বিজ্ঞাপন

কলরেট বৃদ্ধি: প্যাকেজ-বান্ডলের খরচ বাড়ায় অসন্তোষ

August 19, 2018 | 10:59 pm

।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মাহবুব হাসান সজীব (২৮)। এয়ারটেলের গ্রাহক তিনি। মোবাইল ফোনে কথা বলতে খরচ বাড়ায় ক্ষোভ জানিয়ে সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এয়ারটেলে কথা বলতে আগে আমার ২৮ পয়সা খরচ হতো। সেখানে এখন ৫৫ পয়সা করে কাটছে। খরচ তো এখন আমার দ্বিগুণ হয়ে গেছে।’

মহাখালীতে মুনিহারী দোকান চালায় পিয়াস (২৩) ব্যবহার করেন বাংলালিংকের সিম। একই অপারেটরে কথা বলতে খরচ বাড়ায় তিনিও ক্ষুব্ধ। জানিয়েছেন, মোবাইল ফোনে কথা বলার পরিমাণ কমবে। তার মতো একই ধরনের কথা বলছেন আরও অনেক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীই।

তবে সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ জানিয়েছেন বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের প্যাকেজ ও বান্ডল ব্যবহারকারীরা। গ্রামীণফোনের (জিপি) গ্রাহক শরীফ এম সুমন যেমন বলছেন, ‘জিপিতে ৯৯ টাকা দিয়ে আগে পেতাম ৩০০ মিনিট, আর এখন পাই ১৭৫ মিনিট!’ গুলশানের বাসিন্দা নাশিদ ন্যাশও বলছেন একই কথা।

বিজ্ঞাপন

অধিকাংশ গ্রাহকই বলছেন, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন বিটিআরসি’র মোবাইল কলরেট বাড়ানোর সিদ্ধান্তের খড়গে পড়েছেন তারা সবাই। বিশেষ করে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ তরুণদের মধ্যে যারা বান্ডল বা প্যাকেজ কিনে কথা বলতে অভ্যস্ত, তাদের হিসাবে কথা বলার খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে।

গত ১৩ আগস্ট দেশের সব টেলিকম অপারেটরকে অননেট (নিজেদের মধ্যে) ও অফনেট (অন্য অপারেটরে) ভয়েস কলের রেট মিনিটে ন্যূনতম ৪৫ পয়সা নির্ধারণ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কার্যকর করতে সব অপারেটরকে নির্দেশনা পাঠায় বিটিআরসি। নির্দেশনা পাওয়ার প্রথম দিনেই সব অপারেটর নতুন এই কলরেট কার্যকর করেছে। আর তাতে করেই মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদের খরচ বেড়ে গেছে রাতারাতি।

মোবাইল গ্রাহকরা বলছেন, অপারেটরগুলো নিজ অপারেটরের মধ্যে (অননেট) মোবাইল নম্বরগুলো এফএনএফ বা সুপার এফএনএফ করার সুযোগ দিত। এর ফলে এসব নম্বরে কথা বলার খরচ ছিল ন্যূনতম। বেশিরভাগ অপারেটরের ক্ষেত্রেই তা ছিল ২৫ পয়সা, যা ভ্যাটসহ পড়ত ২৯ পয়সা। এ ছাড়া বিভিন্ন প্যাকেজ বা বান্ডল অফারের মাধ্যমেও কম খরচে কথা বলার সুযোগ করে দিত। বিশেষত তরুণদের মধ্যে এসব প্যাকেজ বা বান্ডল ছিল জনপ্রিয়। তাদের ওপরই কলরেট বৃদ্ধির প্রভাবটা বেশি পড়েছে বলে দাবি তাদের।

বিজ্ঞাপন

গ্রামীণফোনের গ্রাহক রামপুরার বাসিন্দা জাহিদুল আলম জয় সারাবাংলাকে বলেন, ‘সুপার এফএনএফ নম্বরে একসময় ২৯ পয়সা মিনিটে কথা বলা যেত। এরপর তা বাড়িয়ে করা হয় ৩৩ পয়সা। এখন নতুন করে তা ৪৫ পয়সা করা হয়েছে। ফলে প্রতিকলে খরচ বেড়েছে।’

দুয়েকজন অবশ্য অফনেট (এক অপারেটর থেকে অন্য অপারেটরে কল) খরচও অননেট খরচের কাতারে চলে আসায় সন্তুষ্টিও জানিয়েছেন। গ্রামীণফোনের গ্রাহক সায়মন চৌধুরী যেমন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অন্য অপারেটরের কলরেট কমে ৫০ পয়সা হয়েছে। আবার এখন থেকে কোন মিনিট-এসএমএস প্যাক অননেট/অফনেটে কাটবে— সেই চিন্তাও থাকছে না। এই সিদ্ধান্তে আমি সন্তুষ্ট।’ নাজমুল রনি নামের এক গ্রাহকও এ কারণে সন্তুষ্টির কথাই জানালেন। তবে এমন সন্তোষের কথা জানানো গ্রাহকের সংখ্যা কমই পাওয়া গেছে।

এদিকে, অপারেটরগুলো রাতারাতি নতুন কলরেট কার্যকর করলেও সেই সিদ্ধান্তের কথা এখনও অনেক গ্রাহকই জানেন না। অনেকে মোবাইল ফোনে খরচের বিষয়টি খেয়াল করেন না বলেও এখনও বুঝে উঠতে পারছেন না কোন কলে কত টাকা কাটছে। তাছাড়া, সমাজের প্রান্তিক পর্যায়ের যেসব মানুষের হাতে মোবাইল ফোন রয়েছে, তারাও নতুন কলরেটের বিষয়টি ঠিকঠাকমতো বুঝে উঠতে পারেননি বলে জানান।

তবে মোবাইল অপারেটরগুলো বলছে, এসএমএস করে সব গ্রাহককে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে নতুন কলরেটের বিষয়টি। কল সেন্টারগুলোতে কল করলেও বিটিআরসি’র নতুন সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

গ্রামীণফোনের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা সৈয়দ তালাত কামাল সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমদিনেই আমরা সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছি। তবে একই কলরেট হওয়ায় গ্রাহক ও অপারেটর পর্যায়ে কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।’ অন্য এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ব্যান্ডল প্যাকেজে গ্রাহকের খরচ তেমন বাড়ার কথা নয়।’

আর রবি আজিয়াটার মুখপাত্র ইকরাম কবীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আগে ছোট অপারেটররা ক্ষতিগ্রস্ত হতো। নতুন সিদ্ধান্তে বাজারে ভারসাম্য আসবে।’

এক মোবাইল অপারেটরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৬৫ শতাংশ গ্রাহক একই অপারেটরে কথা বলেন, বাকি ৩৫ শতাংশ কথা বলেন ভিন্ন অপারেটরে। গ্রামীণফোনের অননেটে কথা হয় ৯০ শতাংশ। আর অফনেটে ১০ শতাংশ। বাংলালিংক ও রবির গ্রাহকেরা অননেটে কথা বলেন ৭০ শতাংশ, বাকি ৩০ শতাংশ গ্রাহক কথা বলেন অফনেটে। এক কর্মকর্তার কাছ থেকে পাওয়া তথ্যই বলছে, ৬৫ শতাংশ গ্রাহক বা কলে খরচ বেড়েছে। আর কমেছে ৩৫ শতংশের ক্ষেত্রে। আর অফনেটে প্রতি কলে ৩৫ পয়সা কমলেও অননেটে বেড়েছে ২০ পয়সা। সামগ্রিকভাবে এ তথ্যও খরচ বাড়ার আভাস দেয় বলে জানান ওই কর্মকর্তা।

গ্রাহকের খরচ বেড়ে যাওয়া বিষয়ে সারাবাংলার এক প্রশ্নের জবাবে বিটিআরসির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, ‘অননেটের খরচ ২৫ থেকে ৪৫ পয়সা হয়েছে, আবার অফনেটে ৮০ থেকে ৪৫ পয়সা হয়েছে। এতে খরচ বাড়ল কোথায়? একই কলরেট নিয়ে অনেক স্টাডি হয়েছে। আর তারপরই সরকার তা অনুমোদন দিয়েছে।’

জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টিকে একতরফাভাবে দেখলে হবে না। অননেটে চার্জ ২৫ থেকে ৪৫ পয়সা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অফনেটে ৯১ থেকে ৪৫ পয়সা হয়েছে। আমার তো মনে হয় এতে গ্রাহক উপকৃত হয়েছে। এছাড়া আমরা মোবাইল নম্বর পোর্টাবিলিটি (এমএনটি) বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছি। তা করতে হলেও অননেট-অফনেট পদ্ধতি তুলে দিতে হবে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই এই পদ্ধতি রয়েছে।’

এদিকে, খরচ বাড়ায় মোবাইল ফোন গ্রাহকেরা হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার ও ইমোর মতো অনলাইন ভয়েস কলিং সেবাতে আরও বেশি আকৃষ্ট হয়ে উঠবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মোবাইল ফোন গ্রাহক অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মহিউদ্দীন আহমেদ। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে গ্রাহকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে তারা পরে হোয়াটসঅ্যাপপ, ভাইবার ও ইমোতে চলে যাবে। এতে কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে অপারেটররাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’

নতুন এই সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে মহিউদ্দীন আরও বলেন, ‘সাধারণত ৯০ শতাংশ গ্রাহকই অননেটে কথা বলেন। তার মানে অধিকাংশ গ্রাহকের খরচ বেড়েছে। এছাড়া দেশের ৮০ শতাংশ গ্রাহক সাধারণ বা নিম্নবিত্ত শ্রেণির। অর্থাৎ প্রায় ১২ কোটি গ্রাহকের খরচ যদি বাড়ে, তাহলে তা স্বাভাবিকভাবেই জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়াবে।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন