বিজ্ঞাপন

ড্রাইভিং সিটে নারী- ‘মাইয়া মানুষ গাড়ি চালাইবো ক্যান?’  

July 3, 2018 | 1:12 pm

মারজিয়া প্রভা।।

বিজ্ঞাপন

কানিজ দিয়া একজন চাকরিজীবী নারী। পাশাপাশি পড়াশুনাও করছেন। প্রতিদিন গাড়ি চালিয়ে তিনি যাতায়াত করেন। ঢাকার রাস্তায় তাকে কম ঝামেলা পোহাতে হয় না! বেশিরভাগ সময়ে পাশের গাড়ি যখন চালকের আসনে একটি মেয়েকে দেখে, তখন হুট করে সিগনাল না দিয়ে ঘুরিয়ে দেয় অথবা থামিয়ে ফেলে। ইচ্ছা করেই যেন সাইড চাপিয়ে ড্রেনে ফেলে দিতে চায়। কানিজকে একদিন গাড়ি চালাতে দেখে একজন রিকশাওয়ালা বিজ্ঞ মতামত দিয়েছিলেন যে, “মাইয়া মানুষ গাড়ি চালালে রাস্তায় তো জ্যাম বাঁধবেই!”

বাংলাদেশে নারীরা ড্রাইভিং করছেন বিষয়টি নতুন নয় একেবারেই। বহু আগে থেকে মেয়েরা স্টিয়ারিং হাতে নিয়েছেন। কিন্তু সংখ্যাটা এখনো ভীষণ কম। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির মতে, তাদের মোট ড্রাইভিং লাইন্সেস গ্রহীতার ১% হচ্ছে নারীরা। ট্রাফিক জোন- শাহবাগ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, এদেশে প্রতিদিন যত গাড়ি চলে তার ০.৫% চালক হচ্ছেন নারী। তবে বাংলাদেশের ডাক বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন এবং এনজিওগুলোতে বহু নারী ড্রাইভার রয়েছেন।

কিন্তু আমাদের সমাজের চোখ এখনো সয়ে উঠতে পারেনি ড্রাইভিং সিটে নারীকে। আমাদের মাইন্ডসেট এখনো এভাবে তৈরি হয়ে আছে যে, “মেয়ে মানুষ গাড়ি চালাতে পারে না” কিংবা “ভালো মেয়েরা গাড়ি চালায় না”!

বিজ্ঞাপন

গাড়ি চালানোর মাঝে রয়েছে এক উদ্দামতা, স্বাধীনতার বহিঃপ্রকাশ। যেন “স্টিয়ারিং আমার হাতে, আমি চলে যেতে পারি বহুদূর”। আমাদের সমাজ প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেনি নারীর এই বহুদূর চলে যেতে পারার স্বাধীনতায়। তাই এখনো গাড়ি চালানোটা ‘পুরুষমানুষের কাজ’ই হয়ে রয়ে গেছে!

সংযোগ বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক সাদিয়া নাসরিনের সাথে এদেশের নারীর ড্রাইভিং নিয়ে কথা হচ্ছিল। প্রায় তিনবছর ধরে সাদিয়া ঢাকার পথে নিয়মিত গাড়ি চালিয়ে অফিসে যান। তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, বহুবার ইচ্ছে করে তার গাড়িকে সাইডে চাপ দেওয়া হয়েছে। ইচ্ছে করে পিছনের গাড়ি ভুল লেনে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। বনানীতে একবার এক পুলিশের গাড়ি তার গাড়িতে লাগিয়ে দিয়েছিল। বনানী থানার কাছে সাদিয়া ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন। তাঁর ভাষ্যমতে, তিনিই সম্ভবত সেই নারী যিনি পুলিশের কাছ থেকে গাড়ির ক্ষতিপূরণ নিতে পেরেছেন।

বিজ্ঞাপন

 

সাদিয়া বলেন, সবচেয়ে মজা হয় গাড়ি পার্ক করার সময়ে। তিন বছরের ড্রাইভিং জীবনে প্রায়শ তিনি পার্কিং এর সময় অন্য ড্রাইভার বা প্রহরীদের কাছে শুনে আসছেন, “আপা পার্কিংটা আমি করে দেই, আপনি পারবেন না”। তাদের চোখেমুখে এই অভিব্যাক্তি থাকে যে, “মেয়ে মানুষ কোনমতে গাড়ি চালিয়েছে এই বেশ, পার্কিং ভালোমতো করতে পারবে না!” সাদিয়া জানান, পার্কিং করাতে তিনি ভীষণ পারদর্শী। খুব ছোট জায়গাতেও তিনি দারুণ দক্ষতার সাথে পার্কিং করতে পারেন।  এমনকি যখন তাঁর বন্ধু কিংবা পার্টনার গাড়ি চালান, তখনো পার্কিং এর দায়িত্ব দেওয়া হয় সাদিয়াকে।

জেন্ডারে নারী বলে কেবল ড্রাইভিং পেশা কতটা বিপদজ্জনক হতে পারে সেটা আমরা জানতে পেরেছিলাম সাদিয়ার মুখেই। “আমি যখন আমার তৃতীয় অফিসে কাজ করছি, তখন আমার অফিসের গাড়ির ড্রাইভার ছিল সেতু নামের একটি মেয়ে। আমি তখনো গাড়ি চালানো শিখিনি। সেতুকে দেখেই আমি প্রথম উৎসাহ পাই। তো সেতু যখন রাতে গাড়ি চালাতো যেকোনো পোশাকের সঙ্গেই সবসময় বেল্ট দিয়ে প্যান্ট পরে থাকতো! তো একদিন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেন তুমি প্যান্ট পরে গাড়ি চালাও! সালওয়ার পরে চালাও না?

সেতু বলেছিলেন, তিনি যখন রাতে তেল নিতে থামেন, তখন কেউ যদি তাকে হ্যারাজ করতে চায়, সেটি প্রতিরোধ করতেই তিনি বেল্ট দিয়ে প্যান্ট পরেন। শুধু নারী ড্রাইভার বলেই সেতুকে সেইসময়ে এই সাবধানতা নিতে করতে হয়েছিল। পুরুষ ড্রাইভারের জন্য রাত কিংবা দিনের ড্রাইভিংয়ে এই সাবধানতার প্রয়োজন হয় না কখনোই।

বিজ্ঞাপন

আমরা বলতে পারি চাকুরিজীবী সামান্থার কথা। যিনি অফিসে গাড়ি চালিয়ে যান বলে অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ অফিসের ড্রাইভার সবার মাঝেই বিদ্রূপ দৃষ্টি দেখতে পান। তিনি যখন অফিস থেকে বের হন গাড়ি নিয়ে, একই সাথে অফিসের গাড়িও বের হয়। অফিসের গাড়ি যদি সামান্থার গাড়ির পেছনে থাকে, তবে তো কোন কথাই নেই! পাগলের মতো হর্ন দিতেই থাকে! অথচ কোন পুরুষকর্মীর গাড়ির পেছনে থাকলেও অফিসের গাড়ি এই অতিরিক্ত হর্ন কখনোই বাজায় না। পরোক্ষভাবে হলেও, শুধু নারী বলেই সামান্থা নিজের গাড়ি নিজে চালানোর জন্য এই অহেতুক হয়রানির সম্মুখীন হন।

কিন্তু কেন আসলে সমাজ নারীকে স্টিয়ারিং হাতে মেনে নিতে পারে না? কেন উল্টা হয়রানি করে? এই বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডঃ সেলিনা আহমেদের কাছে। সেলিনা আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে পুরুষদের পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা মেয়েদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। মেয়েদের গাড়ি চালানোটা তাদের কাছে নিয়ন্ত্রণহীনতা মনে হয়। মানে কোন একজন নারী গাড়ি চালাতে পারে মানে সে যে কোনো জায়গায় যেতে পারার অধিকার রাখে। এই যে নিজ সিদ্ধান্তে নারী কোথাও যাচ্ছে, এই জিনিসটা পুরুষতান্ত্রিক মাইন্ডসেট নিতে পারে না। মেয়েদের কোন রকম স্বাধীনতা দেওয়া হবে না এইটাই তো পুরুষতন্ত্র আজীবন চেয়ে এসেছে।

এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে, নারী যদি নিজে গাড়ি চালান তার মধ্যে আমরা একটি আভিজাত্যও খুঁজে পাই। তার হিম্মতের প্রশংসা করি। নারীটির “গাটস” আছে বলে রায় দেই! কিন্তু পেশায় একজন নারীকে কিন্তু আমরা ড্রাইভিং এ দেখতে চাই না।

আদাবরের উত্তরবঙ্গ ড্রাইভিং স্কুল ১০ বছরের বেশি সময় ধরে ড্রাইভিংয়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। গত ১০ বছরে নারী প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে। এখন মোট প্রশিক্ষণার্থীর ৪০ ভাগই নারী। অথচ এই নারীদের প্রশিক্ষণ দেন পুরুষ ড্রাইভাররাই। অর্থাৎ নারী ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ নিলেও সেটা তারা পেশা হিসেবে কাজে লাগাতে পারেন না। এমনকি আধুনিক ড্রাইভিং অ্যাপ উবার এও নারী চালিত গাড়ির খোঁজ পাওয়া যায় না।

অর্থাৎ নারীর ক্ষেত্রে আভিজাত্যের হিসেবে গাড়ি ড্রাইভিং মেনে নিলেও, পেশার খাতিরে সমাজ ড্রাইভিংকে কোনভাবেই মেনে নিতে চায় না!

 

এই প্রসঙ্গে ডঃ সেলিনা আহমেদ বলে, সমাজ ঠিক করেই রেখেছে কোন পেশাটা নারীর জন্য, কোন পেশাটা নারীর জন্য না। যেমন সমাজ মনে করে শিক্ষকতা, চিকিৎসা সেবা দেওয়া প্রভৃতি পেশা নারীর জন্য। এর কারণ হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় মেয়েদেরকে দুর্বল ভাবা হয়। ড্রাইভিং এর মতো শক্ত কাজ মেয়েরা পারবে না এইটাই এই সমাজ বিশ্বাস করে। তাছাড়া কোন পুরুষ হয়ে আমি যদি কোন নারীর গাড়িতে উঠি সেক্ষেত্রে আমার মনে সবার আগে প্রশ্ন আসবে, “মহিলা পারবে তো?” দূর পাল্লার যাত্রায় মেয়েদেরকে সেফ গার্ড করে নিয়ে যাবার প্রবণতা আছে এই সমাজের। সেখানে নিজেদের সেফ গার্ডের দায়িত্ব যে নারীকে দেবে না, এইটাই স্বাভাবিক।

তবে নারী ড্রাইভিংয়ের সব অভিজ্ঞতা যে একেবারে খারাপ, তাও নয়। সাদিয়া নাসরিনের কাছ থেকে জানা যায়, তিনি যখন গাড়ি চালান, বহু স্কুল কলেজগামী মেয়েদের চোখে অদ্ভুত এক ঝিলিক দেখেছেন তিনি।  একবার রাস্তায় গাড়ি পাংচার হয়ে গেলে এক নারী নিজে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দেয়, “আপা কোন হেল্প করব”! এই অভিজ্ঞতাগুলোই সাদিয়া নাসরিনকে ড্রাইভিংয়ে আরও উৎসাহী করে।

এই সময়ে নারী ড্রাইভিংয়ের একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা চিহ্নিত করেছেন ট্রাফিক জোন শাহবাগের সার্জেন্ট শফিক। তিনি জানান, সম্প্রতি যত লাইসেন্সজনিত মামলা হয়েছে তার ৫০ ভাগ নারী ড্রাইভার। নারীরা বেশি বেশি ড্রাইভিংয়ে আসবেন এই বিষয়কে সাধুবাদ জানিয়ে তারা অনুরোধ করেন যে, নারী ড্রাইভাররা যেন বিআরটিএ থেকে সঠিক লাইসেন্স নিয়ে এসেই রাস্তায় নামেন।

পাশের দেশ ভারতে এরইমধ্যে বহু নারী ড্রাইভিং পেশায় নিয়োজিত হয়েছে। সংখ্যায় অল্প হলেও, আমাদের দেশের নারীরা সমাজের চোখরাঙ্গানি ও বিদ্রূপ উপেক্ষা করে গাড়ি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। ইতিবাচক এই ঘটনা আমাদের জানান দেয়, হয়ত আগামী দশ বছরের মধ্যে ড্রাইভিং পেশায় নারী নিজের জায়গা করে নেবে। কিন্তু এই কার্যক্রম একদিনে কোন মতেই সম্ভব হবে না।

এই প্রসঙ্গে ডঃ সেলিনা আহমেদ দৃঢ় কণ্ঠে জানান, এই কাজটা নারীদেরই করতে হবে। তাদের বেশি বেশি গাড়ি চালানোই কেবল অভ্যস্ত করতে পারে এই সমাজের চোখকে।

নিজ অভিজ্ঞতা থেকে সেলিনা আহমেদ জানান, সাতক্ষীরার প্রত্যন্ত এক গ্রামে যখন এনজিও’র ট্রেইনিংয়ে মেয়েরা বাইক চালিয়েছিল তখন সারা গ্রামে হাসাহাসি পড়ে গিয়েছিল। আজ সেই উপজেলায় মেয়েরা বাইক চালিয়ে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়ায়। তিনবছর হয়ে গেছে, গ্রাম মেনে নিয়েছে মেয়েদের সেই স্বতঃস্ফূর্ত বাইক চালানোকে।

তাই মেয়েরা নিজেরা যত ড্রাইভিং শিখবে, নিজেদের হাতে থাকা স্টিয়ারিং দিয়ে রাজপথ রাজত্ব করবে, ততই সমাজ অভ্যস্ত হয়ে উঠবে নারীর ড্রাইভিংয়ে। সেদিন আর খুব বেশি দূরে নয়, যেদিন স্টিয়ারিং হাতে নারীকে দেখলেই সমাজ চোখরাঙানী দেবে না। নারী নির্দ্বিধায় পেশা হিসেবে বেছে নিবে ড্রাইভিংকে। সেদিন হয়ত এই বিষয়ক কোন প্রতিবেদন লেখারও আর প্রয়োজন হবে না।

 

 

ফিচার ফটো মডেল- মুন্নী আরা শামীম

সারাবাংলা/এসএস

 

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন