বিজ্ঞাপন

গর্ভবতীর জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ঢাকা, এ শহর মাতৃত্বের নয়

May 28, 2018 | 6:39 pm

। মাকসুদা আজীজ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর।

বিজ্ঞাপন

আজ ২৮ মে, নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস। বছর ঘুরে এই দিনটি আসে বারে বারেই। সভা- সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠক, সচেতনতা কর্মসূচী সবই হয়। কিন্তু এই সবের ফলাফল কতখানি দৃশ্যমান, কতখানি ফলপ্রসু তা আর জানা হয়না কারোই।

দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট বিভাগের সূত্রে জানা গেছে মাতৃস্বাস্থ্য, নিরাপদ প্রসব, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সেবার গুণগত মান বাড়ানো সম্পর্কে মা, পরিবার ও সমাজের সকল স্তরে সচেতনতা বাড়ানো এবং সকলের প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করাই এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে বাংলাদেশের মাতৃত্বকে নিরাপদ করার চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।

বিজ্ঞাপন

বরাবরের মতো এবারও দিবস উপলক্ষ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি  লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছে। এতে বলা হয়েছে, এখন দেশে শিশু মৃত্যুর হার হাজারে ২৯ জন, মাতৃমৃত্যুর হার হাজারে ৭০ জন। নিরাপদ মাতৃত্বের জন্য পুষ্টির যোগান, চিকিৎসা দেওয়ার পরেও অনিরাপদ থেকে যাচ্ছে নারীর মাতৃত্বের যাত্রা। এর মূল কারণ যাত্রাপথই মসৃণ নয়, নেই শিশুদের নিয়ে চলাচলের সুব্যবস্থা, মাতৃদুগ্ধ পানের যথোপযুক্ত স্থান।

সম্প্রতি দেশের অন্যতম অনলাইন প্লাটফর্ম সারাবাংলা রাজধানী ও দেশের সবচেয়ে বড় শহর ঢাকার ২৯ জন অন্তঃসত্ত্বা ও প্রসূতি কর্মজীবী নারীর সঙ্গে কথা বলেন। এই নারীরা ২০১২ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ঢাকার ভিন্ন ভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।

বিজ্ঞাপন

এই নারীদের মধ্যে ১৩ জন নারী ভাঙ্গা রাস্তা, জ্যাম অথবা দুর্ঘটনার কারণে গর্ভাবস্থায় চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। ৮ জন নারী রাস্তার সমস্যার জন্য তাদের গর্ভপাত অথবা গর্ভাবস্থায় শিশুমৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেন। এই ৮ জন নারী দ্বিতীয়বার যখন গর্ভধারণ করেছেন প্রত্যেকেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে, কেননা তারা আবার গর্ভপাতের ঝুঁকি নিতে চাননি।

২৯ জন নারীর প্রত্যেকেই জানিয়েছেন তারা রাস্তায় দীর্ঘ জ্যামে অসুস্থবোধ করতেন, এবং তারা গর্ভপাতের আশঙ্কা করতেন।

এই জরিপকালে সারাবাংলারা কাছে তিনজন নারী জানিয়েছেন তারা মগবাজার-মালিবাগ ফ্লাইওভারের কাজ চলাকালে ভাঙ্গা রাস্তা ও দীর্ঘ জ্যামের কারণে চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন। একজন জানান, তিনি চাকরি ছাড়তে চেয়েছিলেন কিন্তু তার তৎকালীন কর্মস্থল তাকে বাসায় বসে কাজ করার অনুমতি দেয়। এরপরও তিনি চাকরি চালিয়ে যান তবে এর বৈরী প্রভাব তার ক্যারিয়ারে পড়ে বলে তিনি মনে করেন।

সারাবাংলার জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের দশম সর্ববৃহৎ জনসংখ্যার শহর ঢাকা মাতৃত্বের জন্য ভীষণ রকমে ঝুঁকিপূর্ণ। মাতৃত্বের যাত্রা নিরাপদ রাখতে চাকরি ছেড়ে দেন অনেক অন্তঃসত্ত্বা নারীই। যারা চাকরি চালিয়ে যান তারাও থাকেন ভীষণ মানসিক টানাপড়েনে।

বিজ্ঞাপন

ফারজানা বৃষ্টি, কাজ করতেন একটি বেসরকারি সংস্থায়। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তিনি পড়েন একটি দুর্ঘটনায়।

দুর্ঘটনার ঘটনাটি বলতে বলতে শিউরে ওঠেন ফারজানা, “আমি বাসের ইঞ্জিনের ওপর মহিলা সিটে বসেছিলাম। সেখানেই বসে আমি দেখলাম বাস একটা রিক্সাকে ধাক্কা দিল। রিক্সার আরোহীরা ছিটকে পড়লো। আর সঙ্গে সঙ্গেই চলন্ত অবস্থায় ড্রাইভার বাস থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে গেল। চালকহীন অবস্থায় বাসটা কিছুক্ষণ চলে সামনে একটা দেওয়ালে গিয়ে ধাক্কা খেলো। সামান্য আহত হই আমি। তবে এই দৃশ্য আমাকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে দেয়। ঘটনার পাঁচদিন পরে আমি চাকরিটি ছেড়ে দেই।”

নিলুফার চাকরি করতেন একটি আন্তর্জাতিক সংস্থায়। তার কাজটিই ছিল মাঠ পর্যায়ে। অফিস থেকে যানবাহনও দেওয়া হতো। নিলুফার বলেন, “আমাকে গবেষণাক্ষেত্রে যেতে হলে যাত্রাবাড়ির রাস্তা পার হতে হতো। সেখান থেকে গাড়ি যখন চলত, আমার মনে হতো যেন আমি উত্তাল সমুদ্রে নৌকা করে যাচ্ছি। গাড়ি একবার ওপরে উঠতো আবার খাদে পড়ত। গর্ভধারণের পর মাত্র ৭ সপ্তাহে আমার রক্তক্ষরণ হয়। সেই যে আমি ছুটি নেই আর জীবনেও আমার কাজে ফিরে যাওয়া হয়নি।”

একটি টেলিযোগাযোগ সংস্থায় কাজ করতেন ইভা তালুকদার। তিনি চাকরি ছাড়েন রাস্তার জ্যামের কারনে। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, “অফিস করতাম আট ঘণ্টা এরপর দুই, দুই চারঘণ্টা পথে। এত লম্বা সময় বসে থাকতে হতো জ্যামে। দীর্ঘ সময় জ্যামে বসে থাকতে খুব কষ্ট হতো।”

“জানেন, এখন খুব আফসোস হয়। আমার সঙ্গে যারা চাকরি করতেন তাদের অবস্থান এখন বেশ ভালো। আমিও যদি চাকরিটা ধরে রাখতে পারতাম তাহলে আমিও সেখানে পৌঁছাতে পারতাম। কিন্তু আমি এখন ফুল টাইম হাউসওয়াইফ”, আক্ষেপ ইভার।

রাবেয়া বসরি কাজ করতেন একটি সংবাদ সংস্থায়। তিনি যখন গর্ভবতী তখন মগবাজার মৌচাক ফ্লাইওভারের কাজ চলছিল। রাবেয়া বলেন, ‘অফিসে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল রিক্সা। খানাখন্দে ভরা রাস্তায় অসহ্য ঝাঁকুনি সহ্য করতে হতো। এই ঝাঁকুনি কারণে চাকরি ছাড়তে ছাড়তে বাধ্য হই।’

একই কারণে চাকরি ছাড়েন শারমীন নাহার। বলেন, ‘বাসে করে গেলে ঝাঁকুনি খুব একটা টের পাওয়া যেত না তবে বাসে সবসময় জায়গা পাওয়া যেত না। আর কাটা রাস্তার জন্য জ্যাম হতো অনেক। এত দীর্ঘ সময় বসে থাকতে কষ্ট হতো। তাই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হই।’

বিষয়গুলো নিয়ে কথা হয় প্রসূতি ও ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ ড. সানজিদা খানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘ঢাকার যে পরিস্থিতি তাতে পাবলিক ট্রান্সপোর্টের ধাক্কাধাক্কি সহ্য করা একজন অন্তঃসত্ত্বা নারীর পক্ষে খুবই অসম্ভব। এছাড়াও ভাঙ্গা রাস্তার ঝাঁকুনিতে পানি ভেঙ্গে যেতে পারে, রক্তক্ষরণও হতে পারে।

দীর্ঘক্ষণ প্রস্রাব চেপে রাখা একজন গর্ভবতী নারীর জন্য কষ্টকর বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘অথচ ঢাকার রাস্তার দীর্ঘ জ্যাম ও পাবলিক টয়লেটের অপ্রতুলতার কারণে তারা বাধ্য হন প্রস্রাব চেপে রাখতে। এতে গর্ভবতীদের প্রস্রাবের রাস্তায় ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়। যার কারণে অপরিপক্ক জন্মদান (সময়ের আগেই জন্মদান) এবং স্বল্প ওজনের শিশু জন্মের ঘটনা ঘটে।’ উল্লেখ্য জন্মের সময় একটি শিশুর ওজন আড়াই থেকে সাড়ে তিন কেজি হলে তাকে স্বাভাবিক ওজন ধরা হয়।

ওয়ার্লড হেলথ অর্গানাইজেশনের (ডাব্লিউএইচও)  ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক গবেষণা অনুযায়ী অপরিপক্ক জন্মদানের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের সপ্তম দেশ। ২০১৪ সাল থেকে ওয়াটার এইড ও ঢাকা ওয়াসার সহযোগিতায় ঢাকায় গণশৌচাগার (পাবলিক টয়লেট) স্থাপন ও পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু হয়। এর মধ্যে নারীদের জন্য স্থাপন করা হয় মাত্র ২০টি টয়লেট। সে হিসেবে মেগাসিটিতে বসবাসকারী প্রায় ৪ লাখ ৭৫ হাজার হাজার নারীর জন্য মাত্র একটি টয়লেট স্থাপন করা হয়েছে। যা খুবই অপ্রতুল।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়,  এই টয়লেটগুলোর খুব কমই এখন কার্যকর আছে। ২৭মে বেলা আড়াইটায় মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল ও কলেজের উল্টা পাশের পাবলিক টয়লেটটি পাওয়া যায় তালামারা অবস্থায়। এছাড়া রমনার টয়লেটটি সব সময়ই থাকে বন্ধ। সেখানে ঘুমিয়ে থাকে ভবঘুরেরা।

বেসরকারি সংস্থা ‘একশন এইড’ ২০১১ সাল থেকে নিরাপদ নগরী নামে একটি প্রচারণা চালিয়ে আসছে যার উদ্দেশ্য, ঢাকা নগরীতে নারীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা।

সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের নারী অধিকার ও লিঙ্গ সমতা বিশেষজ্ঞ কাসফিয়া ফিরোজ বলেন, ‘২০১৭ সালে একশন এইডের পক্ষ থেকে “কার শহর” নামে একটি গবেষণা চালানো হয়। এতে দেখা যায় নগর পরিকল্পনা এবং নগরের ভবন পরিকল্পনার সময় নারীদের বিষয়টি একদমই বিবেচনা করা হয় না। এছাড়াও এ শহরের গণপরিবহন ব্যবস্থা মোটেই নারী বান্ধব নয়। আর একটি সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, নারীদের বাস করার জন্য, ঢাকা বিশ্বের ৭ম খারাপ শহর।’

একজন সক্ষম স্বাভাবিক নারীর জন্য যদি ঢাকা এতোটা খারাপ শহর হয় একজন গর্ভবতী নারীর জন্য তা কতটা কষ্টকর হতে পারে এটা সহজেই ধারণা করা যায় বলে মন্তব্য করেন কাসফিয়া ফিরোজ।

শুধু গর্ভবতী নারীই নয়। সন্তান নিয়ে চলাচলের জন্যও ঢাকা নিরাপদ নয়। ইশরাত আরা কাজ করেন একটি রাষ্ট্রয়াত্ত্ব প্রতিষ্ঠানে, সেখানেই একটি দিবাযত্ন কেন্দ্রে থাকে তার সন্তান। ইশরাত জানান, অফিস ছুটির পরে সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে তার পোহাতে হয় দারুণ দুর্ভোগ, খরচ বেড়ে যায় চলাচলেরও।

শাহানা মাহমুদ একজন গৃহিনী। তার চার মাসের একটি সন্তান আছে। ঘর থেকে বের হন বাজার করতে অথবা জরুরী কোনো প্রয়োজনে। জানান, বাচ্চাকে নিয়ে যখনই বের হই খুব ভয়ে থাকি। ঢাকায় প্রায় কোথাও সন্তানকে দুগ্ধপানের ব্যবস্থা নেই। এছাড়া ডায়াপার বদলানো ও চলাচলের অসুবিধার কারণে বাচ্চাকে নিয়েই বের হওয়া হয় না তার।

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব আরবান প্ল্যানিংয়ের গবেষক অধ্যাপক আখতার মাহমুদ বলেন, ঢাকা শহরটি নারীর কথা চিন্তা করে, বা তাদের সুবিধা অসুবিধা ভেবে বানানো হয়নি। এখানে কোন রাস্তা কখন সংস্কার হয় তার কোনো সমন্বয় নেই। অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান রাস্তা কাটার কাজ করে ফেলে, আজকে যে রাস্তাটা ঠিক করা হলো তা কালই আবার অন্য কোনো কারণে কাটা হবে না এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।

এছাড়াও এ শহরে নেই পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুটপাথ। যেগুলো আছে সেগুলোও খানাখন্দে ভরা। গণপরিবহণও নারীদের উপযোগী নয়। ফলে নারীরা বাড়িতেই থাকা নিরাপদ মনে করেন। বিশেষ করে সময়টি যদি গর্ভাবস্থার মতো স্পর্শকাতর হয়।

অধ্যাপক আখতার মাহমুদ মনে করেন, পাবলিক বিল্ডিং এবং রাস্তা যারা নকশা করেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে।

এ নগরগবেষক আরো বলেন, আমরা নারীকে কর্মক্ষেত্রে কতটা দেখতে চাই তার উপর নির্ভর করবে শহরটি কতটা নারীবান্ধব হবে। শহরকে নারীবান্ধব করতে হলে এর পরিকল্পনা নারীকে মাথায় রেখে করতে হবে। সেটি প্রয়োগ করতে হবে এবং নিয়মিত তার রক্ষণাবেক্ষণও করতে হবে। তাহলেই শহরটি গর্ভবতী ও মাতৃত্বের জন্য নিরাপদ হবে।

সারাবাংলা/ এসবি

ছবি: আবদুল্লাহ আল মামুন এরিন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন