বিজ্ঞাপন

চেনার জন্য চীনে ।। পর্ব-২।।

October 24, 2018 | 6:14 pm

পলাশ মাহবুব ।।

বিজ্ঞাপন

আমরা যে হোটেলে উঠেছি সেটির নাম লিয়ানজি হোটেল। হোটেলের নামটাই শুধু ইংরেজিতে লেখা। বাকি সব চাইনিজ ভাষায়। লিয়ানজি হোটেল এয়ারপোর্ট থেকে ত্রিশ মিনিটের মতো ড্রাইভিং দূরত্বে। হোটেলটি বেইজিং শহরের একপ্রান্তে। এয়ারপোর্ট থেকে শহরে ঢোকার শুরুর দিকেই এর অবস্থান। আমাকে নেয়ার জন্য যে ড্রাইভার এয়ারপোর্টে এসেছেন তিনি বেশ হাসিখুশি আর স্বাস্থ্যবান। লম্বা-চওড়া মানুষ। চীনা মানেই ছোটখাটো আর বোঁচা নাকের মানুষ- মাথার মধ্যে এমন ধারণাই ছিল। শুরুতেই সেটা ভুল প্রমানিত হলো। এরপর দিন যত গেছে আবিষ্কার করেছি বেটে-খাটো আর বোঁচা নাকের যে চীন আমাদের মাথায় গেঁথে আছে সেই দিন আর নেই। দিনে দিনে চীনের অর্থনীতি যেমন ধারালো হয়েছে তেমনি সূঁচালো হয়েছে চীনাদের নাক আর দীর্ঘকায় হয়েছে তাদের গড়ন।  চীনাদের চিনতে হবে নতুনভাবে।

লিয়ানজি সুন্দর ছিমছাম হোটেল। হোটেলের রিসেপশনের হাসি হাসি মুখের ছেলে-মেয়েগুলোও সুন্দর তবে যতক্ষন তারা মুখ বন্ধ রাখে ততক্ষন। কারণ মুখ খুললে তাদের মুখের কথা কিছু বুঝতে পারি না। আর তাদের কাছে কিছু জানতে চাইলেই মোবাইল ফোনে একটা অ্যাপস বের করে মুখের দিকে বাড়িয়ে দেয়। আমরা যা বলার ইংরেজিতে বলি তারা সেটা চাইনিজ ভাষায় কনভার্ট করে নেয়। তারপর মাথা নেড়ে নিজেদের মধ্যে কিছুক্ষন চুং চাং করে, আমাদের সমস্যার সামাধান হয়ে যায়। পুরো বেইজিং শহর জুড়ে এই একই ঘটনার মুখোমুখি হলাম অনেকবার। কারও সাথে কথা বলতে গেলে প্রথমে পকেটে হাত ঢোকায় তারপর মোবাইল ফোন বের করে বাড়িয়ে দেয় মুখের দিকে।

স্ট্যাফেনি এসেছে আয়োজক সংস্থা সিটিটিভি থেকে। হাসি মুখে ওয়েলকাম জানিয়েই হাত থেকে পাসপোর্ট নিয়ে নিল। তারপর ডাবল হাসিমুখে বললো, পাসপোর্ট ফিরিয়ে দেয়া হবে তোমার ফেরার দিন এয়ারপোর্টে যাবার সময়। আশাকরি এরমধ্যে আর তোমার পাসপোর্টের কোনও দরকার পড়বে না। আমি মাথা নেড়ে বললাম, তা বটে, তা বটে। যাওয়া-আসা ছাড়া পার্সপোটের আর কাজ কি। তারপর স্ট্যাফেনির হাতে পাসপোর্ট জমা দিয়ে আয়োজকদের কাছে সোপর্দ হয়ে গেলাম। আমার দায়িত্ব এখন তাদের।

বিজ্ঞাপন

তের দিনের বেইজিং বাসে আমাদের মূল ঠিকানা কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অফ চায়না (সিইউসি), সাংবাদিকতা বিষয়ে চীনের শ্রেষ্ঠ ইউনিভার্সিটি। বিশ্ববিদ্যালয়টির বৈশ্বিক অবস্থানও ঈর্ষনীয়। ক্যাম্পাস জুড়ে নানান দেশের ছাত্র-ছাত্রীদের পদচারনা। অবকাঠামোগত দিক দিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়টির শক্তিশালী অবস্থান।

কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অফ চায়নার মূল ভবনের সামনে। তবে এই ভবন দেখে বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিসর সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে না। বিশাল আয়তন নিয়ে গড়ে উঠেছে কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অফ চায়নার ক্যাম্পাস

সিইউসি ক্যাম্পাস লিয়ানজি হোটেলের কাছাকাছি। আমরা সকাল সাড়ে আটটায় ক্যাম্পাসে যাই সারাদিন ক্লাস করে ফিরে আসি সন্ধ্যা সাতটা-সাড়ে সাতটার দিকে। সকালের নাস্তা করি সকাল সাতটায়। তের দিনের চীনবাসের এটাই ছিল সবচাইতে মর্মান্তিক বিষয়। সকাল সাতটায় নাস্তা! তার মানে উঠতে হয় ভোর ছয়টায়। দেশে থাকতে তখনো আমার দেড় ঘন্টার ঘুম বাকি।

কিন্তু কি আর করা! পড়েছি চীনাদের হাতে, সকাল সাতটায় নাস্তা করতে হবে ওনাদের সাথে! আমরা মানে মানে মেনে নিয়ে ঠিক সকাল সাতটায় নাস্তা করি। তারপর ক্যাম্পাসে যাই। প্রথম দফার ক্লাস করে ১২টার মধ্যে দুপুরের লাঞ্চ। রাতের খাবার ঠিক সন্ধ্যা ছয়টায়। যখন রাতের খাবার দেয়া হতো তখনো বাইরে ফকফকা আলো। রাত নামার আগেই রাতের খাবার! এটাও একটা মর্মান্তিক ব্যাপার। তারওপরে চাইনিজ খাবারের বিষয়টাতো আছেই। ওহ গড! ভীন দেশিদের কাছে চীনা খাবার অনেকটা প্রতারক-ছলনাময়ী টাইপের। বাহির থেকে দেখতে শুনতে বেশ ভালো কিন্তু খেতে গেলেই গন্ডগোল।

বিজ্ঞাপন

সিইউসি’তে আমাদের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় ছিল এই ধরণের খাবার

আমার চীন ভ্রমণের উদ্দেশ্য বারো দিনের একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালায় অংশ নেয়া। বিষয় ‘কনভারজেন্ট জার্নালিজম’। এগারো দেশ থেকে প্রায় আঠারোজন টেলিভিশন সাংবাদিক ও নির্মাতা এসেছি এই কর্মশালায় অংশ নিতে। কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অফ চায়নার খ্যাতিমান সব শিক্ষকরা আমাদের ক্লাস নেবেন। চাইনিজ শিক্ষক! তারমানে সেই তো দোভাষির ব্যাপার, আমরা ধরে নেই। কিন্তু আমাদের ধারণা পচাত্তর শতাংশ ভুল প্রমানিত হয়। কারণ আমাদের ক্লাস নিয়েছেন ৮জন শিক্ষক। এরমধ্যে শুধুমাত্র দুইজন শিক্ষক দোভাষির সাহায্যে ক্লাস নিয়েছেন। বাকি ছয়জন ক্লাস নিয়েছেন ইংরেজিতে। একজন শিক্ষক জোর দিয়ে বললেন, তোমরা যখন পরবর্তীতে চীনে আসবে তখন হানড্রেড পার্সেন্ট শিক্ষকই ইংরেজিতে লেকচার দেবেন।

তার কথার প্রমাণও পাওয়া গেছে হাতেনাতে। চীনে একসময় ইংরেজি চর্চার কোনও বালাই ছিল না। চীনারা ইংরেজি ভাষার ব্যাপারে ছিলেন চরম উদাসীন। ভাবটা এমন, আমাদের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে চাইনিজ শিখে আসো। নয়তো রাস্তা মাপো। সরকারিভাবেও ইংরেজির প্রতি অতোটা আ্গ্রহ ছিল না।

কমিউনিকেশন ইউনিভার্সিটি অফ চায়না’র ক্যাম্পাসের এই পাথর খণ্ডটি মূলত ইচ্ছেপূরণ দেয়াল। এখানে এসে সবাই যার যার মনে ইচ্ছে প্রকাশ করে।

কিন্তু এখন সময় বদলেছে। চীনে এখন স্কুল লেভেল থেকেই ইংরেজির প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে নতুন যে প্রজন্ম উঠে আসছে তারা হবে পুরোদস্তুর ইংরেজি জানা প্রজন্ম। ইংরেজির প্রতি চীনাদের আগ্রহের বিষয়টি আরও নানা ক্ষেত্রে লক্ষ্যনীয়। চীনের সরকার নিয়ন্ত্রন প্রধান টেলিভিশন মাধ্যম সিসিটিভি। সিসিটিভি আগে শুধু চীনা ভাষাতেই সম্প্রচার হতো। ২০১৭ সাল থেকে সিসিটিভি ইংরেজিতেও সম্প্রচার শুরু করেছে। চীন মনে করছে, বিশ্বজুড়ে তাদের অবস্থান পোক্ত করার জন্য গণমাধ্যমের বিকাশ দরকার। আর বিশ্বব্যাপী তাদের গণমাধ্যমকে ছড়িয়ে দিতে হলে সেটা চাইনিজ ভাষায় সম্ভব না। সেজন্যই ইংরেজির প্রতি আগ্রহি হয়ে উঠছে তারা। আর একথা কে না জানে, চীনারা যখন কোনও বিষয়ে আগ্রহি হয়ে ওঠে সে বিষয়ে তারা চূড়ান্ত সফলতা নিয়েই শেষ করে।

লেখা শেষ করবো। শেষটা বেইজিং আর ঢাকা শহরের মধ্যে একটা মিল দিয়ে শেষ করি। ঢাকার মতো বেইজিংয়ের রাস্তাতেও প্রচুর জ্যাম। তবে আমাদের যেমন জ্যামের সঙ্গে অসম্ভব রকমের হাউকাউ আর হর্ণের কান ঝালাপালা আছে বেইজিংয়ে সেটা নেই। দীর্ঘ সময় ধরে জ্যামের মধ্যে থেকেও তারা অসম্ভব রকম শান্ত। এই ধৈর্যের কারনেই হয়তো দিনকে দিন এগিয়ে যাচ্ছে তারা।

বিজ্ঞাপন

পলাশ মাহবুব : কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার। উপ সম্পাদক- সারাবাংলা।

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন