বিজ্ঞাপন

গাজীপুরে সংঘটিত প্রথম সশস্ত্র  প্রতিরোধ

March 19, 2019 | 2:10 am

।। সুমন ইসলাম।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ১৯ মার্চ, ১৯৭১, বিকেল। শুক্রবার। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গাজীপুরের জয়দেবপুরে। মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে আমাদের চূড়ান্ত স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলেও ১৯ মার্চ জয়দেবপুরের মাটিতেই সূচিত হয় বর্বর পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্বে বীর বাঙালির প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ।

পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষ থেকে গর্জে উঠে বন্দুক। ভাওয়াল রাজবাড়িতে (বর্তমানে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়) অবস্থান নেয় দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের। এ রেজিমেন্টের ২৫-৩০ জন পশ্চিম পাকিস্তানি ছাড়া বাকি সবাই বাঙালি অফিসার-সৈনিক।

একদিকে চলছিল স্বাধীনতার জন্য অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তাও বাঙালিদের চিরতরে দাবিয়ে রাখার জন্য এঁটে যাচ্ছিল ষড়যন্ত্রের নীলনকশা।

বিজ্ঞাপন

সেই ষড়যন্ত্রের একটি অংশ ছিল বিভিন্ন সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙালি অফিসার-সৈন্যদের বিচ্ছিন্ন করে কৌশলে তাদের নিরস্ত্র করা। ঢাকার ব্রিগেড সদর দফতর থেকে নির্দেশ এলো, ১৫ মার্চের মধ্যে রাইফেলগুলো গুলিসহ ব্রিগেড সদর দফতরে জমা দিতে হবে। কিন্তু বাঙালি অফিসার-সৈনিকরা অস্ত্র জমা দিতে অনিচ্ছুক।

ওই সময় ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার পাকিস্তানি এক ব্রিগেডিয়ার নিজেই ১৯ মার্চ দুপুরের জয়দেবপুর সেনানিবাসে উপস্থিত হন। বাঙালি সৈন্যদের পাঞ্জাবিরা নিরস্ত্র করতে এসেছে এ খবর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে।

মুহূর্তে পাল্টে যায় চিত্র। ১০ হাজারের ও বেশি মুক্তিকামী জনতা জড়ো হয় জয়দেবপুর থেকে চৌরাস্তা পর্যন্ত প্রায় ১৫০ টির মত ব্যারিকেড দিয়ে। জনতার হাতে ছিল হাতে লাঠিসোটা। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সেনানিবাসে বসেই এ খবর পান। তিনি ব্যারিকেড অপসারণের নির্দেশ দেন। জনতা ক্ষোভে ফেটে পড়ে, পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার কে স্পষ্ট জানিয়ে দেয় ব্যারিকেড সরানো হবে না। এরপর পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার সামনে বাঙালি সৈন্য ও পেছনে পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে রওয়ানা হন ঢাকার দিকে। কিন্তু ব্যারিকেডের জন্য এগোতে না পেরে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। সেই সময় গুলিতে জয়দেবপুর বাজারে শহীদ হন কিশোর নিয়ামত ও মনু খলিফা। চান্দনা-চৌরাস্তায় প্রতিরোধকালে হুরমত আলী নামে এক যুবক একজন পাকিস্তানি সৈন্যের রাইফেল কেড়ে নিয়ে গুলি করতে চেষ্টা করেন। সে সময় অপর একজন পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে হুরমত আলী শহীদ হন। এ ছাড়া গুলিতে আহত হন ইউসুফ, সন্তোষ ও শাহজাহানসহ আরও অনেকে। এর পরই উত্তাল বাংলায় স্লোগান ‘গাজীপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’

বিজ্ঞাপন

টাঙ্গাইল থেকে রেশন পৌঁছে দিয়ে রেজিমেন্টের একটি তিন টনের ট্রাক জয়দেবপুরে ফিরছিল। এতে হাবিলদার সিদ্দিকুর রহমানসহ ৫ জন সৈন্য ছিল এবং তাদের সঙ্গে ছিল এস এম জি ও চাইনিজ রাইফেল।

জয়দেবপুর কেন্দ্রীয় মসজিদের সামনে আসামাত্র তাদের গাড়ি থামিয়ে জনতা ঘটনা বর্ণনা করে এবং গুলিবর্ষণের অনুরোধ করে। জনতার মনোভাব বুঝতে পেরে  তারা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। এটাই ছিল বাঙালিদের পক্ষ থেকে প্রথম প্রতিরোধ ও গুলিবর্ষণের ঘটনা। পরে পাঞ্জাবি সৈন্যরা ব্যারিকেড অপসারণ করে জয়দেবপুর বাজারে প্রবেশ করে এবং কারফিউ ঘোষণা করে। এখানেই গুলিতে নেয়ামত ও মনু খলিফা শহীদ হন।

পরবর্তীতে জয়দেবপুরের বীর জনতার পথ ধরেই দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংগ্রাম ও বিদ্রোহের দাবানল প্রজ্জলিত হয়ে ওঠে। উত্তাল ১৯ মার্চ কেবলমাত্র একটি তারিখই নয় বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশের স্থান নেওয়ার পথিকৃত অগ্রদূত এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ দিনও বটে। আন্দোলন বেগবান করার জন্য জয়দেবপুরে গঠন করা হয় সর্বদলীয় মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ। এ পরিষদের  ছিল দুটি শাখা। একটি হাই কমান্ড, অপরটি অ্যাকশন কমিটি। হাই কমান্ডে ছিলেন মো. হাবিব উল্লাহ, ডা. মনীদ্রনাথ গোস্বামী ও এম এ মোতালেব।

অ্যাকশন কমিটিতে ছিলেন অ্যাডভোকেট আ.ক.ম মোজম্মেল হক (আহ্বায়ক), মো. নজরুল ইসলাম খান (কোষাধ্যক্ষ), মো. নুরুল ইসলাম, মো. আয়েশ উদ্দিন, মো. শহীদুল্লাহ বাচ্চু, মো. আব্দুস সাত্তার মিয়া, মো. হারুনুর রশিদ ভূঁইয়া, শহীদুল্লাহ পাঠান জিন্নাহ ও শেখ মো. আবুল হোসাইন।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা থেকে ৩৫ মাইল উত্তরে জয়দেবপুর চৌরাস্তা। আর এই চৌরাস্তার ওপরই রয়েছে বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য জাগ্রত চৌরঙ্গী। একজন মুক্তিযোদ্ধার বাম হাতে ধরা রাইফেল। ডান হাতে একটি গ্রেনেড ছুড়ে মারতে উদ্যত। ১৮ ফুট উঁচু এই ভাস্কর্যটি ২২ ফুট উঁচু একটি বেদীর ওপর নির্মিত। ভাস্কর্যটির চারদিক জুড়ে রয়েছে ২০৭ জন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার নাম। যারা ১৬ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ নম্বর ও ১১ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। জাগ্রত চৌরঙ্গী মুক্তিযুদ্ধের প্রথম ভাস্কর্য। এই জয়দেবপুরের জনতা খালি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন পাকবাহিনীর ওপর। ১৯৭২-৭৩ সালে নির্মিত এই ভাস্কর্যটি ভাস্কর প্রবীণ শিল্পী আবদুর রাজ্জাক। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক মুক্তিযোদ্ধার ছবি অবলম্বনে দীর্ঘ এক বছর পরিশ্রম করে তিনি এ ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেন।

সারাবাংলা/এসআই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন