বিজ্ঞাপন

‘ওদের নিয়ে আমরা গর্বিত’

January 26, 2018 | 4:52 pm

জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

ঢাকা : বাসায় ঢুকে বড় ছেলেকে বললাম, আমাদের রাফির আঁকা ছবি ছাপা হয়েছে। আমার ছেলে উত্তর দিল, ‘দেখো- আম্মু, কী রাফি কী হয়েছে।’ ছেলের দিকে তাকিয়ে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। পরে রাফির আঁকা ছবি ওর বাবা, দাদু, চাচা-বাড়ির সবাই দেখল, সবাই অনেক খুশি। আমরা সবাই আনন্দে কাঁদলাম-‘আমাদের রাফি অনেক বড় কিছু করেছে, এটাই কেবল মনে হয়েছে।’

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন ছেলে আব্দুর রাফিকে নিয়ে মা হুরাইন আক্তার নয়ন যখন এসব কথা বলছিলেন, তখন তিনি জোর করে কান্না চেপে রেখেছেন। অথচ চোখের ভেতরটা ভরে আছে খুশির পানিতে, কেবল মনের শক্ত নিয়ন্ত্রণে সে পানি ঝরে পড়ছে না। কারণ, এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথার শুরুতেই বলা হয়েছিল, এত আনন্দের খবরে যেন কেউ চোখের পানি না ফেলেন।

বিজ্ঞাপন

রাফির মায়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন এর পরিচালক মারুফা হোসেনের কক্ষে বসে। রাফির মা যখন কথা বলছিলেন, সেখানে উপস্থিত সবাই হয়ত সেই কথাটাই মনে রাখতে চাইছিলেন আপ্রাণ, তাই হয়তো চোখের পানি বাঁধ মেনেছিল।

ভারি কণ্ঠে নয়ন বলেন, অথচ এই রাফিকে নিয়ে যখন গ্রামের বাড়ি গিয়েছি, পাড়া প্রতিবেশীরা আমার নাম ধরে বলেছে, ‘নয়নের ঘরে একটা পাগল হইছে।’, বলছে-‘কোনো সময়ে আমার কোনো অন্যায়ের কারণে এমন ছেলের জন্ম হয়েছে।’ অথচ আমার সেই ছেলের আঁকা ছবি আজ ছাপা হয়েছে-এটা আমার জন্য, আমার পুরো পরিবারের জন্য কতটা আনন্দের, সেটা বাইরের কেউ বুঝবে না-আসলে তাদের বোঝার কথাও না।

রাফিকে নিয়ে পরিবারের এই আকাশ ছোঁয়া আনন্দের কারণ রাফির আঁকা ছবি স্থান পেয়েছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের নতুন বছরের ডেস্ক ক্যালেন্ডারে। কেবল রাফিই নয়, স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন স্কুলের আট জন বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুর আঁকা ছবি দিয়ে সাজানো হয়েছে ক্যালেন্ডারের পাতাগুলো।

বিজ্ঞাপন

ছবি আঁকানো আট শিল্পী হলো— সাত বছরের আবরার সাফওয়ান, ১০ বছরের আব্দুর রাফি এবং সিয়াম আহমেদ, ১১ বছরের ইব্রাহীম খলিল, ১৩ বছরের আশহাব মুনঈম চৌধুরী ও উল্লাস কুমার সাহা, জমজ দুই বোন ১৮ বছরের রাঈয়ান সাঈদ মাহিতা দূরন্ত ও ফারহান সাঈদ তানিশা অনন্ত।

এই বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন আটশিশুর হাতে আঁকা ছবি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ডেস্ক ক্যালেন্ডারে স্থান পাওয়াতে তাদের পরিবারগুলো বলছে,যে সন্তানদের নিয়ে আমরা বাইরে বেরুতে পারতাম না, নিজেরা লজ্জা পেতাম, লুকিয়ে রাখতাম ঘরের ভেতরে-আজ সে সন্তানদের কারণেই আজ আমরা গর্বিত, ওদের বাবা-মা হতে পেরে আজ আমরা গর্বিত।

অনেক আনন্দ লাগছে, জীবনে এত বড় কিছু একটা পাবো-এটা কোনোদিন ভাবিনি। ছেলেটা কথা বলত না, ডাকলে সাড়া দিত না। কেবল হাতের কাছে যা পেত তাই দিয়ে ছবি আঁকার চেষ্টা করত, খেলার মাঠের বালুতে বাড়ির ছবি আঁকত, মানুষ আঁকত জানিয়ে ফোনের অপরপ্রান্তে চুপ থাকেন ইব্রাহীম খলিলের মা সাবিনা ইয়াসমীন। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ছেলের কথা বলতে গিয়ে কাঁদছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

কথা বলার মাঝে একটুখানি বিরতি নিলেন। সময় নিয়ে তিনি বলেন, আমার সেই ছেলের ছবি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শুভেচ্ছা কার্ডে স্থান পায়, এবার পেয়েছে মানবাধিকার কমিশনের ক্যালেন্ডারে। ছেলেকে নিয়ে কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠানে যেতাম না-কিন্তু সেই ছেলে আমাদের গর্বিত করেছে।

‘এসব শিশুদের মূলধারায় আনতে চেয়েছি। এরা অবহেলিত নয়, অন্য শিশুদের মতো তারা যেন সবধরনের সুযোগ সুবিধা পায় – এ কথা মনে রাখতে হবে’—সারাবাংলাকে বলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক।

তিনি বলেন, বাচ্চাগুলোকে প্রমাট (উৎসাহিত) করতে হবে, যেন তারা আরও ছবি আঁকতে পারে এবং তাদের ছবি যেন অন্যরা কেনেন।

কাজী রিয়াজুল হক বলেন, এসব শিশুদের যে সক্ষমতা রয়েছে সেটি সবাইকে বোঝাতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তার শুভেচ্ছা কার্ডে এসব শিশুর আঁকা ছবি দেন, মানবাধিকার কমিশন ক্যালেন্ডারে দিয়েছি-আমরা একটি বার্তা দিতে চাই যে, অন্য কর্পোরেট প্রতিষ্ঠান যারা আছেন, তারা যেন বিষয়টি অনুভব করেন। এসব শিশুদের যোগ্যতা অনুসারে তারা যেন চাকরির সুযোগ পায়।

ওদের যে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের কোয়ালিটি ( যোগ্যতা) রয়েছে, তাদের সক্ষমতা রয়েছে সে বিষয়কে আমরা তুলে ধরতে চাই মন্তব্য করে কাজী রিয়াজুল হক বলেন, এসব শিশুদেরকে আমরা সম্মানী দেব, কারণ অন্য শিল্পীদের ছবি যদি আমরা দাম দিয়ে কিনতে পারি, তাহলে তাদেরটা কেন নয়। আমরা চাই, এদেরকে কেউ অবহেলা না করুক।

স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন ও তরী ফাউন্ডেশনের পরিচালক (প্রোগ্রাম এবং ট্রেইনিং) মারুফা হোসেন বলেন, যারা আমাদের কাছে ছবি পান, তারা যদি আরেকটু বেশি সময় আমাদেরকে দেন, তাহলে ওরা আরেকটু ভালো করতে পারে। কারণ, এসব শিশুরা তাদের খেয়ালখুশি মতো কাজ করে। এদেরকে  চাইলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা তুলি খাতা দিয়ে বসিয়ে রাখতে পারবেন না।

কিছুটা হতাশা নিয়ে মারুফা হোসেন বলেন, ‘আমাদেরকে তিন থেকে পাঁচ দিন সময় দিয়ে বলা হয়, ছবি পাঠাতে। কিন্তু ছবি তো আর পণ্য নয় যে, আমরা মজুদ রেখে দেই। নানান রকম কাজের ফাঁকে ওরা ছবিগুলো আঁকে। কিন্তু এসব বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের রেসপেক্ট করা দরকার, ওদের মুড রয়েছে কী না দেখতে হবে, ওদের ভালো লাগা-মন্দ লাগাকে আমাদের প্রাধান্য দিতে হবে- এই বিষয়গুলো যদি আমরা মাথায় রাখি তাহলে ভবিষ্যতে আরও ভালো ছবি আমরা ওদের কাছ থেকে পাবো এবং ওরাও আনন্দ নিয়ে সেই কাজটা করবে। কারন, ওরা বিনা আনন্দে কিছু করুক সেটা চাই না।’

এ বাচ্চাগুলো ছবি দিয়ে এত পরিচিতমুখ হয়ে গিয়েছে যে, আমরা স্কুল-কর্তৃপক্ষ হিসেবে খুব গর্ব অনুভব করি— বলেন মারুফা হোসেন।

সবাই আমাদের বলেন, আপনারা এসব বাচ্চাদের নিয়ে অনেক কষ্ট করেন। কিন্তু এটা কষ্ট না-এটা আমাদের আনন্দ। আমরা মনে করি, আমরা ওদের নিয়ে সৌভাগ্যবান। প্রতিদিন স্কুল থেকে এসব বাচ্চাদের নানাকিছু আমাকে আচ্ছন্ন রাখে, প্রতিদিন ভালো লাগা নিয়ে বাড়ি যাই। আমার মনে হয় না, এই ভালো লাগা জীবনে আমি অন্যকিছুতেৃ পাবো।

সারাবাংলা/জেএ/একে

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন