বিজ্ঞাপন

দেনমোহর- অজ্ঞতা যখন নারীর অধিকারের অন্তরায়!

November 27, 2017 | 1:11 pm

নাহিদ শামস্

বিজ্ঞাপন

দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের একটি মানবাধিকার সংস্থায় কাজের সূত্রে নানাধরনের মানুষের কাছে আসার সুযোগ হয় আমার। সংস্পর্শে আসি অসংখ্য নির্যাতিত নারীর, যাদেরকে অবহেলিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত আর অসহায় বললেও কম বলা হয়। এসব নারীর পাশে দাঁড়িয়ে তাদের সমস্যার সমাধান করতে পেরে আমি আজও গর্ব অনুভব করি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল এই নারীরা তাদের আইনগত অধিকার নিয়ে একদমই অজ্ঞ। আর শুধুমাত্র এই অজ্ঞতার কারনেই তারা আজীবন নির্যাতন আর নিপীড়নের শিকার হয়।

আমার অভিজ্ঞতা বলে, এই অজ্ঞতা শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সব শ্রেনীর মাঝেই বিদ্যমান। দেনমোহর, ভরণপোষণ, সন্তানের অভিভাবকত্ব, তালাকের পর নারীর  অধিকার এমনি অনেকগুলো বিষয় নিয়ে কাজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। আজ আমাদের আলোচনার বিষয় দেনমোহর। এই লেখায় আমি কিছু নারীর জীবনের দেনমোহরসংক্রান্ত ঝামেলার কথা জানাব এবং সেই সাথে পারিবারিক আইনে দেনমোহরের অবস্থান ও অন্যান্য বিষয়ও আমার আলোচনায় আসবে।

বিভিন্ন বাড়িতে ঠিকা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করে দুই সন্তানের জননী রত্না (ছদ্মনাম)। তার রিকশাচালক স্বামী প্রতিরাতে নেশা করে এসে স্ত্রীর উপর অমানুষিক শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। এতকিছুর পরেও রত্না সংসার করতে চায় কিন্তু সে তার অধিকার নিয়ে একদমই অজ্ঞ। তার ধারণা এক্ষেত্রে তাকে সাহায্য করার মতো কোন আইন নেই। সংসার ভাঙলে বা তালাক দিলে সে কিছুই পাবেনা। দুই সন্তানের বোঝা, স্বামীর ভালবাসা হারানোর ভয়ও তাকে পেয়ে বসে। রত্না যখন আমাকে জানায় যে তার বিয়েতে কাবিন হয়েছে, তখন কাবিন নামায় উল্লেখিত মোহরানার বিষয়টি তাকে বুঝিয়ে বলি। তখন রত্না মোহরানাসহ তালাক চাওয়ার সাহস অর্জন করে।এরপর তাদের দুজনকে নিয়ে সালিশে বসা হলে তার স্বামী সংসার করবেনা বলে জানায় এবং দ্বিতীয় বিয়েতে আগ্রহ প্রকাশ করে। রত্নার স্বামীকে মোহরানা প্রদানের প্রস্তাব দিলে সে বিষয়টিকে তাচ্ছিল্লের সঙ্গে উড়িয়ে দেয়। কিন্তু এক পর্যায়ে আমি তাকে বোঝাতে সক্ষম হই মোহরানা রত্নার আইনগত অধিকার। সালিশ সমঝোতার পরে রত্না তার পুরো মোহরানা পেয়ে যায় এবং তালাক হয়।

বিজ্ঞাপন

এখন বলি দেনমোহর বিষয়ক কিছু আইন সম্পর্কে।

# মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে দেনমোহর বিয়ের একটি অন্যতম শর্ত। দেনমোহর স্বামী কতৃক স্ত্রীকে পরিশোধযোগ্য একটি আইনগত দায়।

# সাধারণত দেনমোহর দুই প্রকার। তাৎক্ষনিক দেনমোহর এবং বিলম্বিত দেনমোহর। দেনমোহর স্ত্রী চাওয়ামাত্র পরিশোধ করতে হয়। বিলম্বিত দেনমোহর বিয়ের পর যে কোন সময় পরিশোধ করা যায় তবে মৃত্যু বা বিয়ে বিচ্ছেদের পর দেনমোহর অবশ্যই পরিশোধ করতে হয়। তখন দেনমোহর স্ত্রীর কাছে স্বামীর ঋণ হিসাবে গণ্য হয়।

বিজ্ঞাপন

# স্বামীর মৃত্যুর আগে স্ত্রী যেকোন সময় স্বামীর কাছে দেনমোহর দাবী করতে পারে। কেননা স্বামীর কাছে এটি স্ত্রীর পাওনা। তাছাড়া, দেনমোহর হলো বিয়ের শর্ত যার সাথে তালাকের কোন সম্পর্ক নেই। বিয়ে বহাল থাকা বা বিচ্ছেদের সাথেও দেনমোহরের কোন সম্পর্ক নেই। বিবাহ সম্পন্ন হলেই উল্লেখিত দেনমোহর স্ত্রীর আইনানুগ পাওনায় পরিণত হয়। তালাক বা মৃত্যুর সাথে এটির কোন সম্পর্ক নেই।

# স্বামীর আয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে দেনমোহর নির্ধারন করতে হয়। দেনমোহরের পরিমান নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে স্ত্রীর পারিবারিক অবস্থান এবং আর্থিক সামর্থ্যও বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন।

# দেনমোহর এত বেশী হওয়া উচিৎ নয় যা স্বামীর পক্ষে পরিশোধ করা সম্ভব নয়। আবার এত কম হওয়াও উচিৎ নয় যা স্ত্রীর আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারে না।

# দেনমোহর পরিশোধ না করা পর্যন্ত স্ত্রীর দেনমোহর পাবার অধিকার বহাল থাকবে। প্রয়োজনে স্বামীর সম্পত্তি থেকে স্ত্রী তা আদায় করে নিতে পারবেন।

বিজ্ঞাপন

# ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এর ধারা ১০ অনুসারে, যে কাবিন নামায় তাৎক্ষণিক ও বিলম্বিত দেনমোহরের পরিমান উল্লেখ নেই সেক্ষেত্রে দেনমোহরের সম্পূর্ণ অংশ তাৎক্ষণিকভাবে আদায়যোগ্য বলে ধরে নেয়া হবে।

 

এবার বলি আরেকটি ঘটনার কথা। দারুণ স্মার্ট আর শিক্ষিত নুসরাত (ছদ্মনাম) মিডিয়ায় কাজ করে। চার বছর প্রেমের পর বিয়ে করে সে বিদেশ থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আসা রাহাতকে। নুসরাত তার পরিবারের কাছে রাহাতকে সম্মানের জায়গায় রাখতে চায় তাই বিয়ের সময় রাহাতের দেয়া উপহার এবং উপঢৌকনকে দেনমোহর বলে মেনে নেয়। কাবিননামার ১৪ নং কলামে মোহরানা নির্ধারিত না করেই বিয়ে সম্পন্ন হয়। এক সময় নুসরাত এবং রাহাতের দীর্ঘ বিবাহিত জীবনের সমাপ্তি টানার প্রশ্ন আসে এবং তখন  মোহরানার বিষয়টি সামনে চলে আসে। কিন্তু নুসরাতের কাবিন নামায় মোহরানার কোন উল্লেখ না থাকায় সে মোহরানা থেকে সম্পূর্নভাবে বঞ্চিত হয়।  উপরোল্লিখিত ঘটনার সূত্র ধরে তাই বলা যায় যে, আইনে উল্লেখ আছে অনেক ক্ষেত্রে বিয়ের সময় গয়না, শাড়ি ইত্যাদির মূল্য দেনমোহরের একটি অংশ ধরে নিয়ে ‘উসুল’ লিখে দেয়। আসলে বিয়েতে দেয়া উপহার বা উপঢৌকন দেনমোহর নয়। এগুলোকে দেনমোহরের অংশ বলে ধরা যাবে না এবং উসুলও বলা যাবে না।

অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় কাবিনে উল্লেখিত দেনমোহরের অংশটি পরিশোধ না করেই উসুল লিখে দেয়া হয়। বিষয়টি মেয়ের পরিবার লক্ষ্য করেনা বা এক্ষেত্রে তাদের অজ্ঞতাও একটি বড় কারন। পরবর্তীতে মোহরানা আদায়ের প্রশ্ন আসলে কাবিনে ‘উসুল’ লেখা থাকার কারনে নারী তার প্রাপ্য দেনমোহর থেকে বঞ্চিত হন। যদি স্ত্রী দেনমোহর দাবি করে এবং স্বামী তা পরিশোধ না করে তবে স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিতে পারে স্বামীর কাছে থেকে পৃথক বাস করার এবং পৃথক বাসের সময় স্ত্রীর ভরণপোষণ দিতে স্বামী বাধ্য থাকবে।  পরিবারিক আদালত অধ্যাদেশ- ১৯৮৫ এর ধারা ৫ অনুযায়ী বিবাহ বিচ্ছেদ, দাম্পত্য অধিকার পুনরুদ্ধার, দেনমোহর, ভরণপোষণ ও সন্তানের অভিভাবকত্বের প্রশ্নে উত্থাপিত বিষয়গুলো পারিবারিক আদালতের এখতিয়ারাধীন। দেনমোহর সংক্রান্ত মামলা স্থানীয় সহকারি জজ আদালত, পারিবারিক আদালত নামে পরিচিত এবং সেখানেই এই মামলা দায়ের করা যায়।  পারিবারিক আদালতে অপরিশোধিত দেনমোহরে জন্য স্ত্রী এবং তার (স্ত্রীর) মৃত্যুর পর সন্তানের উত্তরাধিকারীরাও দেনমোহর আদায়ের জন্য মামলা করতে পারে।

# তামাদি আইন ১৯০৮ এর তফসিল-১ অনুচ্ছেদ-১০৩ অনুযায়ী তাৎক্ষনিক দেনমোহরের ক্ষেত্রে দাবি করে প্রত্যখ্যাত হওয়ার তারিখ থেকে তিন বছর পর্যন্ত তামাদির সময়সীমা। এ সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে।

# যদি দেনমোহর দাবি করা না হয় তবে তালাক অথবা মৃত্যুর মাধ্যমে বিচ্ছেদের তারিখ থেকে তিন বছর পর্যন্ত সময়ের মধ্যে মামলা দায়ের করতে হবে। পারিবারিক মামলায় দীর্ঘসূত্রিতা একটি বড় বিষয়। এই কারনে শুধুমাত্র দেনমোহর আদায়ের জন্য আদালতের দারস্থ হতে চায় না অনেক নারী। এক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশের অনেক মানবাধিকার সংস্থা পারিবারিক আইন নিয়ে কাজ করছে। তারা সালিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারীদের দেনমোহর আদায়ের বিষয়টি অনেক সহজ করে দিচ্ছে।

একজন তালাকপ্রাপ্তা নারী বা তালাক চায় এমন নারী মানবাধিকার সংস্থার দারস্থ হলে সংস্থার আইনজীবীরা তাদের নিজস্ব প্রক্রিয়ায় উভয় পক্ষকে ডেকে আলোচনার মাধ্যমে নারীর কাবিন নামায় নির্ধারিত দেনমোহর অতি দ্রুত সময়ের মধ্যে আদায়ের পদ্ধতিটি অনুসরন করছে যা স্বল্প সময়ের মধ্যে আদালতের ভোগান্তি ছাড়া একজন নারীকে তার প্রাপ্য দেনমোহর আদায় করতে সহায়তা করছে।

দেনমোহর মূলত স্ত্রীর অধিকার সংরক্ষণ এবং তার অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য দেয়া হয়। প্রত্যেক নারীকে অবগত থাকতে হবে বিবাহের কাবিন নামায় মোহরানার বিষয়টি যেন সুনির্দিষ্ট থাকে। দেনমোহরের কোন সুনির্দিষ্ট পরিমান নেই। তবে মোহরানা যেটুকু দেয়া হোকনা কেন মোহরানা আদায়ের অধিকারটিতে প্রত্যেক নারীর সচেতন হওয়া উচিৎ।

তালাকের পর মোহরানা একজন নারীর আইনগত অধিকারের পাশাপাশি সিকিউরিটি মানি হিসেবে নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগানোর অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। মানবাধিকার সংস্থায় কাজের সূত্রে জেনেছি প্রাপ্ত মোহরানা নিয়ে অনেক নারী সাবলম্বী হয়েছে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাই মোহরানা প্রাপ্তি নারীর অধিকার। এটিকে কোন অবস্থাতেই অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই।

নাহিদ শামস্, আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী

 

 

ছবি : ইন্টারনেট থেকে

সারাবাংলা/এনএস/এসএস

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন