বিজ্ঞাপন

২১ আগস্ট গ্রেনেড সন্ত্রাসের ১৪ বছর

August 20, 2018 | 11:14 pm

।। স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: ইতিহাসের ভয়াবহতম গ্রেনেড সন্ত্রাসের ১৪ বছর পূর্ণ হচ্ছে মঙ্গলবার। ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এই দিনে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেতা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে নারকীয় গ্রেনেড সন্ত্রাস চালানো হয়। এই হামলায় আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন।

স্মরণকালের ভয়াবহ এই হামলায় শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন নেতা সেদিন অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী ও আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। এছাড়াও এই হামলায় আরো ৫শ জন আহত হন। আহতদের অনেকেই চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছেন। তাদের কেউ কেউ আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাননি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে আকস্মিক গ্রেনেড বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা, ভয়াবহ মৃত্যু ও দিনের আলো মুছে গিয়ে এক ধোঁয়াচ্ছন্ন পরিবেশ তৈরি হয়। শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই এই সিরিজ গ্রেনেড হামলা চালানো হলেও তৎকালীন ঢাকার মেয়র মোহাম্মদ হানিফ এবং শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত দেহরক্ষীসহ আওয়ামী লীগের নেতারা তাৎক্ষণিকভাবে এক মানব বলয় তৈরি করে নিজেরা আঘাত সহ্য করে শেখ হাসিনাকে গ্রেনেডের হাত থেকে রক্ষা করেন।

বিজ্ঞাপন

মেয়র হানিফের মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত অস্ত্রোপচার করার কথা থাকলেও গ্রেনেডের স্প্লিন্টার শরীরে থাকার কারণে তার অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হয়নি। পরে তিনি ব্যাংকক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এদিকে, শেখ হাসিনা গ্রেনেডের আঘাত থেকে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণ শক্তি নষ্ট হয়ে যায়।

এই বর্বরোচিত গ্রেনেড হামলায় নিহতরা হলেন— আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন ও ইসাহাক মিয়া।

মারাত্মক আহতরা হলেন— শেখ হাসিনা, আমির হোসেন আমু, আব্দুর রাজ্জাক, সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত, ওবায়দুল কাদের, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, মোহাম্মদ হানিফ, এ এফ এম বাহাউদ্দিন নাসিম, নজরুল ইসলাম বাবু, আওলাদ হোসেন, সাঈদ খোকন, মাহবুবা আখতার, অ্যাডভোকেট উম্মে রাজিয়া কাজল, নাসিমা ফেরদৌস, শাহিদা তারেক দিপ্তী, রাশেদা আখতার রুমা, হামিদা খানম মনি, ইঞ্জিনিয়ার সেলিম, রুমা ইসলাম, কাজী মোয়াজ্জেম হোসেইন ও মামুন মল্লিক।

বিজ্ঞাপন

নৃশংস এই দিনটি জাতি শ্রদ্ধাবনতচিত্তে স্মরণ করবে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।

এ নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর ২১ আগস্ট দিনটিকে ২০০৪ সালের পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত জনগণ গ্রেনেড হামলা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগও দিনটি যথাযথ মর্যাদায় পালন করে থাকে। প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দিবসটি স্মরণে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়েছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে ২১ আগস্ট সকাল ১০টায় ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত বেদীতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে পুষ্পস্তবক অর্পণ করা।

এদিকে, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা হত্যা মামলার বিচারিক আদলতের রায় দেওয়া সম্ভব হবে। রায়টি হলে দেশ আরও একটি দায় থেকে মুক্তি পাবে। রোববার (১৯ আগস্ট) জাতীয় প্রেস ক্লাবের ‘বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর এবং ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার দ্রুত বিচার’ দাবিতে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।

আইনমন্ত্রী বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি ৫২ জন। এর মধ্যে ১৮ জন পলাতক। এ মামলায় আদালতে ২২৫ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ হয়েছে। এছাড়া মামলার এজাহারে অভিযুক্ত আসামিদের প্রত্যেককে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ আদালতে চলা মামলায় এখন সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের যুক্তিতর্ক চলছে। এই মাসেই (আগস্ট) তার যুক্তিতর্ক শেষ হবে। এরপরই তা রায়ের জন্য রাখা হবে। এ হামলায় দায়ের করা মামলার পলাতক আসামিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার আইনি ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী শান্তি সমাবেশে গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি পৃথক মামলায় আদালতে দাখিল করা চার্জশিটে মোট ৫২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।

অভিযোগ আছে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিকারের ব্যাপারে তৎকালীন বিএনপি সরকার নির্লিপ্ত ভূমিকা পালন করেছিল। শুধু তাই নয়, এ হামলার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের রক্ষা করতে সরকারের কর্মকর্তারা ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করছে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করা গ্রেনেড ধ্বংস করে দিয়ে প্রমাণ নষ্ট করার চেষ্টাও করা হয়েছিল।

হামলার পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করা হয় এবং এতে জজ মিয়া নামে এক ভবঘুরে, একজন ছাত্র, একজন আওয়ামী লীগের কর্মীসহ ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। অথচ পরবর্তী তদন্তে তাদের কারও বিরুদ্ধেই অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ রেজাউর রহমান বলেন, ওই হামলার উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করা। হামলার আগে ঢাকায় ১০টি বৈঠক হয়। ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠকগুলো তারেক রহমান ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, মুজাহিদ, আব্দুস সালাম পিন্টু, হারিস চৌধুরী উপস্থিত ছিলেন। টাকা ও গ্রেনেড আসে পাকিস্তান থেকে। পকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের আব্দুল মাজেদ বাট এই কাজে বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। বাংলাদেশে হামলা চালায় জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের সদস্যরা।

তিনি বলেন, এছাড়া সেই সময়ে গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের কয়েকজন এই ষড়যন্ত্রে অংশ নেন। তারা মামলার আলামত নষ্ট, মামলা না নেওয়া এবং হামলার গেয়েন্দা তথ্য থাকার পরও শেখ হাসনার নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমনকি মামলাটির তদন্ত তারা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল।

রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইনজীবী আরও বলেন, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বর্বরোচিত ও নৃশংস গ্রেনেড হামলা মামলার অন্যতম আসামী বিএনপি নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষ পর্যায়ে রয়েছে। মামলায় এ পর্যন্ত ৪৪ আসামির পক্ষে যুক্তিতর্ক পেশ শেষ হয়েছে।

মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত সরকারি আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেছেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার বিচার এখন শেষ পর্যায়ে। দীর্ঘ প্রত্যাশিত এই মামলার রায় চলতি বছরের মধ্যেই হবে বলে তিনি আশাবাদী। এ মামলায় উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দু’টি মামলার পৃথক চার্জশিটে মোট ৫২ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে উল্লেখ করে অ্যাডভোকেট মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, অভিযুক্তদের মধ্যে ১৮ জন এখনও পলাতক।

এ নৃশংস ঘটনায় দায়ের করা মামলার পলাতক আসামিদের মধ্যে তারেক রহমান লন্ডনে, শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ সৌদি আরবে, হানিফ এন্টারপ্রাইজের মালিক হানিফ কলকাতায়, ব্রিগেডিয়রি জেনারেল (অব.) এ টি এম আমিন আমেরিকায়, লে. কর্নেল (অব.) সাইফুল ইসলাম জোয়ারদার কানাডায়, বাবু ওরফে রাতুল বাবু ভারতে, আনিসুল মোর্সালীন এবং তার ভাই মুহিবুল মুক্তাকীন ভারতের কারাগারে এবং মাওলানা তাজুল ইসলাম দক্ষিণ আফ্রিকায় রয়েছে।

এছাড়া জঙ্গি নেতা শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, মাওলানা আবু বকর, ইকবাল, খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম ওরফে বদর, মাওলানা লিটন ওরফে জোবায়ের ওরফে দেলোয়ার, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার (পূর্ব) ও উপকমিশনার (দক্ষিণ) ওবায়দুর রহমান এবং খান সাঈদ হাসান বিদেশে অবস্থান করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, তাদের বেশিরভাগই পাকিস্তানে রয়েছেন।

তবে আরেক অভিযুক্ত পলাতক আসামি হারিস চৌধুরীর অবস্থান জানা যায়নি। পলাতকদের মধ্যে মাওলানা তাজউদ্দিন ও বাবু ওরফে রাতুল বাবু বিএনপি সরকারের সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই। পিন্টুও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় অভিযুক্ত।

সারাবাংলা/এসআই/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন