বিজ্ঞাপন

‘এখানে মানবতা শুয়ে আছে বড় অসুখে’

January 16, 2018 | 2:23 pm

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: টানা সতের দিন ঢাকার ফুটপাতে পড়ে আছে ছোট্ট শিশু মুবিনুল। নিয়মিত গোসল আর খাবারের অভাবে ফর্সা মুখখানা মলিন হয়ে গেছে। হাত-পায়ের চামড়া খসখসে। পেশির চামড়া কুঁচকানো শুরু করেছে। অথচ এই বয়সে কচি লাউয়ের ডগার মতো তরতরিয়ে বেড়ে উঠার কথা তার। কিন্তু ভাগ্য বড়ই নির্মম। না মুবিনুলের জন্য বরাদ্দ আছে শৈশবের স্নেহ না তার মায়ের কপালে জুটেছে মাতৃত্বের শ্রদ্ধা, এখানে সবাই সমান। এখানে অনাদর অবহেলায় মানবতা শুয়ে আছে বড় অসুখে।

স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের আমরণ অনশনের অষ্টম দিন মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনের সড়কে দেখা যায় এমন অসংখ্য করুণ চিত্র। সারি সারি অসুস্থ শিক্ষকদের দেখে মনে হয় এ যেন লাশের সারি। কোথাও কোথাও দু-একজন হয়তো মাথা তুলে বসে আছেন। তবে তাদের চোখ-মুখের দিকে তাকানো যায় না। মনে হয় যেন এর সেই লাশেরই স্বজন। স্বজন হারানো শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন। এ বড় নির্মম, বেদনা বিধুর দৃশ্য।

মুবিনুল ইসলাম। বয়স খুব বেশি হলে পাঁচ বছর। এই বয়সেই সে চিনেছে ঢাকা শহর, চিনেছে আন্দোলন, চিনেছে অনশন আর সেই সঙ্গে শুনেছে সরকার বলে কেউ একজন আছেন তার কথা। কিন্তু সে সরকারকে দেখা যায় না। দিনরাত তাকে মাইক দিয়ে ডাকলেও তিনি কানে শোনেন না। অসুস্থ মায়ের পাশে বসে এই সতেরো দিনে সে যা বুঝতে শিখেছে তা বোঝার সাধ্য নিশ্চয়ই কোনো মন্ত্রীর নেই, নেই কোনো সরকারেরও।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার বেলা ১১টা। অনশন স্থলের পূর্বদিকে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছেন পটুয়াখালীর বাউফলের শিক্ষিকা জেসমিন বেগম। পাশে তার ৫ বছরের ফুটফুটে শিশু মুবিনুল। হাতে পপকর্নের প্যাকেট খুলে খাচ্ছে। মায়ের হাতে স্যালাইনে সূচ। মা অসুস্থ তা ঠিকই বুঝতে পারে সে। তাই সকাল থেকে খাওয়ার জন্য বায়না ধরেনি শিশুটি। কেবল মায়ের ভ্যানিটি ব্যাগে থাকা পপকর্নের প্যাকেটটি নিয়ে খেতে শুরু করেছে সে।
পাশে শুয়ে থাকা নারীকে দেখিয়ে শিশুটির কাছে জানতে চাওয়া হয়–

প্রতিবেদক : ‘ইনি কে?
শিশু: আমার আম্মু।
প্রতিবেদক: তোমার আম্মুর কী হয়েছে?
শিশু: অসুখ।
প্রতিবেদক: সকাল থেকে কি খেয়েছো?
শিশু: খেয়েছি.ই.ই..( মুখ ফিরিয়ে নেয় শিশুটি)
প্রতিবেদক: রাতে ঘুমাও কোথাও?
শিশু: এইখানে, মায়ের কোলে।
প্রতিবেদক: শীত লাগেনা?
শিশু: না। (এরপর আর কোনো কথা বলেনি সে)

বিজ্ঞাপন

শিশুটির মা জেসমিন বেগমের মুখ চাদরে ঢাকা। কেবল ডান হাতের সামান্য অংশ খোলা। সেখানে স্যালাইনের সূচ লাগানো।

তিনি এ প্রতিবেদকের কাছে বলেন, আজ সতেরোদিন হলো এখানে আছি। এই রাস্তায়ই ঘুমাই। শিশুটিও এখানে আমার কাছে থাকে। খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে জানতে তিনি বলেন, বাড়ি থেকে যে টাকা এনেছিলাম তা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। সকালেতো কোনোদিন খাওয়া হয় না। বাচ্চাটিকে আশপাশের বিভিন্ন হোটেল থেকে সাধ্যমত খাওয়াই।

জেসমিন বেগম বলেন, আজ ১৬ বছর যাবত চাকরি করি। কীভাবে যে আছি তা বলে বোঝাতে পারবো না। বাচ্চার বাবা কী করে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, বাজারে সামান্য মুদি দোকান চালায়। কিন্তু তা দিয়েতো আর পারি না। সংসারে অনেক অশান্তি। আপনাকে আর কী বলবো।

এদিকে, আমরণ অনশনের অষ্টম দিনেও সরকারের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সহায়তা পাননি শিক্ষকরা। চিকিৎসা সহায়তা চেয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সচিব ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত আবেদন করার পরও তাতে সাড়া দেননি সংশ্লিষ্টরা। এতে করে অসুস্থ শিক্ষকদের সারি আরো দীর্ঘ হয়েছে। ১৮৫ জন শিক্ষক অসুস্থ রয়েছেন। যারা অসুস্থ নন তারাও শারীরীকভাবে ভেঙ্গে পড়েছেন। দূর্বলতা কাটাতে তাদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

অবশেষে শিক্ষা সচিব এসে আজ ভাঙ্গান তাদের অনশন। হয়তো আজ শিশুগুলোর মলিন মুখে ফুটবে আনন্দের হাসি

সারাবাংলা/এমএস/এমএ

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন