বিজ্ঞাপন

চীনের ভোক্তারা কোথায় ?

January 14, 2019 | 7:27 pm

।। জিম ও’নিল ।।

বিজ্ঞাপন

গত দশকের বেশিরভাগ সময়ই চীনের মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রমবর্ধমান ব্যয় ক্ষমতা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে জ্বালানি সরবরাহ করে আসছে। ২০০৮ এর বিশ্বমন্দার পর আমি বলেছিলাম যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন তাদের অবস্থান বদলানো উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঞ্চয় বাড়িয়ে খরচ কমানো এবং চীন করবে তার ঠিক বিপরীত। গত বছর পর্যন্ত ব্যাপকভাবে এটাই ঘটেছে। কিন্তু এখন আর নয়।

সম্প্রতি অ্যাপল তাদের শেয়ারহোল্ডারদের উদ্দেশে লেখা এক চিঠিতে প্রকাশ করেছে যে, ২০১৯ সালের প্রথম ৪ মাসে তাদের আয় কমবে। তারা চিঠিতে চীনকে আইফোন, ম্যাক এবং আইপ্যাডের গুরুত্বপূর্ণ বাজার হিসেবে উল্লেখ করে জানিয়েছে চীনের শ্লথ অর্থনীতিই তাদের আয় কমার কারণ। যদিও প্রযুক্তিবিদরা এ নিয়ে বিতর্ক করছেন, কেউ কেউ বলছেন অ্যাপলের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারগুলোর পরিবর্তনই আয় কমার মূল কারণ। তবে এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, চীনে তাদের বিক্রি কমেছে।

চীনা ভোক্তাদের ভোগের পরিমাণ হ্রাসের হার বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য চীন-মার্কিন বাণিজ্য অবরোধের চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারে। বলাই বাহুল্য মার্কিন বাণিজ্য নীতি এবং অন্যান্য বাহ্যিক বিষয় চীনের অভ্যন্তরীন ভোগের উপর তেমন প্রভাব ফেলে না, এই সমস্যা আসলে দেশটির অর্থনৈতিক কাঠামোর গভীর থেকে উত্থিত।

বিজ্ঞাপন

অবস্থা পুরোপুরি বোঝার জন্য গত দশকে চীনের পরিবর্তনগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। চীনের সরকারি তথ্য অনুযায়ী ২০১০ সালের শেষ নাগাদ চীনের জিডিপির প্রায় ৩৫.৬ শতাংশ পরিমাণ অর্থ দেশীয় ভোক্তারা খরচ করেছেন। একই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই হার ছিলো জিডিপির ৭০ শতাংশ। মার্কিন ডলারের হিসেবে চীনের খরচ ছিলো প্রায় ২.২ ট্রিলিয়ন ডলার পক্ষান্তরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছিলো ৫ গুন বেশি ১০.৫ ট্রিলিয়ন ডলার।

এই বিশাল প্রার্থক্য সত্ত্বেও চীনের সামগ্রিক উচ্চ প্রবৃদ্ধির হার দেশটির ভোক্তাদের বৈশ্বিক অর্থনীতিতে আরও বড় ভূমিকা পালন করার সামর্থ্য প্রকাশ করে। বিশ্বব্যাপী বড় ব্র্যান্ডগুলো যেমন অ্যাপল, বিএমডব্লিউ, ব্লুবেরি, ফোর্ড এর মত পণ্য তারা ভোগ করার সামর্থ অর্জন করেছে। ২০১৭ সাল নাগাদ জিডিপির ৩৯.১ শতাংশ চীনা নাগরিকরা ভোগ করেছেন যা ডলারের হিসেবে ৫ ট্রিলিয়ন। অর্থাৎ ৭ বছরে প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার অভ্যন্তরীণ ভোগ বেড়েছে। যদিও তা এখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় অনেক কম (১৩.৫ ট্রিলিয়ন ডলার)। তবে এটা সত্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তাদের ভোগের পার্থক্য কমে এসেছে।

জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার এবং আভ্যন্তরীন ভোগের হার যদি এ ধারায় চলতে থাকে তাহলে চীনে ২০২০ সাল নাগাদ এই খরচ আরও ২ ট্রিলিয়ন ডলার বাড়তে পারে যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক হবে। তখন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে চীনা ভোক্তারা বেশি ভোগ করার ক্ষমতা অর্জন করবে।

বিজ্ঞাপন

আগামী ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল সময়কালে চীনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার যদি ৮ শতাংশ হয় যা গত ১০ বছর ছিলো ১০ শতাংশ, এবং জিডিপির ৫০ শতাংশ পরিমাণ অর্থ যদি চীনা ভোক্তারা খরচ করে তবে ২০৩০ সাল নাগাদ এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১৮.৪ ট্রিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। এই চিত্র যদি বাস্তবায়ন হয় তবে চীনের ভোগের পরিমাণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে যাবে।

২০১৯ সালের শুরুতে অন্যতম একটি প্রশ্ন হচ্ছে, যদি এরকম চিত্র বাস্তবায়ন না হয় তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতির চেহারা কী হবে ? যদি অ্যাপলের মতন প্রতিষ্টানের ভোক্তা চীনে কমতে থাকে, তবে কী মার্কিন ভোক্তারা আরও এক দশকের জন্য খরচের জ্বালানি সরবরাহ করে বৈশ্বিক অর্থনীতির চালিকাশক্তি রুপে থাকতে পারবে? অথবা অন্য কোনো দেশ কী এই ভুমিকায় অংশ নিতে পারবে?

গত ৪০ বছরে আমি শিখেছি কখনোই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামর্থ্যের প্রতি সন্দেহ না করতে। মার্কিন ভোক্তারা কোনো না কোনো উপায়ে তাদের ভোগ জারি রাখবেই। তবুও ভোক্তাদের খরচ কমে যাওয়ার বহু কারণ রয়েছে সামনে। যেমন মুদ্রাস্ফীতি, উচ্চ সুদের ঋণ এবং সঞ্চয় বৃদ্ধির জন্য মার্কিন চাপ। যাই হোক, মার্কিন ভোক্তাদের উপর বৈশ্বিক অর্থনীতির অতিমাত্রায় নির্ভরতার কথা সকলেরই জানা। যেমন আমরা দেখেছি ২০০৮ সালে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে একটু ঠাণ্ডা লেগেছিলো, ফলাফলে সারাবিশ্বের জ্বর উঠেছিলো।

এটা নিশ্চিত যে, আগামি দশ বছরে অন্য কোনো দেশ এই ভূমিকা পালনের কোনো সম্ভাবনাই নেই। উন্নত বিশ্বের বড় অর্থনীতিগুলো নিম্ন প্রবৃদ্ধির সমস্যায় ভোগছে। এছাড়া তাদের ভোক্তাদের খরচের পরিমাণ বিশ্ব অর্থনীতিতে খুব একটা প্রভাব ফেলে না।

বিজ্ঞাপন

উদীয়মান অর্থনীতি যেমন ভারত, ইন্দোনেশিয়া এবং নাইজেরিয়ার মত দেশ নিশ্চিতভাবেই আগামী ২০ বছর পর চীন বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাদের সমান খরচ করতে পারবে, কিন্তু এটাও নিশ্চিত যে এদের কেউই এই মুহূর্তে এমন পর্যায়ে নেই যে তারা এখনই চীনের ভোক্তাদের সমান খরচ করতে পারবে, এমনকি আগামি ১০ বছরেও সম্ভব নয়। যেমন ভারতের জিডিপি ২০২০ সাল নাগাদ ৩ ট্রিলিয়ন ডলার হবে যার ফলে দেশটি পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হতে পারবে কিন্তু তবুও প্রতিদ্বন্দি চীনের চেয়ে ভোগের দিক দিয়ে অনেক অনেক দূরেই থাকবে তাদের অবস্থান।

এখন প্রশ্ন হলো, চীনের ভোক্তারা কী পুনরুজ্জীবিত হতে পারবে? আমি দারুণভাবে আশাবাদী। চীনের নীতিনির্ধারকদের উচিত ভোক্তাদেরকে আরও বেশি সরাসরি অর্থিক সহায়তা প্রদানের কথা বিবেচনা করা। পাশাপাশি ‘হুকু’ (পারিবারিক নিবন্ধীকরণ) প্রথার সংস্কার করা, যা আসলে দেশটির গ্রামীণ অভিবাসী শ্রমিকদের বিভিন্ন অধিকার ভোগের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আরও অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের মাধ্যমে দেশের জনসংখ্যার এই উল্লেখযোগ্য অংশকে ভোগের স্রোতে নিয়ে আসা যাবে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পেলে তারা সঞ্চয় কমিয়ে ভোগ বৃদ্ধি করবে।

লেখক: যুক্তরাজ্যের সাবেক ট্রেজারি মিনিস্টার। গোল্ডম্যান স্যাকস এসেট ম্যানেজমেন্টের সাবেক চেয়ারম্যান। প্রজেক্ট সিন্ডিকেটে প্রকাশিত। ভাষান্তর: আতিকুল ইসলাম ইমন।

সারাবাংলা/এমও

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন