December 28, 2017 | 8:34 pm
এমএকে জিলানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঢাকা : নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আগামী জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে বাংলাদেশ থেকে তাদের নিজের দেশ মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সুযোগ পাবে। তার আগে বঞ্চিত এই জনগোষ্ঠীকে তাদের বসত-ভিটায় ফিরিয়ে নেয়ার পুরো কার্যক্রম চূড়ান্ত করতে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি ১৫ জানুয়ারির মধ্যে নেপিডোতে বৈঠকে বসবেন। শুরুতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ফেরত নিবে মিয়ানমার।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বৃহস্পতিবার দুপুরে তার কার্যালয়ে সারাবাংলাকে বলেন, রোহিঙ্গাদের তাদের বসত-ভিটায় ফেরত নেয়ার কার্যক্রম দুই দেশের মধ্যে করা সমাঝোতা স্মারক অনুযায়ী নির্ধারতি সময়ের মধ্যেই শুরু হবে।
নির্যাতিত এই জনগোষ্ঠীকে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমাঝোতা স্মারক সই করা হয়। সমাঝোতা স্মারক অনুযায়ী, সামনের ২৩ জানুয়ারির মধ্যে ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করার কথা।
২৩ জানুয়ারির মধ্যে ফেরত কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব কিনা জানতে চাইলে শাহরিয়ার আলম বলেন, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রত্যাবাসন শুরু করতে আমরা আশাবাদি। বিশেষ প্রয়োজনে সেটা এক-দুই দিন আগে বা পরে হতে পারে। এটা কাজের প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করবে। নির্ধারিত তারিখের আগে শুরু হলে ভাল। আর কোনো কারনে দু-একদিন পরে শুরু হলেও সেটাকে নেতিবাচকভাবে দেখার সুযোগ নেই।
কতোজনকে ফেরত নেবে মিয়ানমার? এমন প্রশ্নের জবাবে প্রতিমন্ত্রী বলেন, সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ৯ লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বায়োমেট্রিক রেজিস্ট্রেশন শেষ হয়েছে। রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া এখনো চলমান। আমরা সবাইকেই তাদের বসত-ভিটায় ফেরত পাঠাতে চাই। কিন্তু চুক্তি মিয়ানমার শুরুতে ২০১৬ সালের পর যেসব রোহিঙ্গারা আসছেন তাদের ফেরত নিতে রাজি হয়েছে। সে যাই হোক, সবার আগে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটা চালু করতে চাই। চালু হয়ে গেলে তারপর বাকি সমস্যারও সমাধান চলে আসবে।
তিনি আরো বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এখন ১৯ হাজার শিশু রয়েছে। যাদের পিতামাতা বা অভিবাবক বা কোনো আত্মীয়-স্বজনদের এখনো চিহ্নিত করা যায়নি। তাই সামনের দিনে এই বিষয়গুলো সমাধানের জন্যও কাজ করা হবে।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ফেরত কার্যক্রম কীভাবে হবে, তা ঠিক করতে জানুয়ারির ১৫ তারিখের মধ্যে দুই দেশের মধ্যে আরো একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। বৈঠকটি মিয়ানমারের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হবে। ওই বৈঠককে সামনে রেখে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অন্য মন্ত্রণালয়গুলো নিয়ে লাগাতার বৈঠক করছে। যাতে ফেরত প্রক্রিয়া সহজ ও সুচারুভাবে শেষ হয়।
এদিকে, মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী ড. উইন মিয়াত আইয়ি গণমাধ্যমকে জানান, ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি অনুযায়ী দুই মাসের মধ্যে শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে সম্মত হয়েছি। জানুয়ারির ২২ তারিখে ওই চুক্তির দুই মাস পূর্ণ হবে। তাই ওইদিন থেকেই প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করতে চাই। তবে শুধু তাদেরই ফেরত নেব, যারা স্বেচ্ছায় ফিরতে চায়। ফিরে যাওয়াদের তাদের পুরনো বাসস্থানের যত কাছাকাছি সম্ভব পুনর্বাসন করা হবে।
ড. উইন মিয়াত আইয়ি আরও জানান, রাখাইনের তাওয়াং পিয়ো লেট ওয়া এবং নাগা খু ইয়া গ্রামে দুটি রিসিপশন সেন্টারের মাধ্যমে সরকার শরণার্থীদের ফেরানোর পরিকল্পনা করেছে মিয়ানমার সরকার। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যাদের বাড়ি এখনও অক্ষত আছে তাদের নিজেদের জায়গায় ফিরিয়ে নেওয়া হবে। এ ছাড়া যাদের বাড়িঘর ধ্বংস হয়ে গেছে তাদের সরকার নতুন করে বাসস্থান গড়ে দেবে। যা বন কিংবা খামারের আশপাশে তৈরি করা হবে, যাতে তারা কাজ করতে পারে।
মন্ত্রী উইন মায়াত একই সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে দেশটির সরকার গঠিত কমিটির প্রধান। উইন মায়াত মিয়ানমারে কর্মরত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের গত সপ্তাহে জানান, ফেরত আসা রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র এবং যোগ্যদের নাগরিকত্ব লাভের জন্য জাতীয় যাচাইকরণ প্রক্রিয়াতেও তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হবে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, মিয়ানমারে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের আগামি ১৫ জানুয়ারির মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশের অবস্থান ঠিক করতে দফায় দফায় বৈঠক করছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। রোহিঙ্গাদের বিষয়ে গঠিত জাতীয় টাস্কফোর্স এবং আন্ত:মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠক বৃহস্পতিবারও হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ফেরতের বিষয়ে বাংলাদেশ কখন কীভাবে কী করতে চায় সেসব বিষয় বিভিন্ন বৈঠকে ঠিক করা হচ্ছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর প্রত্যাবাসনপ্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করার প্রস্তাব দিয়েছে। সম্প্রতি এই সংস্থার ডেপুটি হাইকিমশনার কেলি ক্লেমেন্টস বলেছেন, মিয়ানমারের রাখাইনের পরিস্থিতি এখনও নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত নয়। এখনও শরণার্থীরা পালাচ্ছেন।
গত ২৫ আগস্ট রাখাইনে সহিংসতা জোরালো হওয়ার পর হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধারার সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সাড়ে ছয় লাখেরও বেশি মানুষ। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ও রাষ্ট্রপ্রধানরা এ ঘটনাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অবহিত করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন এই ঘটনাকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের ‘পাঠ্যপুস্তকীয় উদাহরণ’ আখ্যা দিয়েছে। রাখাইন সহিংসতাকে জাতিগত নিধন আখ্যা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। তুমুল সমালোচনা করছে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ।
সারাবাংলা/জেআইএল/জেডএফ