বিজ্ঞাপন

‘চালুস রোড’, কাস্পিয়ান সাগর আর রঙধনুর গল্প

November 26, 2018 | 8:17 am

।। শাওলী মাহবুব

বিজ্ঞাপন

মধ্যরাতে কোথাও একটা দোয়েল ডেকে ওঠে। দোয়েলের একটানা শিসগানে প্রায় অবাক হয়ে বিছানা ছাড়তে হলো। ঘড়িতে তখন রাত সোয়া তিনটা। আবছা চাঁদ আকাশে। আবছা, কারণ কখনো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ আর কখনো বা ঘন মেঘে চাঁদ ডুবে যাচ্ছে। সোমাল বা উত্তর ইরানের খাজার পারসিয়ান আজাদী হোটেলের একপাশে কাস্পিয়ান সাগর আর একপাশে আলবোর্জ পর্বত। হোটেলের বারান্দা থেকে মধ্যরাতের আলবোর্জ পর্বত দেখতে দেখতে ভাবতে বসি আজ কেমন অদ্ভুত ‘পাওয়া’য় দিন গেলো। ভর করা নিশিকন্যায় বুঁদ হয়ে, গভীর রাতের প্রকৃতি দেখতে হোটেলের বারান্দায় একাই দাঁড়িয়ে থাকি। কান পেতে শোনার চেষ্টা করি দোয়েলের শিস। কিন্তু না, নিশিরাতের স্তব্ধতাকে বুকে নিয়ে দোয়েল বুঝি আবার ঘুমালো।


রাতের নিকষ কালো গভীরেও কালো পাহাড়ের অবয়ব ভেসে থাকে। মেঘগুলো কিছুতেই পাহাড়ের স্পর্শ ছাড়তে চায় না। এমন ঘন অন্ধকারেও কালো পাহাড়ের ওপর ধূসরছাই রঙের মেঘগুলো বোঝা যাচ্ছিল। কাস্পিয়ান থেকে উড়ে গিয়ে আলবোর্জ ডিঙিয়ে যাবার আকুতি মেঘগুলোর। চালুস শহরে পৌঁছেই দেখেছি কিছুতেই পাহাড় ডিঙাতে না পেরে মেঘেদের বৃষ্টি হয়ে ঝরা। থেমে থেমে ঝরছিল প্রায়ই। এখন এই মধ্যরাতেও পাহাড়ের গায়ে, গাছে গাছে জমে আছে মেঘ। ‘সারাদিন’কে ভাবতে বসলাম মধ্যরাতে।

আমাদের গন্তব্য ছিল তেহরান থেকে উত্তর ইরানে, চালুস শহরে। কাস্পিয়ান সাগর দেখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। ম্যাপের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাবেন কাস্পিয়ানকে আধবৃত্তে রেখে বেশ অনেকগুলো শহর রয়েছে সোমাল বা উত্তর ইরানে। জিলান, মাজানদারান, গোলেস্তান এখানকার প্রধান প্রদেশসমূহ আর চালুস, আমল, বাবল, আনজালি, রাসত, সারি এবং কায়েম শাহ্ উত্তরের প্রধান প্রধান শহর। এখানে কোথাও সমতলের জলবায়ু, কোথাও পার্বত্য অঞ্চলের জলবায়ু আবার কোথাও বা আধ-শুষ্ক জলবায়ু দেখা যায়, ঋতুভেদে যাদের সৌন্দর্যের ভিন্ন ভিন্ন রঙ রয়েছে। ইরানিরা সোমাল বা উত্তরকে তাই ‘নববধূ’ ডাকে।

বিজ্ঞাপন


তেহরান থেকে রওনা হলাম সকাল নয়টায়। মোটামুটি ঘণ্টা চারেকের পথ। যাওয়ার বেশ ক’টি রাস্তা থাকলেও চালুস রোড হয়ে যাবো বলেই ঠিক করলাম। কারণ এটি পৃথিবীর সুন্দরতম রাস্তাগুলোর একটা। তেহরান থেকে গাড়ি বেরিয়ে গিয়ে ধীরে ধীরে চালুস রোডে প্রবেশ করল। চালুস রোড, এক রোমাঞ্চের নাম। অফিসিয়ালি চালুস রোডের নাম ৫৯ নং রোড। কারও কারও মতে, পৃথিবীর চতুর্থ সুন্দর রাস্তার নাম ‘চালুস’। একই সঙ্গে অসংখ্য তীব্র বাঁক, সরু রাস্তা আর পর্বতগুলোর পাশ এবং মাঝ বরাবর দিয়ে যাবার কারণে ভয়ঙ্করও বটে। তার মানে চালুস রোড হলো পৃথিবীর ভয়ঙ্কর সুন্দর এক রাস্তার নাম।


বলা হয়ে থাকে, অন্ধকার আর ভেজা থাকলে চালুস রোড এক দুঃস্বপ্নের নাম। কারাজ শহর হয়ে গেলে পবর্তের তীক্ষ্ণ চূড়াগুলো পার হতে হয়। আমাদের গাড়ি আল-বোর্জের দুর্গম রাস্তা দিয়ে ক্রমশ ঢুকে যেতে থাকল। শুরুর দিকে একপাশে পাহাড় আর অন্যপাশে পড়ল চলার ছন্দে মাতোয়ারা ঝরা, ইরানিরা যাকে নদী বলে। এবার আলবোর্জের চূড়ায় নভেম্বরের শুরুতেই হালকা বরফ পড়তে শুরু করেছে। রোদের আলতো স্পর্শেই সেগুলো দ্রুত গলে যাচ্ছে। এই ঝরাগুলো সেই বরফগলা নদী। পাহাড়ি রাস্তার কখনো এপাশে, কখনো ওপাশে নূপুর-নিক্কণে ঝরাগুলো তাদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছিল আর দুষ্ট কিশোরীর মতোই লুকোচুরি খেলছিল। চলার পথে একটু দেখা দিয়েই পালিয়ে যাচিছল দূর বুনো বনে।


গাড়ি থেকে ঝরাগুলো দেখে দেখে মন ভরছিল না। কাজেই থামতে হলো কোন এক বাঁকে। ঝরাগুলো শক্ত পাথরের উপরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল বলে কলকল ধ্বনি একটু বেশীই কানে বাজছিল। হেমন্তের শেষেও ঝরার ধারগুলোতে সবুজ গাছের সমাহার। বিচ বন ঘিরে আছে দুইধার। সারবাঁধা বৃক্ষরাজির ছায়া পথটাকে কেমন পরম মমতায় বেঁধে রেখেছে! এখানে ওখানে ঝরার পাশে তাঁবু দেখা গেলো পর্যটকদের। খানিক দাঁড়িয়ে ঘোরাঘুরি করে আবার চলতে শুরু করলাম। ঘুরে ঘুরে গাড়ি উঠতে শুরু করল চূড়ামুখী। মনে হলো শত বাঁক পেরোতে থাকলাম। এই বাঁক আর বাঁকের সৌন্দর্য নিজেই এক সৌন্দর্যের জগত তৈরি করে ফেলল।

বিজ্ঞাপন

চালুস রোড দিয়ে যারাই গেছেন, তারা জানেন এর বেশ ভালো পরিচর্যা করা হয়। অনেকখানি পথ গেছে কঠিন পর্বত ভেদ করে। সামনে পর্বত দাঁড়িয়ে গেলে, তার বুক চিরে পথ তৈরি করে নিয়েছে মানুষ। অর্থাৎ চালুস রোড দিয়ে যাবার পথে বেশ ক’টি টানেল পড়বে। এর কোনো একটি নব্বই বছর আগে তৈরি। জানা গেল, তা শুধু শ্রমিকের হাতের জোরে তৈরি, ভারী কোনো যন্ত্র ছাড়াই। ছোট-বড় টানেলগুলোর দেয়াল এতোটাই শক্ত পাথরের যে সেখানকার দেয়ালে প্লাস্টার করার প্রয়োজন পড়েনি। অর্থাৎ আপনি নির্দ্বিধায় একে গুহা বলতে পারেন। টানেলের ভেতর অনেক স্থানেই ছাদ থেকে টুপটাপ পানিও পড়ছিল যা দেখে অবাক না হয়ে পারিনি।


যেখানে পথ একটু বেশি বিপদজ্জনক, সেখানেই নতুন করে আবারও পথ বা টানেল তৈরি করা হচ্ছে। চালুস রোডে তিনটি বড় ব্যারেজ বা ড্যাম চোখে পড়েছে। লেকগুলোর পানি আকাশের সাথে তাল মিলিয়ে আসমানি নীল। আর পাশের পাহাড়ের গায়ের পাথরের কাজগুলো দেখে মনে হচ্ছিল ভাস্করের নিখুঁত কাজ। পুরো পার্বত্য অঞ্চলটিতেই বিচূর্ণীভবনের ফলে নানা রকমের কারুকাজ তৈরি হয়ে আছে। এবার আবারও ঘুরে ঘুরে নামার পালা। আঁকাবাঁকা পথের ধারগুলো ধরে চা, কফি বা খাবার রেস্টুরেন্ট রয়েছে। সেগুলোতে নেমে খানিক জিরিয়ে নেয়া যায়। শীতকালে এই বাঁকের পাশগুলোতেই বরফ পড়ে বেশ নান্দনিকতার সৃষ্টি করে। দুর্গম এই পথে চলতে চলতে এমনও অনেক স্থান চোখে পড়েছে যেখানে বরফগলা ঝিরির পানি রাস্তার উপরই পড়ছে। তবে তা খুব হালকা চালে। আবার, কোথাওবা বিপুল বেগে পাহাড়ের গা বেয়ে নামছে ঝর্ণা।


ধীরে ধীরে আমাদের গাড়ি প্রবেশ করলো পাহাড় ঘিরে বন আছে এমন এলাকায়। এখানকার গাছগুলো সরলাকৃতির আর পত্রমোচী। এখন এই হেমন্তে রঙবদল করছে পাতারা। কিন্তু অবাক কান্ড হলো ঝরে যাবার বেদনায় তারা মোটেই বিষণ্ণ নয় বরং রঙিন। বিদায়ও কেমন বর্ণিল হতে পারে! হয়ত নিজের পূর্ণতার গর্বে অথবা নতুনকে স্থান করে দেবার আনন্দেই। এমন রাস্তায় চলার আনন্দে কবি শিল্পীরা রীতিমতো মোহিত হয়েই গান রচনা করেছেন। পারসী শিল্পী মেহরান আতাসের জাদেহ চালুস বা চালুস রোড এমনই এক গান:
‘আরো একবার রাস্তাগুলো সাজাও
তোমার মনের রঙে,
বেদনার হাওয়া বইতে দিওনা।
চালুসের রাস্তায় গাছগুলো সারিবদ্ধ অপেক্ষায়
তোমার,
দু’চোখের লেন্সে সেলফি তুলতে
এই বাসের পেছনের আসনটিতে
আমারি পাশে এসে বসো।’


চালুস শহরটি মাজানদারান প্রদেশের এক শহর। চালুস রোড হয়ে শহরে ঠিক ঢোকার মুখেই আর কিছু চোখে পড়ার আগেই দিগন্তব্যাপী ঘন নীল কাস্পিয়ান ভেসে উঠল। বইখাতা আমাদের যে তথ্য দিয়েছে তা হলো কাস্পিয়ান এক বদ্ধ সাগর অথবা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হ্রদ। আর বাস্তবিক অর্থে একটা সাগর হবার জন্য যা যা গুণ প্রয়োজন তার সবই আছে কাস্পিয়ানের; নীলরঙা দিগন্ত, চমৎকার ঢেউ, সরু তট, নোনাজল সবই এর বৈশিষ্ট্য। এর চারপাশ ঘিরে আছে বেশ ক’টি দেশ। উত্তরপূর্বে এটা কাজাখস্তান, উত্তরপশ্চিমে রাশিয়া, পশ্চিমে আজারবাইজান, দক্ষিণে ইরান, দক্ষিণপূর্বে তুর্কিমেনিস্তান দিয়ে কাস্পিয়ান আবদ্ধ। সাগরের আয়তন ৩ লাখ ৭১ হাজার বর্গকিলোমিটার। আমরা কাস্পিয়ানের তীরে পৌঁছুলাম শেষ বিকেলে। আকাশে তখন বেশ ঘন মেঘ ছিলো। হঠাৎ মেঘ সরে গেলে আলোর এক বিচ্ছুরণ তৈরী হলো। দিগন্তজুড়ে নাটকীয়ভাবে দেখা গেলো রঙধনু। একটা নয়, দুটো; একটা বেশ দীর্ঘ, অন্যটি তার পাশ জুড়ে অস্তিত্ব জানান দিল শুধু। কিন্তু এটাই আমাদের জন্য, আমরা যারা সেদিন কাস্পিয়ান তীরে ছিলাম তাদের জন্য বাড়তি আনন্দ আর পাওয়া যোগ করল।

বিজ্ঞাপন


পরদিন ফেরার পালা। আবারও চালুস রোড ধরে। কাস্পিয়ানকে বিদায় জানিয়ে রওনা হলাম। আজ দেখি চালুস রোড আবারও অন্য দ্যোতনায়, অন্য রঙে সেজে আছে। বলা হয়ে এ রাস্তায় ভ্রমণ করলে একই সঙ্গে চার ঋতু দেখতে পাওয়া যায়। অর্থাৎ গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত এবং বসন্ত। আর আমার অভিজ্ঞতা বলে, এ অসম্ভব অভিজ্ঞতাটি আমাদের যাত্রায়ও হয়েছে। চালুস একই সাথে ঠিক যেমন সবুজ দেখাবে তেমনি হঠাৎ করেই সাদার দেখা পেতে পারেন অর্থাৎ বরফ পড়তে শুরু করতে পারে। ফেরার পথে কান্দোভান পৌঁছুতে পৌঁছুতে মেঘে ঢেকে গেল চারপাশ। আমরা তখন আক্ষরিক অর্থে মেঘের ভেতর। পাহাড়ের পাদদেশ থেকে চূড়া পর্যন্ত মেঘে ঢাকা। একটু থেমে, মেঘ-ভেজানো কফি পান করে আবার চলতে শুরু করলাম। কিন্তু অন্তত পনের মিনিট ধরে গাড়ি চলার পরও মেঘের দৌড়াত্ম কমলো না।

এ বাঁক, ও বাঁক প্রায় মেঘের ভেতর দিয়েই চলতে হলো আমাদের। এর মাঝেই শুরু হলো হালকা বৃষ্টি আর বৃষ্টির মাঝ দিয়েই বরফ কণা। কিছুটা বিহ্বলতায় গাড়ির গ্লাস খুলে দিলাম আমরা গাড়ির ভেতর বরফকণা ঢোকার জন্য। কিন্তু প্রচন্ড ঠাণ্ডায় ছেদ পড়ল সে রোমান্টিকতায়। চালুস রোডের পাহাড়ী দ্যোতনা, কাস্পিয়ানের চিরকালীন সামুদ্রিক টান সবকিছুই মন ছুঁয়ে যাবার মতো। জীবনব্যাপী মনের কোণে যত্ন করে ধরে রাখার মতোই অভিজ্ঞতা এক।

সারাবাংলা/এমও

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন