বিজ্ঞাপন

কেন ধর্ম শিল্প নয়? 

October 3, 2018 | 3:16 pm

আমার পূজারও ফুল
ভালোবাসা হয়ে গেছে
তুমি যেনো ভুল বুঝোনা…
মাইকে গান বাজছে। তার মানে পূজা শুরু হয়ে গেছে। দূরে থেকে মণ্ডপের মাইকে সেই চেনা সুর “আমি তার ছলনায় ভুলবো না আ আ আ… ” এবার সন্ধ্যা মুখোপধ্যায়। একে একে মান্নাদে,বাপ্পি লাহেরী, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখার্জি, আশা, লতাসহ কত কত শিল্পী; সাথে বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের কিছু কিছু গান।
আশির দশকে রংপুরের পূজার সকালগুলো কেমন যেন অপরিচিত সৌন্দর্যে আবেগময় ছিল। মনের মধ্যে এক অচেনা আনন্দ বোধ হত। সবচেয়ে কাছের মণ্ডপ ছিলো গুপ্তপাড়ার মোড়ে মূলত সেখান থেকে ভেসে আসা গানেই পূজার আহ্বান জানাতো। ইচ্ছে দেবী মুখদর্শন।
আমার কাছে দুর্গা এক অসম্ভব কাল্পনিক নারীমুর্তি ছিল। অবাক হয়ে দেখতাম দশটা হাত, কী করে ব্লাউজ পরে এতগুলো হাত নিয়ে। আম্মার ব্লাউজ নিয়ে নাড়াচাড়া করি। কোন কোন দিক দিয়ে আরো আটটা হাত হতো যদি এটা দুর্গার ব্লাউজ হতো, তো!
আহা, পরনে জীবন্ত শাড়ি, লাল কাতান। অবাক হতাম। তবে যে দেবীর শাড়ি মাটির হতো বেশি ভালো লাগতো না। মুখশ্রী সুন্দর হলে মন বসতো কখনো । এত দীঘল কালো লম্বা চুল কী যে সুন্দর! অলঙ্কৃত সাজসজ্জা। সবই জীবন্ত হয়ে ফুটে আছে আলৌকিক মনুষ্যরূপ। ইলুশন! তাই হত আসলে। হাতের অস্ত্রগুলোর নাম জানতাম না, কেউ কেউ পাশ থেকে বলত সেখান থেকে শুনে কিছু শেখা ছিলো, যেমন ত্রিশূল, পদ্ম, শঙ্খ, তীর আরো কী কী। কথা যা সত্য, মণ্ডপে দাঁড়ানোর ভঙ্গি এমন ছিল যেন কেউ বুঝতে না পারে আমি হিন্দু নই। মুসলমান বলে যদি কেউ বের করে দেয়। ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত ছিলাম শেষে যদি এই মহান শিল্পদর্শন থেকে বহিষ্কৃত হই।
আমাদের বাসার খুব কাছাকাছি তিন চারটা মণ্ডপ ছিল তার মধ্যে বিশাল আয়োজন হতো বড় গুপ্তপাড়া। সালেমা স্কুলের পাশে। কেন যেন তখন গুপ্তপাড়াকে দুই ভাগে ডাকা হতো, জানা নেই। কাছের মণ্ডপগুলো নিজে নিজে ঘুরে দেখতাম ছোটবেলায়। একটু দুরের মণ্ডপগুলো মামাদেরই বায়না মিটাইতে হত। আম্মার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় মামাদের আশ্রয়ে ঘুরতে যাওয়া। কই তখন তো কোন আপত্তি ছিলোনা এসবে মুসলমান পরিবারগুলোতে? এতো সাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ তো চারুকলা পড়াকালীন সময়ও দেখিনি, কে কারা, কী করে করলো? অথচ আমাদের নাকি শিক্ষার হার বেড়েছে। শুধু অফিস যাতায়াতের জন্যই কি এই শিক্ষাদান? বাঙালি পরিবারগুলো কি করে মধ্যপ্রাচ্য সংস্কৃত ও ফ্যাশনসম্মত হলো। নিজের মাটির অতীত, ধানের গন্ধ, বারো মাসের তেরো পার্বণ ভুলে গেলো কত সহজে। বৈশাখ, জৈষ্ঠ, চৈত্র, নবান্ন নাকি আজকাল কলুষিত।
প্রসঙ্গ পূজা, যাই হোক।
ঘুরে ঘুরে পূজা দেখার প্রথম মজা কোন দেবী কত সুন্দরী। কার শাড়িটি বাস্তব? চোখ ঘুরছে সবার উপর… মাথায় আসেনা কলাগাছও বউ! গণেশ আমার প্রিয়। দেখলেই আদর লাগে, ভুঁড়িতে মাথা দিয়ে হেলান দিতে মন চায়। এখন বুঝি এত সুন্দর সৃজনশীল সৃষ্টি দুটো নেই। মানুষ আর হাতির সমন্বয়ে এই রূপী সৃষ্টি চাট্টিখানি বিষয় নয়রে পাগলা!
সুনয়না দেবীদের চোখের দিকে তাকালে আমি কোথায় যেন হারাতাম। তিনটা চোখ আমাকে ভাবাত বটে কিছুক্ষণ তারপর সুন্দর দু’চোখের পানেই মন কাড়ে। এতো বড় চোখ-চোখের পাতা। মায়াভরা চাহনিতে আমি নিজেই চোখ বড় করে হারিয়ে যাই। বিস্ময় চোখে দেবী দেখতে দেখতে বুঝি আমার নিজের চোখই বড় হয়ে গেছে। খাতার পাতায় পাতায় দেবীর চোখ এঁকে ভরে দিতাম। এত মনোযোগী দর্শনলাভ কী ছবি আঁকতে পারতাম বলেই।

বিজ্ঞাপন

কিছুতেই ছোট্ট মন মেনে নিতে পারিনি মহিষাসুরকে, ওকে দেখলেই আমার মধ্যে দেবীশক্তি ভর করে; মনে হয় আমিও একটি অস্ত্র দিয়ে যদি আঘাত করতে পারতাম। দুষ্টু মোচওয়ালা কোথাকার!
আহ,পূজা দেখা আমাদের কল্পজগতে শিল্পসৃষ্টি। পুজা শিল্পের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।

প্রতিবার পূজা এলে আমার মনের মধ্যে একটি জিনিসের চাহিদা বেকুল করত। সেটা পূজার মণ্ডপ ছাড়া কখনোই পাওয়া যেতোনা। মণ্ডপের মেলা বা ছোট ছোট দোকানপাট আমাকে মরিয়া করে তুলতো। দিনের মধ্যে কতবার যে দৌড়ে দৌড়ে সেখানে যেতাম। কটা টাকা পেলেই হলো। আচার কিনতাম প্যাকেটের; ছোট একটা পিতলের আংটি দিতো বলে। একবার একটা ভাঁজ করা গোলাপি কাগজের কলসফুল জিতেছিলাম, মাটিতে লটারি খেলে। প্রতিটি খোপে রাখা থাকতো আকর্ষণীয় পণ্যাদি। তিব্বত স্নো,সাবান, বাঁশী, পিস্তল, চকলেট কত কী! আসলে ওটা ছিল শিশুজুয়া। হা হা হা! পূজার কত আনন্দ।

ওই কয়েকদিন বাড়িতে মামা চাচা খালা খালু কেউ এলেই কীভাবে টাকা আদায় করা যায় ছাড়া মাথায় কিছুই থাকতো না। মনে মনে মেলায় কোথায় কী দেখেছি তার হিসেব চলে। একগাদা ছোট ছোট মাটির হাঁড়ি পাতিল কেনার বাসনা থাকে, কিনে ফেলিও চুপিসারে এমন অনেক শখের জিনিস।
কিন্তু সেই জিনিসটি? যার জন্য আমি মরিয়া হয়ে উঠি সেটা কিনবো নাহ! কখনো কখনো সেটা কাছের মণ্ডপে না পাওয়া গেলে ছুটে যেতাম আদর্শ পাড়ার আদর্শ স্কুল মাঠের মণ্ডপে। একবার চুরি করে আমি একাই গিয়েছিলাম ওখানে, ওটা আমার সীমানার বাইরে যা আবার আম্মার হাতের থাপ্পড়ের সীমানায় পড়ে। দুই গুপ্তপাড়া খুঁজেও যখন সেই জিনিসটা পেলাম না তখন হেঁটেই চলে যাই আদর্শপাড়া। খুঁজতে খুঁজতে পেয়ে যাই মাটিতে দৌড়াচ্ছে আমার ইন্দুরছানা। মানে খেলনা। হ্যাঁ প্লাস্টিকের এই ইঁদুরটার পিছনে একটা রাবারের লেজমত ছিল যা টান দিয়ে ছেড়ে দিলে সামনে দৌড়াতো। কালো ও খয়েরী দুই রঙের হতো। একটি লেজও ছিলো। ছোট একটা রিং মত ছিল রাবারের মাথায়। ওটা ধরেই দে টান, তো ছুটছে।
জানা নেই, কেন এই খেলনাটার প্রতি আমার ছিল দুর্বোধ্য আকর্ষণ! ঐবেলার ওই জিনিসটা আর এই বেলার আমিতে কোনো মিল নেই। পৃথিবীর সবচেয়ে অপছন্দের প্রাণি বলতেই আমার কাছে ইঁদুর। ইস, থু থু চলে আসে মুখে। কেন মানুষের এমন পরিবর্তন হয়? একটা ইদুর দেখামাত্র একলাফে সর্বোচ্চ যত উর্ধ্বে  ওঠা সম্ভব আমি শিখে গেছি সাথে চিৎকার।
সেই পুজো মণ্ডপ থেকেই ইঁদুরটি আমাকে তাঁড়া করলো। রোজ খুঁজি ঘরের ইঁদুর, প্রাত্যহিক জীবন যেনো বিনষ্ট না হয়, আর এখন পূজা এলে খুঁজি প্লাস্টিক ইঁদুর স্মৃতি, যা থেকে স্মৃতির কষ্ট মেলে শুধু, হারিয়ে যাওয়া আমার রংপুর, আমার পূজা, আমার শৈশব।
আহা পূজো মানেই মাইকে ভেসে আসা সেইসব গান আর আমার একমাত্র খেলনা প্লাস্টিকের ইঁদুর।
কবে যে কোন ইঁদুরে কেটেছে দেশ!
আমাদের চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেনীতে পড়া সন্তানরা কি এভাবে পুজা মণ্ডপ পরিদর্শন করতে পারবে নির্ভীকভাবে এখন এদেশে? হারিয়ে যাবেনা, ধর্ষণ হবেনা, কেউ মারবেনা, ছেলেধরা কিডনি চুরি করে নেবেনা! হবে আর এমন পরিবেশ কোনদিন পূজা মন্ডপ বা মসজিদে?
মুসলিম হিন্দুদের মারবেনা, হিন্দু মুসলিমকে,বৌদ্ধ মুসলিমকে, মুসলিম বৌদ্ধকে কিংবা খৃষ্টান চক্রান্ত বিশ্বময়। নির্লজ্জ রাজনীতিতে মানুষ লোভী, পাপী।
কেন ধর্ম শিল্প নয়?
সারাবাংলা/এসএস

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন