বিজ্ঞাপন

একটা পরীক্ষা কেন্দ্রের ভেতরে, আরেকটা বাইরে

April 3, 2018 | 5:19 pm

।। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিট্যান্ট এডিটর।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: সোমবার (২ এপ্রিল) সকাল সাড়ে নয়টা। মেঘ ভাঙা রোদে উজ্জ্বল, উষ্ণ একটা দিন। তবে এ উষ্ণতা, উজ্জ্বলতা শুধু সে সব মানুষদের জন্য যারা নিজেরা উচ্চ-মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা দিচ্ছে না, অথবা যাদের সন্তান পরীক্ষার্থী না। যারা পরীক্ষার্থী বা তাদের বাবা-মা তাদের চোখে, মুখে, মনে শুধুই উৎকণ্ঠা।

আমার আজ ডে অফ ছিল। নিজেই ঘাড়ে টেনে নিলাম পরীক্ষার হলের সামনে রিপোর্টিং এর দায়িত্ব। একটা বোর্ড পরীক্ষা মানে জীবনের একটা মাইল ফলক আর মাইল ফলক মানেই হরেক রকম গল্প, এমন গল্পের মেলায় একজন সাংবাদিক কি ঘরে থাকতে পারে?

শুরু করলাম সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজ দিয়ে। এখানে পাশাপাশি দুটি কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী আর ভিকারুননিসা নূন। সিদ্ধেশ্বরীতে সিট পড়েছে আইডিয়াল কলেজের মেয়েদের। ভিকারুননিসা গত দু’বছর ধরে কাউকে তাদের কলেজে সিট দেয় না। মাঝে মধ্যেই কলেজটা এটা করে, পরীক্ষা উপলক্ষে যখন সবার কলেজ বন্ধ থাকে এখানে ক্লাস চলে। আমি নিজেও এই কলেজের ছাত্রী ছিলাম কিন্তু এ নিয়মটা মানতে পারিনি কখনো। এটা আমার কাছে স্বার্থপরের মতো লাগে। মনে হয় যেন অন্যদের বলে বেড়াচ্ছি, দেখো আমরা কত আলাদা!

বিজ্ঞাপন

সিদ্ধেশ্বরী কলেজে সিট পড়া পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে আসা গার্ডিয়ানদের দিয়েই ভরে গেছে এলাকা। কলেজের গেটের ফুটপাথ, গেটের কোণায় লাইট পোস্টের বেদিতে, পাশের ভিকারুননিসার গেটের ফুটপাথ পেরিয়ে ভিকারুননিসা স্কুলের দিকের রাস্তা, নির্মাণাধীন বাড়ির দুয়ার, এটিএম বুথ… যেদিকেই চোখ যায়, শুধু চোখে পড়ে কেন্দ্রের বাইরে অপেক্ষারত মায়েরা, কোথাও কোথাও বাবারা। তবে বাবারা এখানে সংখ্যালঘু। মায়েরাই বেশি।

এলাকাটিতে স্যুয়ারেজ লাইনের কাজ চলছে। কিছু ফুটপাথে গর্ত খোঁড়া। কিছু জায়গায় নর্দমার জলে ভেসে যাচ্ছে। তার মধ্যেই কেউ পেপার বিছিয়ে, কেউ চাদর পেতে বসে পড়েছেন।

শুরু করলাম এখানে থাকা মায়েদের সঙ্গে কথা বলা। আনোয়ারা বেগম ও মুন্নী দুজন চাদর পেতে বসেছেন, সামনে প্লাস্টিকের বাটিতে কাটা পেয়ারা। বেশ গুছিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ডেমরা থেকে রওয়ানা হয়েছি ভোর ছয়টায়, আসতে লেগেছে দুই ঘণ্টা। পরীক্ষা চলবে তিন ঘন্টা বাড়ি ফিরতে আরও দুই ঘণ্টা, এর মধ্যে যদি কোনো কারণে দেরি হয়? তাই সব মিলিয়ে প্রায় ১০ ঘণ্টার প্রস্তুতি।

বিজ্ঞাপন

আফরোজা বেগম এসেছেন মুগদা থেকে। সঙ্গে একটি সাত আট বছরের ছেলে। সেও স্কুলে যায়। তবে আজ বোনের পরীক্ষার জন্য তার স্কুলে যাওয়া হয়নি। কারণ তাকে স্কুল থেকে ফিরিয়ে আনার কেউ নেই অগত্যা তাকেও অপেক্ষা করতে হচ্ছে মায়ের সঙ্গে কেন্দ্রের বাইরে।

কেন্দ্রের চৌহদ্দির মধ্যে কোথাও ছায়া নেই। যদি কেউ ছাতা নিয়ে আসে সেই ছাতাই ভরসা। মেঘ-বাদলার দিন। বৃষ্টির পূর্বাভাসও ছিল সকালে। তবে রক্ষা, বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টি হলে পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে থাকা বাবা-মায়েদের পরীক্ষাটা আরেকটু কষ্টকর হয়ে যেত!

হঠাৎ আমার মনে হল, উনাদের কারও যদি টয়লেটে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, উনারা কই যাবেন? জিজ্ঞেস করলাম কয়েকজনকে, এর জবাব জানেন না কেউই। কেন্দ্রের গেটে থাকা পুলিশদের জিজ্ঞেস করলাম, জরুরি প্রয়োজনে কি কেউ টয়লেটে যেতে পারবেন? জবাব এলো “না, কারও ঢোকার অনুমতি নেই।”

সারাবাংলার সিনিয়র ফটোগ্রাফার হাবিবুর রহমান তাড়া দিলেন, আমাদের যেতে হবে পুরান ঢাকার কেন্দ্রগুলোতে। যদি কোনো খবর মিলে!

বিজ্ঞাপন

পুরান ঢাকায় একটা ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা কেন্দ্র আছে। হ্যাঁ “কেন্দ্র”ই এখানে সবচেয়ে যুতসই শব্দ। মাত্র কয়েক কদমের ব্যাবধানে এতগুলো স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটির নজির পৃথিবীর আর কোথাও আছে কি-না আমার জানা নেই।

গেলাম বাহাদুর শাহ পার্কে। পাশাপাশি তিনটি পরীক্ষা কেন্দ্র, কবি নজরুল কলেজ, ঢাকা মহানগর মহিলা কলেজ ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ। এখানে আরও আছে, চারটা- পাঁচটা স্কুল, আর আস্ত একটা বিশ্ববিদ্যালয়। নামতেই পেয়ে গেলাম গল্প!

কবি নজরুল কলেজের এক ছাত্র যার কেন্দ্র ছিল শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজেটি পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছাতে পৌঁছাতে বেজে গেছে ১০টা তিন। আর ঢুকাও হয়নি তার। দিতে পারেনি পরীক্ষা।

ছেলেটা একাই এসেছে পরীক্ষা দিতে। সঙ্গে কেউ নেই, না পরিবারের কেউ না কোন বন্ধু। অসহায় ছেলেটাকে দেখে খুব মায়া হলো। কেন এভাবে একটা ছেলেকে একা পরীক্ষা দিতে আসতে হবে? ছেলে বলে কি আজকের দিনটাতেও তার পাশে কাউকে পাওয়া যাবে না? ছেলে বলে কি তার সহায় কারও হতে নেই, তার জীবনে বিপদ নেই? তাহলে কিভাবে তাকে ঘর থেকে একা ছাড়া হয়? আজকের দিনটা কেউ তার পাশে থাকতে পারল না?

সরকারি কবি নজরুল কলেজে মেয়েদের তিনটি কলেজের কেন্দ্র। মূল ফটক তো বটেই পাশে বাহাদুর শাহ পার্কও শত শত অভিভাবকে বোঝাই হয়ে আছে । মাথার উপর তপ্ত রোদ। তার ওপর নেই বসার মতো একটুখানি ফুটপাথও। ব্যস্ত সড়ক, বাস ট্রাক রিক্সা থেকে শুরু করে ঘোড়ার গাড়িও আছে। এর মধ্যে কোনোমতে একটু বসেছেন মায়েরা।

একজন মা সবার থেকে দূরে বসে তসবিহ পড়ছেন। মাথায় লম্বা ঘোমটা। এক কোণায় প্রায় নিজেকে মিশিয়ে বসে আসে আছেন। কথা হলো তার সঙ্গে। এসেছেন গেণ্ডারিয়া থেকে। মেয়ে ফজলুল হক মহিলা কলেজে পড়েন। জবাব দিতে খুব দ্বিধা তার। বোঝা যায়, পরিবারের বাইরে কারও সঙ্গে কথা বলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না তিনি।

আস্তে আস্তে হয় অনেক কথা, তার মেয়ের কথা, তার নিজের কথা। এক পর্যায়ে আমাকেই প্রশ্ন করা শুরু করেন, মা আপনি কত দূর পড়েছেন? মা আপনার বিয়ে হয়েছে? মা আপনি যে চাকরি করেন আপনার স্বামী কিছু বলে না?

একে একে তার প্রশ্নের ইতিবাচক জবাব পাওয়ার পর যেন জোর পায় তার স্বরযন্ত্র। জানা যায়, তার মেয়েটিকে রীতিমতো যুদ্ধ করে লেখাপড়া করাচ্ছেন তিনি। তার ইচ্ছা মেয়ে লেখাপড়া শেষ করবে, চাকরি করবে, নিজের আয়ে চলবে। মেয়ের বাবা চান মেয়েকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে দিতে। কিন্তু তার একরোখা মন, মেয়ে তার পড়বেই।

শুরুতে যে মহিলা কথাই বলতে পারছিলেন না হঠাৎ যেন অনেক শব্দের বর পেয়ে গেলেন। হাতের তসবিহ টানা বাদ দিয়ে বলে উঠলেন, এইখানে বসা খুব কষ্টের, তবে মেয়েটার জন্য বসে আছি। ওর পরীক্ষা, আমারও পরীক্ষা। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমরা যেন পাশ হই।

সারাবাংলা/এমএ/এমএস

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন