বিজ্ঞাপন

এতটাই অমানুষ আমরা!

January 21, 2018 | 3:40 pm

প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে কত রকমের খারাপ খবর থাকে। নারী নির্যাতন, শিশু নির্যাতন। সড়ক দূর্ঘটনায় মৃত্যু। এ দেশে হতভাগা নাগরিকের কতভাবেই না মৃত্যুবরণ করতে হয়। রাস্তায় চলতে গিয়ে গাড়ির ধাক্কায়, কারও সাথে বিবাদে জড়িয়ে মৃত্যু, বন্যার পানিতে ডুবে মৃত্যু, গুম হয়ে মৃত্যু, পাহার ধসে মাটি চাপা পড়ে মৃত্যু। সম্প্রতি যোগ হয়েছে শীতে আগুন তাপাতে গিয়ে মৃত্যু।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এমন একটি মৃত্যুর খবর পড়তে হবে বা এ নিয়েও লিখতে হবে এ কথা ভাবিনি কখনও। নিজেকে ধাতস্ত করতেই সময় লেগেছে অনেক। এই সংবাদটি প্রথম দেখলাম আমার ফেইসবুক তালিকায় থাকা একজন বন্ধুর স্ট্যাটাসে। অনেক কাজের চাপে ভুলে গিয়েছিলাম বিস্তারিত জেনে নিতে। কিন্তু মাথা থেকে হারিয়ে যায় নি বিষয়টা। এরই মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ মাধ্যমেও লেখা শুরু হয়েছে।

বলছিলাম সেই ভয়ঙ্কর সংবাদটির কথা যেখানে শব্দদূষণের প্রতিবাদ করায় প্রাণ নিয়ে নিয়েছে একজন ব্যক্তির। পুরান ঢাকার ওয়ারীতে রাতের বেলা কোন এক বিয়ে বাড়ীতে উচ্চ শব্দের গান বাজানোর প্রতিবাদ করায় ৬৫ বছরের এক অসুস্থ ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করেছে বিয়েবাড়ির লোকেরা।

শব্দ দূষণ ঢাকা শহরের একটি নিত্য সমস্যা। রাস্তায় বেরুলেই গাড়ীর অযথা হর্ন আমাদের জনজীবনকে পর্যুদস্ত করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত। শিশুদের জন্য এই হর্ন যেন অভিশাপ হয়ে নেমে আসছে। প্রচুর লেখালেখি হয়েছে, আইনও আছে কিন্তু কে শুনে কার কথা। কেউ কারো তোয়াক্কা করছে না। এই দূষণ নিয়ে যখন লড়াই করে যাচ্ছে নগরের লোকেরা তখন এর মধ্যেই গত কয়েকবছর ধরে যুক্ত হয়েছে পাড়ায় পাড়ায় মাইকের শব্দ দূষণ। কেউ কোন প্রকার আয়োজন করছে মানেই সেখানে মাইক লাগিয়ে গোটা মহল্লার মানুষকে বাধ্য করা হচ্ছে সেই অত্যাচার সহ্য করতে। আছে বাড়ী নির্মান যন্ত্রের শব্ধ। ইট ভাঙ্গার যন্ত্রের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে নগরবাসীর। আমি যে মহল্লায় থাকি সেখানে সারারাত ধরে বিল্ডিং এর কাজের জন্য ট্রাকে করে ইট আসার শব্দ চলে। আগে যে এলাকায় থাকতাম সেখানে একদম পিছনেই লাগোয়া ছিলো একটি গ্যারেজ। সেই গ্যারেজের শব্দে দরজা জানালা আঁটকে রেখেও আমরা কেউ কারো কথার শব্দ শুনতে পেতাম না। অনেক অভিযোগ করেও লাভ হয়নি। শেষ পর্যন্ত বাসা পাল্টে আসি অন্য এলাকায়। কিন্তু বাড়ী নির্মান থেমে নেই কোথাও। আর বাড়ী নির্মান মানেই সেখানে একটা লম্বা সময় ধরে চলে নানা প্রকারের শব্দ দূষণ। কোন বাড়ীতে বিয়ে সাদির আয়োজন মানেই এখন গান বাজনার আয়োজন। বাসার ছাদে চারপাশে উচ্চস্বরে সাউন্ড লাগিয়ে চলতে থাকে সেই আমোদ ফূর্তি। কোথাও আবার তা চলে রাতভর। আশেপাশের অধিবাসীদের কারো কোন অসুবিধা হচ্ছে কি না সে বিবেচনা বা তাদের কাছ থেকে অনুমতি নেবার মত ভদ্রতাটুকুও দেখাচ্ছি না আমরা।

বিজ্ঞাপন

সব ছাপিয়ে আমাদের কদর্যতার এক বিশ্রী উদাহরণ হয়ে রইবে ওয়ারীর নাজমুল হক নামের সেই বৃদ্ধের মৃত্যুর ঘটনাটি। এটি আসলে মৃত্যু নয়, একটি হত্যাকান্ড। পরিকল্পিত হত্যাকান্ড।

জানা যায়, আর কে মিশন রোডের সেই বাড়ীর ছাদে এক হলুদের অনুষ্ঠানে উচ্চস্বরে গান বাজানো নিয়ে শুরু হয় সমস্যা। একই বাড়ীর নাজমুল হক নামে এক ব্যক্তি যিনি ছিলেন বাইপাসের রুগী। প্রচন্ড শব্দের অত্যাচারে তিনি আরো অসুস্থ হয়ে পড়লে তার ছেলে বাবার অসুস্থতার কথা বলে শব্দ কমাতে বলেছিলো। এতেই খেপে গিয়েছিলো বিয়ে বাড়ীর লোকেরা। পরেরদিন সেই ছেলেকে ডেকে নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে যার বিয়ে সে সহ তার আত্মীয় স্বজনেরা হামলে পড়ে প্রতিবাদকারী সেই ছেলের উপর। ছেলেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন হৃদরোগে আক্রান্ত নাজমুল হক। কিন্তু একজন বয়স্ক ও অসুস্থ লোকের তোয়াক্কা না করে তাকেও ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়া হয়। আরো অসুস্থ হয়ে পড়েন নাজমুল হক এবং অবশেষে তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।

কী নিষ্ঠুর আমরা। এ নিষ্ঠুরতার কোন তুলনা হয় না। কোন ব্যাখ্যা দিয়েই একে যৌক্তিকতা দেয়া যায় না। একটি গ্রুপের আনন্দ ফুর্তির জন্য একজন লোকের জীবনটাই নিয়ে নেয়া হলো? এও করতে পারি আমরা? কোন যুগের বাসিন্দা হয়ে যাচ্ছি আমরা যেখানে মানবিকতার লেশমাত্র কাজ করে না। দেশে শব্দদূষন নিয়ে আইনও আছে। আবাসিক এলাকায় কখন কতটা উচ্চতায় মাইক বাজানো যায় সেটারও নিয়ম দেয়া আছে। নেই কেবল জনসচেতনতা আর আইন প্রয়োগকারীদের আন্তরিকতা। এই ধরণের আয়োজনের জন্য সংশ্লিষ্ট থানার অনুমতি নিতে হয় কিন্তু কতজন আমরা সে সম্পর্কে সচেতন আছি বা যারা এমন অনুমতি না নিয়েই দিনের পর দিন এমন অশান্তি সৃষ্টি করে যাচ্ছেন তাদের কয়জনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে? কোন নজির কী দিতে পারি আমরা?

বিজ্ঞাপন

হরহামেশাই ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা পারিবারিক আয়োজনে চলছে এমন কর্মকান্ড। নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চললে কারো অসুবিধা হবার কথা নয়। কিন্তু যারা এমন অনিয়মের মাঝ দিয়ে নিজেদের রাজত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চান তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই সোচ্চার হতে হবে আমাদের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে।

ঢাকা শহরে যারা বাস করে তাদেরকে হাজার সমস্যার মাঝ দিয়েই বসবাস করতে হচ্ছে। রাস্তায় বেরুলে পরিবহনের সমস্যা, নারী নির্যাতনের সমস্যা, সময়মত কাজে না পৌছাতে পারার সমস্যা, যানজটের মত জীবনীশক্তি বিনাশী সমস্যা, ট্রাফিক সিগ্নাল না মেনে বিভিন্ন সময়ে দূর্ঘটনায় আক্রান্ত হবার সমস্যা, বৃষ্টির দিনে জলজটের সমস্যা, ভাঙ্গা রাস্তায় আহত হবার সমস্যা…………। তালিকার অন্ত নেই। বেড়েই চলছে।

এর মাঝেই আমরা নিজেদের খাপ খাইয়ে নিচ্ছি। নিতে বাধ্য হচ্ছি। মানতে মানতে মাথা নত করেই চলছি আমরা। প্রতিবাদ বলতে মাঝে মাঝে কেবল অল্প করে রাস্তায় নামা আর না হয় ফেইসবুকের বুকে চিৎকার করা। আজকাল প্রতিবাদেও ক্লান্তি নেমে এসেছে।

কিন্তু, মানুষ হিসাবে আমরা আসলে কোথায় যাচ্ছি? মানবিকতাকে দিনে দিনে নিজ হাতে হত্যা করে ক্রমেই অমানবিক হয়ে উঠছি আমরা। একদিন সব মানুষকেই মরতে হবে। সে মৃত্যু যেন হয় স্বাভাবিক মৃত্যু। নাজমুল হকের মত এমন মৃত্যুকে ঠেকাতে হবে যে কোন উপায়ে। আর যারা এমন একটি হত্যাকান্ডে জড়িত ছিলো উপযুক্ত শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। আইনের যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে একদিকে অন্যদিকে নাগরিক সচেতনতার জন্য আইনের প্রতি সচেতনতাকেও সামনে আনতে হবে সমানভাবেই।

বিজ্ঞাপন

আর আমরা নাগরিকরা? আমাদের কী মানুষ হিসাবে, সামাজিক জীব হিসাবে কোন দায়িত্বই থাকবে না? আসুন আমরা একটু সমাজ সচেতন হয়, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। মানুষ হিসাবে মানুষের প্রতি মানবিক হই। ব্যক্তি স্বার্থে মানুষ খুনের মত ঘটনাকে ঠেকিয়ে দিয়ে নিজেদেরকে সত্যিকারের “মানুষ” হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার শিক্ষা নেই। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকেও একই শিক্ষা দেই। আমরা একটি মানবিক সমাজ বিনির্মানে নিজেকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ করি।

 

সারাবাংলা/এসএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন