/ মোর বিরহবেদনা রাঙালো কিংশুকরক্তিমরাগে।।” -এরকম রোদনভরা এবং জ্বলে উঠা উত্তপ্ত রক্তিম বসন্ত তথা মার্চ মাস যেন বাংলায় আর না আসে।

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা; ২ নং সেক্টর বাঞ্ছারামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন