বিজ্ঞাপন

গণপরিবহন বন্ধ, ভোগান্তিতে সাধারণ মানুষ

August 3, 2018 | 9:37 pm

।। রাজনীন ফারজানা ।।

বিজ্ঞাপন

সকাল থেকে গণপরিবহন বন্ধ- এ খবর সবাই জানি। কিন্তু সেটা বন্ধ হওয়ার পরিণতিতে কী পরিমাণ ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে তা রাস্তায় না বের হলে বুঝতেই পারতাম না।

আজ ইচ্ছা ছিল প্রেস ক্লাবের সামনে হওয়া মানববন্ধনে গিয়ে তারপর অফিস আসব। কিন্তু  সকাল থেকেই পাঠাও রাইড পাচ্ছিলাম না। দু’টো রাইড পেলেও তারা ফোনে কথা বলেই দিলো ক্যানসেল করে। তখন বাধ্য হয়ে রামপুরা ব্রিজমুখী একটা লেগুনাতে উঠে পড়লাম।

বনশ্রী মেইন রোডে দেখি কোনো বাস চলছে না। রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত আসতে আসতে দেখলাম রাস্তায় লেগুনা, প্রাইভেট কার, ফুয়েল ট্যাংক, বাইক, সিএনজি- সবই আছে। আর আছে রিকশা, অসংখ্য রিকশা। অগতির গতি রিকশাই আজ গণপরিবহনের অভাব ঘোচাচ্ছে। বনশ্রী মেইন রোডের মাথায় যেখানে ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনারের কার্যালয়, সেখান থেকে শুরু করে টিভি সেন্টারের গেট পর্যন্ত অসংখ্য রিকশা। আবার রাস্তার ওপারে ইউলুপের নিচ থেকে রামপুরা ব্রিজের মাঝ পর্যন্তও রিকশার সারি। ঠিক বাসের হেল্পারদের মত তারাও ডাকছে, এই বাসাবো, খিলগাঁও, রেলগেট, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ যাবেন নাকি?

বিজ্ঞাপন

রাস্তার এপার-ওপার চারদিকেই কড়া রোদ মাথায় করে মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কোনো বাস নেই। একজন পথচারী জানালেন, দু’দিন হলো এই এলাকার বাস সব বন্ধ। তাই বাধ্য হয়ে হেঁটেই বাড্ডা থেকে রামপুরা যাচ্ছেন।

নিউজ লিখব ভেবে ছবি তুলছিলাম রাস্তার। তাই দেখে এগিয়ে এলেন একজন পুলিশ কর্মকর্তা। এসেই জেরা, ‘কার ছবি তুলছেন, কেন তুলছেন’ ইত্যাদি। বললাম, গণপরিবহণ বন্ধ, তাই পাবলিকের ভোগান্তির ছবি তুলি। এতে তার অবিশ্বাসে কুঁচকানো ভ্রু সোজা হয় না। কথা না বাড়িয়ে গলায় ঝোলানো প্রেস কার্ড দেখালাম। প্রেস কার্ডের এপিঠ ওপিঠ উল্টেপাল্টে দেখে বললেন, ‘ছবি তুইলেন না।’ আমি উল্টে জানতে চাই, ‘এখানে এত পুলিশ কেন? ইস্ট ওয়েস্টের শিক্ষার্থীরা তো দেখি বের হয়নি আজ।’ উনি বললেন, ‘আন্দোলন তো শেষ। খালি খালি বের হবে কেন? দাবি তো সব মেনে নিছে সরকার।’ বললাম, ‘আন্দোলন শেষ বুঝলাম, কিন্তু গাড়ি তো চলছে না। আমি তো গাড়ির অভাবে গণভোগান্তির নিউজ সংগ্রহ করছি।’ ভদ্রলোক তবুও আমাকে পুলিশ বক্সের আশপাশে দাঁড়ানো কিংবা ছবি তোলার জন্য নিষেধ করে চলে গেলেন।

আর কী করা, আমিও ব্রিজের ওপর বাসগুলোর টিকেট কাউন্টারের দিকে হাঁটা দিলাম। বনশ্রী প্রান্তে কোনো কাউন্টার নেই। একজন বলল, রাস্তার ওপারে কাউন্টার। সেদিকে তাকিয়ে দেখি একগাদা পুলিশ। তাও রাস্তা পার হয়ে গেলাম ওপারে। সেখানে ফুটপাথে বসে থাকা চা সিগারেট বিক্রেতা জানালেন, দুই দিন হলো কাউন্টার বন্ধ। বাস চলে না। তবুও অনেকে সেখানেই কোনো একটা পরিবহনের আশায় ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছেন।

বিজ্ঞাপন

তাদের একজন কোহিনূর বেগম। স্বামী ও সন্তানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গন্তব্য উত্তরা। এসেছেন নন্দীপাড়ার নাসিরাবাদ থেকে। এপর্যন্ত লেগুনায় আসলেও দেড় ঘণ্টা ধরে রামপুরা ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু কিছুই পাচ্ছেন না।

জিজ্ঞাসা করলাম, বাস যে নাই রাস্তায়, এ খবর দেখে বের হননি সকালে। বললেন, দেখেছেন; কিন্তু শাশুড়ি হজে যাবেন ৬ তারিখে (৬ আগস্ট)। তাই আজ না গেলেই নয়। ছেলের স্কুল যে আজই ছুটি! কীসে যাবেন- জিজ্ঞাসা করতে বললেন, ‘এতক্ষণ ধরে ট্যাক্সি খুঁজতেছি, কিন্তু পাইতেছি না। যাও বা সিএনজি দুয়েকটা পাইতেছি, এত বেশি ভাড়া চাইতেছে যে যাওয়ার উপায় নাই।’ আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারাও হয়তো বেশি ভাড়া দিয়েই সিএনজি নিয়ে উত্তরা যাবেন শেষ পর্যন্ত।

শুধু সিএনজি নয়, সুযোগ বুঝে আজ দাম চড়িয়েছেন রিকশাওয়ালারাও। দরদাম করে না পোষানোয় একেকজন ব্যাজার মুখে দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তার পাশে। হাতিরঝিলে অবশ্য বাস আর নৌযান- দুই-ই চলছে। তবে দুপুরে ঘণ্টাখানেক লাঞ্চ ব্রেক থাকায় সেখানেও যাত্রীদের ভিড়। অনেকেই বাইক কিংবা কারে টাকার বিনিময়ে হাতিরঝিল পার করে দিচ্ছেন।

রামপুরা, বনশ্রী, আফতাবনগর আর আশপাশের এলাকা থেকে উত্তরা, শাহজাদপুর, বারিধারা, বসুন্ধরা আর এদিকে ধানমন্ডি, যাত্রাবাড়ী, সদরঘাট, নিউ মার্কেটগামী যাত্রীরা ঝামেলায় পড়ছেন। অল্প দূরত্ব হেঁটে যাওয়া গেলেও বেশি দূর হলে এই রোদে দিনের বেলা হাঁটাও কষ্টকর। বিশেষত শিশু ও বয়স্কদের দুর্ভোগ সীমাহীন।

বিজ্ঞাপন

পুরো পরিবার নিয়ে জরুরি প্রয়োজনে শাহজাদপুর যাওয়ার জন্য আজিমপুর থেকে রিকশা করে রামপুরা ব্রিজ পর্যন্ত এসেছেন আশফাক। বললেন, কোনো সিএনজি পাননি, তাই দুইশ টাকা ভাড়া দিয়ে রিকশা নিয়ে এসেছেন এ পর্যন্ত। এখন শাহজাদপুর যাওয়ার রিকশা খুঁজছেন। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সংকটের সমাধান চান তিনি।

এদিকে, অফিসে আসার জন্য রিকশা খুঁজতে গিয়ে ভাড়া শুনে নিজেই দমে গেলাম। অনেক রিকশাচালক তো গন্তব্য শুনেই মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছেন! গতকাল রাতেও রিকশার ভাড়া শুনতে শুনতে অর্ধেকের বেশি রাস্তা হেঁটে বাসায় ফিরেছি অফিস থেকে। আজ পরিস্থিতি আরও খারাপ। রামপুরা ব্রিজ থেকে কাকরাইলের কথা শুনলেই ভাড়া দুইশ টাকা চেয়ে বসছেন একেকজন। কেউ কেউ অবশ্য দয়া করে দেড়শ টাকাও চাইলেন। তাদের চোখেমুখেও বেশ তাচ্ছিল্য। ভাড়া নিয়ে দরাদরির কোনো সুযোগই নেই। আফটার অল, আজ তারাই রাস্তার রাজা। ক্ষমতার এটুকু দম্ভ তো উপভোগ করবেনই। এর মধ্যে অবশ্য একজন পাঠাও রাইডারের দেখাও পেলাম। তবে তিনি অ্যাপসে যাবেন না। এই দুর্যোগে তারও কিছু ভাড়া বেশি চাই।

রাগ করে হাঁটাই ধরলাম। রামপুরা বাজার এসে একজন রিকশাওয়ালা পেলাম, যিনি কাকরাইল পর্যন্ত ভাড়া চাইলেন মাত্র ৬০ টাকা! তাৎক্ষণিকভাবে মনে হচ্ছিল, পৃথিবীতে এখনও এমন দয়াবান মানুষ আছে! পূর্ণিমার চাঁদ পাওয়ার উচ্ছ্বাস যেন তখন। তবে মুখে তা যথাসম্ভব চেপে রাখার চেষ্টা করে উঠে পড়লাম দ্বিতীয় কোনো কথা না বলেই। আসার পথে ফুটপাথজুড়ে হেঁটে চলা মানুষের দীর্ঘ সারি। তাদের কপাল হয়তো আমার মতো ভালো নয়, ৬০ টাকার দয়াবান রিকশাচালক হয়তো জোটেনি তাদের কপালে! কিংবা হয়তো এটুকু রাস্তার জন্য ৬০ টাকা খরচের সামর্থ্যও হয়তো তাদের নেই! তাই শেষতক দুই পায়ের ওপর ভরসা রেখেই চলেছেন যে যার গন্তব্যে।

লেখক: সংবাদকর্মী

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন