বিজ্ঞাপন

টেলিকম, সোনার হাঁসটিকে যেন মেরে না ফেলি

November 4, 2018 | 2:44 pm

বাংলাদেশের টেলিকম খাত অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। অনেক উন্নত দেশের টেলিকম খাতের চেয়েও এগিয়ে আছে বলে আমার মনে হয়।

বিজ্ঞাপন

দেশের জাতীয় উন্নয়নে চোখে পড়ার মত অবদান রেখেছে তা নির্দিধায় বলা যায়। প্রথমত, টেলিকম খাত মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগের এক অনন্য বিপ্লব ঘটিয়েছে। সবার হয়তো মনে আছে ল্যান্ড-লাইনে একে-অপরের সাথে যোগাযোগের বিড়ম্বনা এবং একটি টেলিফোন সংযোগ বাড়িতে বা আপিসে নেয়ার দুঃসহ কষ্ট। দ্বিতীয়ত, এ খাত একাই দেশের জিডিপিতে ৬.৩ শতাংশ অবদান রাখছে। এই খাতকে কেন্দ্র করে হরেক রকম নতুন ব্যবসার সৃষ্টি হয়েছে যা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছে। ভবিষ্যতেও আরো রাখবে বলে আমি মনে করি। টু’জি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের টেলিকম কোম্পানিগুলো এখন ফাইভ’জির গতির কথা ভাবছে। এই খাত দেশের সরকারের জন্য এক জরুরি খাতে পরিণত হয়েছে – সরকারের এক সোনার হাঁসে রুপ নিয়েছে। তাই সরকারের উচিৎ নিজের স্বার্থেই এই হাঁসটিকে বাঁচিয়ে রাখা।

সময় আসেছে টেলিকম কোম্পানিগুলোর নিজদের ব্যবসার পরিস্থিতি যাচাই করে দেখা। কেমন ব্যবসা হচ্ছে তাদের? লাভ করছে ক’টি কোম্পানি? আসলে মুনাফা করছে কিনা? সবাই যে মনে করেন তারা বেনিয়াদের মত দেশের মানুষের সব অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে চলে যাচ্ছেন, একথা সত্যি কিনা কেউ একবার ভেবে দেখেছেন? শুধু একটি কোম্পানি ছাড়া আর সবক’টি কোম্পানি বছরের পর বছর লোকসান গুনছেন তা ক’জন জানেন? নিজেদের কেমন করে বাঁচিয়ে রাখছেন সে গল্প ক’জন জানেন? এই কোম্পানিগুলো সম্পর্কে শুধু নেতিবাচক ধারণাগুলোই সমাজে ছড়ানো হয়।

এই কোম্পানিতে বিনিয়োগকারীরা কতটা মুনাফা গেল একুশ বছরে গ্রহণ করতে পেরেছেন, সে ক্ষতিয়ান কে জানছে? তারা প্রায় কিছুই পান নি। যদি ব্যবসায় মুনাফা না হলে তারা এখানে বিনিয়োগ চালিয়ে যাবেন কেন? সব ব্যবসারই লক্ষ থাকে মুনাফা অর্জন। এমন কি আমাদের সরকারি কোম্পানিটিও অনেক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত কোন মুনাফা করতে পারে নি।

বিজ্ঞাপন

এ খাতের ভেতরের অবস্থা একটু দেখে নেয়া যাক।

এদের ব্যবসা করার পথে বাধা অনেক বেশি। তারপরও গেল পাঁচ বছরে নতুন বিনিয়োগ অনেকগুনে বেড়েছে।

থ্রি-জি চালু হলো ২০১৩ সালে। একাজ করতে মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানিরা ৩২,০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে। ব্যবসা করেছে ৭,০০০ কোটি টাকার। বাকি ২৫,০০০ কোটি টাকা কেমন করে, কোথা থেকে আসবে তা কেউ জানে না। আমাদের সবার আচরণ এমন যে, ওরা বিদেশি কোম্পানি, হোক না ক্ষতি; ওদের অনেক অর্থ আছে; ক্ষতি হলে অসুবিধা নেই। বাহ! কি সুন্দর চিন্তা! আসল ব্যপারটি হচ্ছে মুনাফা না হলে এই কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

বিজ্ঞাপন

এলো ফোর-জি। আরো বিনিয়োগ। ফোর-জি’র বাজার তৈরি না হওয়া সত্ত্বেও কোম্পানিগুলোকে বিনিয়োগ করতে হলো, তরঙ্গ কিনতে হলো। বাংলাদেশে রেডিও তরঙ্গের মুল্য অস্বাভাবিক রকম উচ্চ। যে তরঙ্গকে ‘বাতাস’ বলে ভর্ৎসনা করা হয়, সেই বাতাস কিনতে লাখ-লাখ ডলার খরচ করতে হয়। তারপর তা সারা দেশে ছড়িয়ে দেয়া হয় মোবাইল নেটওয়ার্ক টাওয়ারের মাধ্যমে। সারা দেশে ফোর-জি ছড়িয়ে গেছে; এই কোম্পানিগুলোই তা করেছে। কিন্তু খুব বেশি সংখ্যক মানুষ ফোর-জি ব্যবহার করতে পারছেন না এবং কোম্পানিদেরও কোন ব্যবসা হচ্ছে না। ফোর-জি ব্যবহার করতে না পারার সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে হ্যান্ডসেট। ফোর-জি উপযোগী হ্যান্ডসেট বাংলাদেশে একেবারেই কম। এবং যা আছে সেগুলোর দাম অনেক বেশি। কারণগুলো আমরা সবাই জানি কিন্তু সমস্যা দূর করার জন্য তেমন কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না।

মোবাইল নেটওয়ার্ক কোম্পানিদের দোষারোপ করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। ফোর-জি প্রসারণের জন্য তাদের প্রয়োজন সহায়ক নীতিমালা। তা নেই। ‘ফোর-জি চালু হয়েছে, আমরা সবাই ফোর-জি ব্যবহার করতে পারবো’ – এমনটাই ধরে নেয়া হচ্ছে, কিন্তু ব্যবহারের ক্ষেত্র প্রস্তুতে তেমন কিছু করা হচ্ছে না। এমন চলতে থাকলে কোম্পানিগুলো নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণা করতে বাধ্য হবে। একটু ঘাঁটলেই দেখা যায় যে তাদের আর্থিক ক্ষতি তাদের নিজেদের দোষেও না, তাদের সার্ভিস কম বিক্রি হওয়ার কারণেও না। ক্ষতির আসল যায়গা হচ্ছে প্রযুক্তিগত। নিজেদের নতুন প্রযুক্তির দৌড়ে ধরে রাখতেই সব অর্থ খরচ হয়ে যাচ্ছে।

কর্তৃপক্ষের চিন্তা করার সময় এসেছে যে, এই কোম্পানিগুলো দাতব্য সংস্থা নয়, এরা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এরা কর্তৃপক্ষের সোনার হাঁস যে বছরের পর বছর সোনার ডিম পেড়ে চলেছে। এই কোম্পানিগুলো যেন সোনার ডিম পাড়া চালিয়ে যেতে পারে, সে বিষয় সজাগ হওয়ার প্রয়োজন কর্তৃপক্ষের অনুভব করা উচিৎ। প্রশ্ন হচ্ছে- আমাদের নীতিমালা ব্যবসা-বান্ধব কিনা?

একটি সময় ছিল যখন এই কোম্পানিগুলো সব সার্ভিস নিজেরাই দিতে পারতো। সেই কুড়ি বছর আগেকার কথা। তারপর একে একে তাদের হাত-পা সব কেটে ফেলা হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে, ইন্টারকানেকশন এক্সচেঞ্জ, ফাইবার ও টাওয়ার – সব তাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে নতুন নতুন কোম্পানিকে দেয়া হয়েছে। কর্তৃপক্ষের তৈরি নীতিমালার কারণেই এ অবস্থা হয়েছে। নতুন কোম্পানিগুলো কিন্তু খুব ভাল ব্যবসা করছে; কিন্তু মোবাইল ফোন কোম্পানিগুলো পড়েছে বিপদে; তারা আর লাভের মুখ দেখছে না।

বিজ্ঞাপন

টেলিকম এমন একটি ব্যবসা যেখানে সবার ভূমিকা আছে। আইসিএক্স, আইজিডব্লিউ ও এনটিটিএন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকে। বেশিরভাগ সমস্যা হয় বিদ্যুৎ-সঙ্ক্রান্ত অথবা ফাইবার কেটে যাওয়া। এগুলোর ওপর মোবাইল কোম্পানির কোন হাত নেই তবে দোষ তার ঘাড়েই পড়ে। এ সমস্যা সামলানোর জন্য নীতিমালা কোথায়? ফাইবার নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পেলে এ কোম্পানিগুলো গ্রামে-গঞ্জে ইন্টারনেট নিয়ে যেতে পারতো, যা হাজার হাজার আইএসপিরাও পারছে না।

একটু মনোযোগ দিয়ে এ কোম্পানিরগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে এরাই মানুষের জীবন সহজ করতে, সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সার্থক করতে কাজ করেছে সবচেয়ে বেশি। এদের নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেই রাইড-শেয়ারিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ই-কমার্স ও ওটিটি অ্যাপ’গুলোর ব্যবসা চলছে। এসব ব্যবসায় আমরা মোবাইল কোম্পানিদের যোগ দিতে বাধা দিচ্ছি কেন?

এ কোম্পানিগুলোকে আমরা যদি শুধুই সংযোগ স্থাপনকারী হিসেবেই ভাবি তাহলে এরা ব্যবসা করতে পারবে না। যদি এরা শুধুই সংযোগ স্থাপনকারীই হয়, তাহলে তাদের জন্য খুব ভেবে-চিন্তে তরঙ্গ নীতিমালা তৈরি কর দেই। সল্পমূল্যে তরঙ্গ কিনতে পারলে এরা কিছুটা মুনাফা করতে পারতো বলে আমার মনে হয়।

কেবলতো আমরা ফোর-জি পর্যন্ত এসেছি; আরো অনেক অনেক দূর যেতে হবে। ইন্টারনেট অব থিংস আসবে, স্মার্ট শহর, বাড়ি, কারখানা – সব কেবল আসতে শুরু করেছে। ইন্টারনেট অব থিংস ও বিগ ড্যাটার সেবা দিতে হলে তরঙ্গের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ব্যবসা-বান্ধব নীতিমালা না হলে এ খাত তেমন এগুতে পারবে না। কর্তৃপক্ষকে শুধুই শাষকের ভূমিকা নিলে চলবে না, সাহায্যকারীও হতে হবে। মনে রাখতে হবে এই টেলকম খাত আমাদের সোনার হাঁস; হাঁসটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে; না হলে সোনার ডিম আর পাওয়া যাবে না।

ইকরাম কবীর: গল্পকার।

সারাবাংলা/এমএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন