বিজ্ঞাপন

ক্রসফায়ারে হত্যায় কি ধর্ষণ বন্ধ হবে?

April 2, 2018 | 3:40 pm

ধর্ষণের মহামারীতে মানুষ অতিষ্ঠ। মানুষ বিচার চায়। দেখতে চায় ধর্ষকের কঠোর, কঠিন শাস্তি। একদিকে বিচার ব্যবস্থার উপর অনাস্থা, অন্যদিকে নিত্যনতুন ধর্ষণের ঘটনায় আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। আমরা আর মানবাধিকার, অপরাধীরও বিচার পাওয়ার অধিকার এসব শুনতে রাজী নই। ক্রসফায়ারে এক ধর্ষককে হত্যায় তাই স্বস্তি প্রকাশ করছি অনেকে। যারা এযাবৎকালে বিচার বহির্ভুত হত্যার বিরোধীতা করেছি, তারাও অনেকেই এই প্রথমবারের মতো এই হত্যায় সমর্থন দিচ্ছি। ধর্ষণের ভয়াবহতা কতটা সহ্যের সীমা ছাড়িয়েছে, বিচার বহির্ভুত হত্যার এই গ্রহণযোগ্যতাই তার প্রমান।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু শুধু বিচারেই কি ধর্ষণ বন্ধ হবে? জেলাওয়ারী ধর্ষণের ভয়াবহতা খুঁজতে গিয়ে আমার নতুন অভিজ্ঞতা হলো। ভরসা অবশ্যই গুগল। বেশিরভাগ ধর্ষণের খবরই পত্রিকায় আসে না। তবুও যেটুকু আসে সেটাই আমাদের ভরসা। জেলার নাম লিখে ধর্ষণের ঘটনার গুগল সার্চ দিতেই পেলাম ধর্ষণের ঘটনার পাশাপাশি বিচার ও শাস্তির খবর। সবার মতো আমারও বদ্ধমূল ধারণা ছিলো এইদেশে ধর্ষণের বিচার কদাপি হয়। কিন্তু গুগল সার্চ আমাকে নতুন তথ্য দিলো।

“সিলেটে ধর্ষণ” লিখে সার্চ দিতেই ধর্ষণের ঘটনার পাশাপাশি বেরুলো ধর্ষণের দায়ে গ্রেফতার আর বিচারের খবর। যেমন:

সিলেটে ধর্ষণ মামলায় এক তরুণের ৫ বছরের কারাদন্ড (সিলেট টাইমস বিডি, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০১৮)

বিজ্ঞাপন

সিলেটে দুই বোন ধর্ষণ মামলায় পাঁচজনের যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ (কালের কন্ঠ, ২০ আগস্ট ২০১৭)

সিলেটে মা, মেয়ে ও খালাকে ধর্ষণ করে ভিডিও ধারণ, গ্রেফতার ১ (বাংলা ট্রিবিউন, ১১ মে, ২০১৭)

“খুলনায় ধর্ষণ” লিখে সার্চ দিতেই পেলাম –

বিজ্ঞাপন

খুলনায় ধর্ষণ মামলায় পুলিশ কনস্টেবল কারাগারে (ঢাকাটাইমস ২৪, ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭)

খুলনায় ধর্ষণ মামলায় প্রাইভেট শিক্ষকের যাবজ্জীবন (বাংলানিউজ২৪,  ২০ জুন ২০১৭)

খুলনায় ধর্ষণ মামলায় আটক আসামীর বিরুদ্ধে চার্জশিট (বাংলা ট্রিবিউন, ২২ এপ্রিল ২০১৭)

“বরিশালে ধর্ষণ” সার্চ দিয়ে পেলাম –

বিজ্ঞাপন

বরিশালে ধর্ষণ মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন (বাংলানিউজ ২৪ ডট কম, ১৮ এপ্রিল ২০১৬)

বরিশালে ধর্ষণ মামলায় ৩ আসামীর যাবজ্জীবন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৪ জুলাই ২০১৭)

বরিশালে ধর্ষণ ও হত্যা চেষ্টার দায়ে একজনের যাবজ্জীবন (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ০১ ফেব্রুয়ারী ২০১৭)

বরিশালে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে শিক্ষকের সাজা (কালের কন্ঠ, ০৫ নভেম্বর ২০১৬)

“রাজশাহীতে ধর্ষণ” সার্চ দিয়ে পেলাম –

রাজশাহীতে ধর্ষণ মানলায় গ্রেফতার ২ (সমকাল, ১২ ডিসেম্বর ২০১৭)

রাজশাহীতে ধর্ষণ মামলায় যুবক গ্রেফতার (বিডিনিউজ২৪, ১১ অক্টোবর ২০১৭)

রাজশাহীতে ধর্ষণ মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন (রাইজিংবিডি ডট কম, ৩০ মে ২০১৭)

“কুমিল্লায় ধর্ষণ” সার্চের ফলাফল –

কুমিল্লায় ধর্ষণ মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড (দেশে বিদেশে, ২৮ মে ২০১৭)

কুমিল্লায় ধর্ষণ মামলায় দুই আসামী গ্রেফতার (টাইম টাচ নিউজ, ১৯ নভেম্বর ২০১৭)

“ময়মনসিংহে ধর্ষণ” সার্চের ফলাফল –

শিশু ধর্ষণ ও হত্যা মামলায় একজনের ফাঁসি (বাংলা ট্রিবিউন, ০৫ নভেম্ববর ০৫, ২০১৭)

ময়মনসিংহে ধর্ষণ মামলায় একজনের মৃত্যুদন্ড (রাইজিং বিডি ডট কম, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০১৭)

ময়মনসিংহে ধর্ষণ মামলায় দুইজনের যাবজ্জীবন (জাগোনিউজ২৪, ১১ মে ২০১৬)

“চট্টগ্রামে ধর্ষণ” সার্চ দিয়ে পেলাম –

চট্টগ্রামে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগে ৬ জনের যাবজ্জীবন (যুগান্তর, ০৫ জানুয়ারী ২০১৮)

চট্টগ্রামে ধর্ষণ মামলায় দুই যুবকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড (পাঠক ডট নিউজ, ০৩ জানুয়ারী ২০১৮)

এভাবে প্রতিটি জেলার নামে সার্চ দিলে অন্ততঃ দুটো বিচারের খবর পেয়েই গেলাম। ধর্ষণের সংখ্যার তুলনায় এই বিচার অবশ্যই অপ্রতুল। তবু বিচার যে হচ্ছে তাতে সন্দেহ নেই। এই প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ যুক্ত হলো ক্রসফায়ারে ধর্ষক হত্যা।

আমরা আনন্দিত হচ্ছি ঠিকই, কিন্তু বিচার বহির্ভুত হত্যা বিচার বহির্ভুতই। দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা, ঘাপটি মেরে থাকা ধর্ষকদের এই ক্রসফায়ারের সাথে তাদের অপরাধের দুইয়ে দুইয়ে চার হিসাব মিলাতে পারার কোন কারণ নেই।

ক্রসফায়ারে হত্যায় আমরা সাময়িক স্বস্তি পেতে পারি, কিন্তু তাতে আসল সমস্যার সমাধান হবে না। কারণ সব ধর্ষণ প্রকাশ্যে হয় না। সব ধর্ষণের খবর প্রকাশিতও হয় না।  সব ধর্ষক ধরাও পড়ে না।  সব ধর্ষক ধর্ষণ শেষে মেয়েটাকে শারীরিকভাবে মেরেও ফেলে না। কয়টার বিচার করবে রাষ্ট্র?

শুধু বিচার নয়, মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। যে ধর্ষণ করছে- তার এবং যে ধর্ষণের কারণ হিসেবে নারীর পোশাক, চলাফেরা, ইত্যাদি ইত্যাদিকে দায়ী করছে- তার। যে ধর্ষণকে নারীর সম্ভ্রমের সাথে জুড়ে দিচ্ছে- তার, যে মনে করে ধর্ষণ নারী ও তার পরিবারের জন্য অসম্মানের- তার। যে ধর্ষণকে লুকিয়ে রাখতে চায়- তার, যে নারীকে ঢেকে রাখতে চায়- তার। যে নারীকে উত্যক্ত করা তার অধিকার মনে করে- তার, যে নিজের পরিবারের বা আত্মীয় ধর্ষককে বাঁচাতে চেষ্টা করে- তার।

একটা সাংস্কৃতিক বিপ্লব দরকার। দরকার মেধা ও মননের সঠিক পরিচর্চা। দরকার সুস্থ বিনোদনের সুযোগ। দরকার সুশিক্ষা। দরকার ধর্ষণের কারণ হিসেবে নারীর পোশাককে দায়ী করার মানসিকতার পরিবর্তন। দরকার আগাছার মতো যত্রতত্র ধর্মের নামে মাইক বাজিয়ে নারীকে অবমাননা করার চর্চা বন্ধ করা। দরকার নারীকে পন্য হিসেবে ব্যবহার করার এবং নারীর নিজেকে পণ্য মনে করার মানসিকতার পরিবর্তন। দরকার আমাদের গা বাঁচিয়ে চলার নীতির অবসান।

ধর্ষণের বিচার হোক, কঠোরতম বিচার হোক। তার আগে আমরা নিঃশর্তভাবে ধর্ষণকে ‘না’ বলতে শিখি।

 

 

[রোকেয়া সরণি কলামে প্রকাশিত লেখা লেখকের নিজস্ব মতামত]

 

সারাবাংলা/এসএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন