বিজ্ঞাপন

দেশি পোশাকের বিক্রি বাড়ছে, ভাল করছে ফ্যাশন হাউজগুলো- শাহীন আহমেদ

April 10, 2018 | 4:36 pm

ছিমছাম অফিসঘরের ঠিক মাঝ বরাবর সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা কাঠের টেবিল। ঘরটির চারপাশে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখা কাজের জিনিসপত্র। একপাশের দেওয়ালের র‍্যাকে সাজানো নানা সময়ে প্রাপ্ত পুরষ্কারের সারি। ঘরের গোছানো ভাবটাই বলে দেয় এই অফিসকক্ষটি যিনি ব্যবহার করেন, মানুষ হিসেবেও তিনি নিশ্চয় ভীষণ পারফেকশনিস্ট। বলছি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউজ অঞ্জনসের কর্ণধার শাহীন আহমেদের কথা।

বিজ্ঞাপন

যা ভাবা হয়েছিল ঠিক তাই। কাজের মতই কথাও বলেন অসম্ভব গুছিয়ে। ছিমছাম এই মানুষটির পরনে অঞ্জনসের বৈশাখ উপলক্ষে করা সাদার সাথে লালের মিশ্রণে ডিজাইন করা ফতুয়া।   

পহেলা বৈশাখ কড়া নাড়ছে দুয়ারে। বৈশাখকে ঘিরে ফ্যাশন হাউজগুলোর কাজের তাই বিরাম নেই। কারণ, দুই ঈদের পরে পহেলা বৈশাখই এখন বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব। এই উৎসব উপলক্ষে মানুষ শুধু নতুন কাপড়ই কেনেনা, কেনে তৈজসপত্র থেকে শুরু করে গৃহসজ্জার নানা উপকরণ। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ফ্যাশন হাউজ অঞ্জনসের কর্ণধার শাহীন আহমেদেরও তাই ব্যস্ততার সীমা নেই। তবু ব্যস্ত শিডিউলের মাঝে সারাংলাকে কিছুটা সময় দিলেন শাহীন আহমেদ।

শাহীন আহমেদের সাথে কথোপকথনে উঠে এসেছে অঞ্জনস শুরু করার অনুপ্রেরণার কথা, আসন্ন বৈশাখ ঘিরে অঞ্জনসের আয়োজন, দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান অবস্থান, নিজের ফ্যাশন হাউজ ছাড়াও দেশীয় ফ্যাশনের ভবিষ্যৎ; সর্বোপরি ব্যক্তি শাহীন আহমেদের নানা ভালো লাগা না লাগার কথা।

বিজ্ঞাপন

১৯৯৪ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী সিদ্ধেশ্বরীতে যাত্রা শুরু করে ফ্যাশন হাউজ অঞ্জনস। ১৯৯৮ সালে ধানমন্ডিতে চালু হয় এই ফ্যাশন হাউজের দ্বিতীয় শাখা। বর্তমানে ঢাকাসহ দেশজুড়ে অঞ্জনসের মোট ২৩ টি শো-রুম রয়েছে। শুরু থেকেই এদেশীয় কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরছে এই বুটিক হাউজটি।

স্বনামধন্য ফ্যাশন ডিজাইনার শাহীন আহমেদের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন রাজনীন ফারজানা।

 

বিজ্ঞাপন

 

অঞ্জনসের শুরুর গল্পটা জানতে চাই।

শাহীন আহমেদ: ফ্যাশন হাউজ অঞ্জনস কীভাবে শুরু করলাম তা নিয়ে এত কথা বলেছি গত বিশ বছরে যে সেটা নিয়ে আর বলতে চাই না। আমরা বরং বর্তমান প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা বলি।

বিজ্ঞাপন

ঠিক আছে আমরা তাহলে বুটিক হাউজ শুরু করার পেছনে আপনার অনুপ্রেরণার গল্পটা একটু শুনি।

শাহীন আহমেদ: ব্যক্তিগত ভালোলাগা থেকেই মূলত ফ্যাশন বিজনেসে আসা। আপনারা জানেন, বাংলাদেশে সবসময়ই বিদেশি জিনিসের প্রতি আমাদের আগ্রহ বেশি ছিল; আসলে সেটা এখনও আছে। আমরা যখন শুরু করি তখন বাজারে বেশিরভাগ জিনিসই আসত বিদেশ থেকে; ছেলেদের পোশাক, মেয়েদের পোশাক। তখন মনে হত আমরা নিজেরাও তো দেশীয় পোশাক দিয়েই বাজারের চাহিদা পূরণ করতে পারি। যদিও অল্পকিছু ফ্যাশন হাউজ তখনও ছিল যেমন আড়ং, নিপুন যারা দেশীয় পোশাক নিয়ে কাজ করত। দেশীয় পোশাকের প্রতি ভালোলাগা থেকেই আমি অঞ্জনস শুরু করি।

আর ওই সময়টার কথা যদি বলি, ১৯৯৮ থেকে ২০০২-০৩ পর্যন্ত অনেক ফ্যাশন প্রতিযোগিতা হত। সাপ্তাহিক ২০০০, বিচিত্রা, পাক্ষিক অন্যদিনের মত  নিয়মিত এসব প্রতিযোগিতা আয়োজন করত। আমরা এসব প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম আর ভাবতাম কীভাবে সবচাইতে ভালো করতে পারব, প্রতিযোগিতায় প্রথম বা চ্যাম্পিয়ন হতে পারব। এসব প্রতিযোগিতাকে কেন্দ্র করে আমি নিজে আর আমার অঞ্জন্সের গ্রুপ প্রচুর কাজ করেছি তখন। সেই কাজের ফলশ্রুতিতেই বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়ের মাঝে থাকতাম।

২০০২ সালে ‘সাপ্তাহিক ২০০০’ আয়োজিত ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় আমরা ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য ইয়ার’ হই। এরপর ২০০৩ সালে ‘পাক্ষিক অন্যদিন’ প্রথমবারের মত ‘বেস্ট ফ্যাশন হাউজ’ পুরষ্কার চালু করে। এর আগে ওরা শুধুমাত্র প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পুরষ্কার দিত। সেবারই প্রথম সবগুলো বিভাগ মিলিয়ে যে হাউজ সবচেয়ে বেশি পয়েন্ট পাবে, সে বেস্ট ফ্যাশন হাউজ হবে এমন সিদ্ধান্ত নেয়। সেবার আমরা ‘বেস্ট ফ্যাশন হাউজ ২০০৩’ হই।

তাই বলব, শুরুর দিকে যে ভালোলাগা কাজ করেছে তা যে শুধুমাত্র ব্যাবসা ঘিরে, তা নয়। দু’রকম ভালোলাগা কাজ করত। প্রথমত, এসব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহন করে পুরষ্কৃত হতাম সেটা। আর দ্বিতীয়ত, রাস্তায় বেরিয়ে নিজের ডিজাইনার হাউজের পোশাক পরা কাউকে দেখলে মন ভরে উঠত। আরও বেশি কাজ করার অনুপ্রেরণা পেতাম।

অঞ্জনসের আজকের এই অবস্থানে আসার পেছনে যে বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিয়েছি তা হল, গুণগত মান, ডিজাইন ও সার্ভিস। আমরা সবসময়ই চেষ্টা করেছি পোশাক ডিজাইনে বৈচিত্র ধরে রাখতে। কারণ পোশাক কেনার সময় ক্রেতা নিজে পছন্দ করে না। কেনার আগে সাথে আসা অন্যদের মতামত নেয়। আবার অনেকসময় বাসায় গিয়ে ভালো না লাগলেও পাল্টাতে চায়। এসব বিষয় মাথায় রাখি আমরা।

অন্যদিকে, আমাদের যে কোন ভুল হয়না, তেমন নয়। বারবার করে গুণগত মান পরীক্ষা করার পরও অনেকসময় অনেক পোশাকে সমস্যা থেকে যেতে পারে। তখন কোন ক্রেতা সেই পোশাকটি নিয়ে আসলে আমরা বদলে দেই বা অনেকসময় ফেরতও নেই। এভাবেই আমরা আমাদের ক্রেতাদের জন্য উন্নত সার্ভিস দিতে চেষ্টা করি। এই তিনটা বিষয় আমাদের হাউজকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। আর আমরা এখনও এসব বিষয়ে ঠিক আগের মতই যত্নবান থাকতে বদ্ধ পরিকর।

পোশাক ডিজাইন করার সময় কোন কোন বিষয় মাথায় রাখেন?

শাহীন আহমেদ: পোশাক ডিজাইন করার সময় বেশ কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হয়। প্রথমেই হচ্ছে সময়। বছরের কোন সময় বা উপলক্ষকে সামনে রেখে পোশাক ডিজাইন করছি সেটা মাথায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ। উৎসব অনুযায়ী পোশাকের ডিজাইনে তারতম্য হয়।

দ্বিতীয়ত, পোশাকের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ হল পোশাকটি পরে আরামবোধ করা। আর পোশাকটি আরামদায়ক তখনই হবে যখন সেটা পরে আপনি নিজেকে নিয়ে সন্তষ্ট থাকবেন, কনফিডেন্ট ফিল করবেন। ট্রেন্ডি পোশাকের ক্ষেত্রেও আরামই প্রধান। বাংলাদেশের যে আবহাওয়া সেখানে বছরের বেশিরভাগ সময়  গরম থাকে। গরমপ্রধান আবহাওয়ায় সুতি কাপড় বেশি আরামদায়ক। তাই আরামদায়ক ফেব্রিক দিয়ে পোশাক ডিজাইন করা হয় বেশি।

ডিজাইন করার সময় ক্রেতার ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টাও মাথায় রাখি আমরা। আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হচ্ছে দিন দিন, ক্রেতাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ছে।

 

পোশাক ডিজাইন করার ক্ষেত্রে দেশীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য কতটা প্রভাবিত করেছে?

শাহীন আহমেদ: আসলে জাতীয় সব আন্দোলনই আমাকে সবসময়ই প্রভাবিত করেছে। আমাদের গর্ব করার মত যেসব ইতিহাস যেমন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস এসব আমাকে আন্দোলিত করে। তাই পোশাক ডিজাইনেও জাতীয় দিবস এবং আন্দোলনগুলো বিশেষ গুরুত্বের সাথে উঠে আসে।

একইসাথে প্রভাব ফেলে এদেশের ঐতিহ্য। জামদানীর মত দেশীয় কাপড় ও তার ডিজাইন বৈচিত্রকে তুলে ধরি। ডিজাইন করার সময় আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মান ধরে রাখি, সঙ্গে দেশীয় সাংস্কৃতিক উপাদান সবসময়ই অনুপ্রেরণা হিসেবে থাকে। এভাবেই আমরা নিজস্বতা ধরে রাখি।

আপনার প্রিয় রঙ কি?

শাহীন আহমেদ: সাদা। সাদা সবসময়ের জন্যই আমার প্রিয়।

কোন পোশাকে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করেন?

শাহীন আহমেদ: টি-শার্ট, পোলো শার্ট এসব পোশাক পছন্দ করি। আর যেকোন উৎসব ও অনুষ্ঠানে পাঞ্জাবী বেশি পছন্দ।

অঞ্জনস ছাড়া দেশে ও বিদেশে কোন বুটিক হাউজ পছন্দ করেন?

শাহীন আহমেদ: দেশের বাইরে অনেকেই আছে যারা খুব ভালো কাজ করেন। যেমন জর্জিও আরমানি, জারা সারা পৃথিবীতেই পরিচিত এবং জনপ্রিয়। আবার দেশেও চন্দ্র শেখর সাহা, মাহিন খান, বিবি রাসেল খুব ভালো কাজ করছেন। অনেক ফ্যাশন হাউজই পছন্দ। তবে দেশের বাইরে জর্জিও আরমানি আর দেশে আড়ং বেশি পছন্দ। তাছাড়া কাজের ক্ষেত্রেও যুগোপযোগী থাকতে খোঁজখবর রাখতে হয় সবসময়।


কোন পোশাকটি ডিজাইন করতে বেশি ভালোবাসেন?

শাহীন আহমেদ: শুরু থেকেই আমাদের নিজস্ব ডিজাইন টিম আছে। আমরা সাধারণত নির্দিষ্ট কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করে থাকি। এখন আর আমার সেভাবে নিজের ডিজাইন করা হয়না। তবে আমার বেশি ভালো লাগে সালোয়ার কামিজ ডিজাইন করতে। এছাড়া মেয়েদের টপসও ভালো লাগে।

তরুণ ক্রেতাদের জন্য অঞ্জনসের আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাই।

শাহীন আহমেদ: এখনকার তরুণেরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় তাদের পছন্দ অপছন্দ, আরামের বিষয়টা মাথায় রেখে যুগোপযোগী পোশাক ডিজাইন করি আমরা।

দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির এখনকার অবস্থান নিয়ে কী বলবেন?

শাহীন আহমেদ: খুব বিস্তৃত আকারে না হলেও এখানে স্বাধীনতার পরপরই দেশীয় ফ্যাশন নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। খুব সম্ভবত ১৯৭৩ সালে ‘নিপুনের’র হাত ধরে এদেশে দেশীয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির যাত্রা শুরু। এরপর আশির দশকে আড়ং, কারুপল্লী, কুমুদিনীর হাত ধরে এই ইন্ডাস্ট্রি আরেকটু সমৃদ্ধ হল। তারপর সবচাইতে বড় জোয়ার আসে নব্বইর দশকে, বিশেষত ২০০০ সালের আগে আগে একে একে অঞ্জনস, কে ক্রাফট, রঙ এরকম আরও কিছু হাউজ আসে। এরই ধারাবাহিকতায় আসে আরও ফ্যাশন হাউজ।

বিশেষত ২০০১-২০১০ দশকটা দেশি ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির জন্য একটা স্বর্নযুগ বলা যায়। এই সময়টাতে অনেক ফ্যাশন হাউজ হয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে এসেছে অনেক ডিজাইনার। এর ফলে বিদেশি পোশাকের প্রতি আমাদের যে মোহ ছিল তা থেকে সরে এসে দেশীয় পোশাকের প্রতি আমাদের আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। ডিজাইনগুলো আমাদের নিজস্ব হওয়াতে মানুষ সেগুলো পছন্দও করতে শুরু করে। আর আমরা দেখা গেছে দেশীয় কাঁচামাল নিয়ে কাজ করেছি। পোশাকগুলো এখানকার কারখানাতে তৈরি হয়েছে। এটা আমাদের জন্য বড় একটা অর্জন। তখন কোন ফ্যাশন ইন্সটিটিউট ছিল না আমাদের দেশে। কিন্তু ফ্যাশন হাউজগুলো ভালো করতে শুরু করায় এখন কয়েকটা ফ্যাশন ইনস্টিটিউটও আছে। আগে যেমন হাতে গোনা কয়েকজন ফ্যাশন ডিজাইনার ছিল এখন সেখানে হাজার হাজার ডিজাইনার আছেন। কেউ ফ্যাশন হাউজে কাজ করছেন তো কেউ বাইং হাউজে কাজ করছেন। নিজেরা উদ্যোক্তা হয়ে অনলাইনে বিক্রিও করছেন কেউ কেউ।

এই যে অল্প কয়েকটা হাউজ মিলে যে জোয়ার তৈরি করল তা আমাদের সামগ্রিক অর্থনীতিতেও বিশাল অবদান রাখতে শুরু করল। আমাদের যেহেতু অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো হচ্ছে সেটাও একটা প্রভাব ফেলছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির বাইরের অনেকে বাজার ধরতে চাইবে এটাই স্বাভাবিক। তারই ধারাবাহিকতায় দেশের বাজারে অন্য দেশের পোশাক আসতে শুরু করে। এসব দেখে অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেললেও আমি বলব আসলে কাজটা করে যেতে হয়।

আমি একটা জিনিস খেয়াল করেছি। অঞ্জনসের কথাই বলব। এইযে এত বিদেশি পোশাক আসল, আমাদের বিক্রি কিন্তু কমেনি কোথাও। আবার আমরা শো-রুমও বাড়াচ্ছি। তাঁর মানে কি? কাজটা যদি আমি ঠিকভাবে করতে পারি যে কেউই আসুক না কেন আমরা মোকাবিলা করতে পারব।

কিন্তু আমরা যদি ভয় পেয়ে যাই তাহলে কিন্তু এগিয়ে যাওয়া সম্ভব না। তাই কেউ যদি বলে আমাদের ইন্ডাস্ট্রির অবস্থা ভালো না। আমি সেটা স্বীকার করি না। সেরকম হলে দেশের বেশিরভাগ ফ্যাশন হাউজই তাদের আউটলেট বাড়িয়ে যেত না। আমি মনে করি আমরা ভালো করছি এবং আরও ভালো করব। আবার আমরা যখন শুরু করেছিলাম তখন দেশীয় কাপড় নিয়েই কাজ করতাম। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এক্সট্যাসি, ইয়েলো, লা রিভ, সেইলরের মত প্রতিষ্ঠানও এসেছে যারা ভালোমানের পশ্চিমা ধাচের পোশাকও উপহার দিচ্ছে। আমরা সবাই মিলেই কিন্তু আমাদের দেশীয় বাজারের জন্য কাজ করছি। আর এভাবে কাজ করতে থাকলে আমাদের এই ইন্ডাস্ট্রি আরও বড় হবে আর ভালোর দিকেই যাবে দিন দিন।

অনলাইনে আজকাল অনেক উদ্যোক্তো ভারতীয় ও পাকিস্তানি কাপড় এনে ব্যবসা করে। দেখা যাচ্ছে এগুলো বেশ জনপ্রিয়। এতে দেশীয় ফ্যাশন কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে মনে করেন?

শাহীন আহমেদ: আসলে ব্যাপারটা এমন, আমাদের মনে করেন বাজারে দশটা পোশাকের চাহিদা আছে। আমি যদি দশটা পোশাক বানাই তাহলে দশটাই বিক্রি হবে। কিন্তু দশটার মাঝে দুটো যদি বাইরে থেকে আসে তাহলে আমরা তো কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিই। হয়ত সেই দশটাই আমরা বিক্রি করতে পারতাম।

কিন্তু এটা না পৃথিবীর সব দেশেই আছে। যেমন, ভারত ফ্যাশন ডিজাইনে এত উন্নত। ইউরোপ বা আমেরিকার ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি হয়ত শত বছরের পুরনো। সেখানেও কিন্তু বাইরের পোশাক ঢুকছে। আর সেখানে আমরা তো মাত্র সেদিন শুরু করলাম। আমরা যদি ফ্যাশনে পৃথিবীর সেরাও হয়ে যাই তবুও এটা থাকবেই। আমাদের এখানে বিদেশি ফলও তো আসে। বাজারে চাহিদা থাকে বলেই আসে। এটা তো সরকারিভাবে ছাড়া বন্ধ করার উপায় নাই।

অনেকেই আছে বিদেশি ডিজাইনারের পোশাক পরে বেশ গর্ববোধ করেন।

শাহীন আহমেদ: আমি কিন্তু দেখেছি এ দেশের মানুষ (উদাহরণস্বরূপ) আড়ং এর পোশাক পরে যতটা গর্ববোধ করে পৃথিবীর সেরা ডিজাইনারের কাপড় পরেও অতটা গর্ববোধ করে না। পঁচানব্বই ভাগ যদি মনে করে আমি আড়ংয়ের পোশাক পরে গর্ববোধ করি আর পাঁচভাগ যদি মনে করে আমি ইতালিয়ান ডিজাইনারের পোশাক পরে গর্বববোধ করি, আপনি কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দেবেন?

আড়ং আজ যে অবস্থানে এসেছে সেটা তো সবার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। এখন ইয়েলো, সেইলরও জনপ্রিয়। এরা কিন্তু দেশিয় ঐতিহ্যের পোশাকের জন্য জনপ্রিয়, তা নয়। এত যে বিদেশী পোশাক আসে তাও এরা কীভাবে জনপ্রিয় হয়। তাছাড়া এখনকার দিনে মানুষ অনেক বেশি দেশের বাইরে যায়। সেখান থেকেও কেনে। তারপরেও দেশীয় ফ্যাশনহাউজগুলো ভালো অবস্থানে আছে। তাই আমি মনে করি দেশীয় ফ্যাশনহাউজগুলোর অবস্থান দিনে দিনে আরও ভালো আর সুদৃঢ় হবে।

তবে মোটামুটি একটা পর্যায়ে গিয়ে আমরা ভাবতে থাকি যে এই জীবনে আমার যা করার ছিল করে ফেলেছি। আর কিছু করার কী দরকার। ওই জায়গাটায় গিয়ে আমাদের নিজেদের বদলাতে হবে। যা করেছি তার থেকেও আরও ভালো করতে হবে।

অঞ্জনসের পোশাক ডিজাইনে দেশীয় ঐতিহ্য যেমন নকশিকাঁথা, তালপাখার নকশা, রিকশাপেইন্ট, যাত্রাপালা, টেঁপা পুতুল, পালকি আর্ট, রাঙলি এসবের প্রভাব কতটা?

শাহীন আহমেদ: বৈশাখের আয়োজনে টেঁপা পুতুল, জমিদার বাড়ির নকশা, জামদানী নকশা, কাঁথা স্টিচসহ নানারকম লোকজ মোটিফ নিয়ে আমরা সবসময়ই কাজ করি। এছাড়া একুশে ফেব্রুয়ারিতে বর্নমালাকে তুলে ধরি। আবার স্মৃতিসৌধকে তুলে ধরি পোশাক ডিজাইনে। এছাড়াও আমাদের দেশীয় পোশাক- পাঞ্জাবী, শাড়ি এসব তো আছেই। অনেকেই বলে থাকে যে এখন আর মেয়েরা শাড়ি পরেনা। কিন্তু গত পাঁচ বছরে শাড়ির বিক্রি কিন্তু অনেক বেড়েছে।

এখনকার দিনে মেয়েরা উপলক্ষ কিংবা উৎসব বুঝে কাপড় পরে। যেমন, একটা মেয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় তখন একটা সিঙ্গেল ফতুয়া পরতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে আবার বাসায় থাকলে এক রকম, শপিংয়ে একরকম আবার বিয়ে বাড়িতে গেলে শাড়ি পরে। তাই বলব ফতুয়ার চাহিদা বেড়ে গেছে দেখে শাড়ির চাহিদা কমে গেছে এমন নয়। আবার শার্ট বা টি-শার্টের চাহিদা বেশি দেখে কেউ পাঞ্জাবী পরেনা এমনও নয়। একটা গাঁয়ে হলুদের অনুষ্ঠানে গেলেও বাচ্চা মেয়েরাও শাড়ি পরে। যার যার সামর্থ্য আছে সে সকাল আর সন্ধ্যার পোশাকও আলাদা করে পরে।

অর্থনৈতিক অবস্থাও ফ্যাশনের ক্ষেত্রে গুরুত্ব বহন করে। ইউরোপের মানুষের সামর্থ্য বেশি দেখেই তারা এত কেনাকাটা করে। এখন আমাদের দেশের মানুষেরও ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। প্রতি মাসেই হয়ত সবাই কেনাকাটা করিনা কিন্তু দুই ঈদ ছাড়াও পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুনের মত উপলক্ষেও নতুন পোশাক কিনছি। আবার রাস্তায় লুঙ্গি পরা লোক দেখবেনই না কিন্তু লুঙ্গি বিক্রি কিন্তু বন্ধ হয়ে যায়নি। তাই ডিজাইনাররা যখন কাজ করে তখন দেশীয় সংস্কৃতির বিষয়টাকে মাথায় রাখে।

এবারের বৈশাখে অঞ্জনসের পোশাক এবং একসেসরিজ ডিজাইনের থিম কী?

শাহীন আহমেদ: পহেলা বৈশাখে আমরা সবসময়ই বাঙালি ঐতিহ্যবাহী মোটিফ নিয়ে কাজ করি। এবারের বৈশাখের থিম হল শীতল পাটি, মঙ্গল শোভাযাত্রার ইমেজ থেকে নেওয়া মোটিফ, জামদানী মোটিফ, কাঁথা স্টিচ, জ্যামেতিক আর ফ্লোরাল মোটিফ।

পহেলা বৈশাখকে ঘিরে কোন বিশেষ রঙ, ডিজাইন ও কাটকে কি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে এবার?

শাহীন আহমেদ: বৈশাখ উপলক্ষে আমরা সবসসময়ই লাল এবং সাদা কে প্রাধান্য দেই। এ বছরও তাই। লাল আর সাদাকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য কিছু রঙ যেমন হলুদ, বাসন্তি এসব রঙও ব্যবহার করেছি এবার। অন্যান্য রঙের ব্যবহার থাকলেও লাল আর সাদার ছোঁয়া থাকে কমবেশি সব পোশাকেই। টপস ও কামিজের কাট আর প্যাটার্নে কিছুটা ভিন্নতা এসেছে। কামিজের নেকলাইন, হাতা, কামিজের ঘের এসবে ভিন্নতা এসেছে। আর শাড়িগুলো ট্র্যাডিশনালভাবেই করা হয়েছে।

কাপড় আর এমবেলিশমেন্ট বা মোটিফ হিসেবে কী ব্যবহার করা হচ্ছে?

শাহীন আহমেদ: বৈশাখে আমরা সবসময়ই পোশাকের দামের বিষয়টা মাথায় রাখি। দামটা যেন ক্রেতার হাতের নাগালে থাকে সেটা গুরুত্ব দেই। তাই সুতি কাপড় ব্যবহার করে বেশি পোশাক বানানো হয়। ব্লক প্রিন্ট, স্ক্রিন প্রিন্ট, এমব্রয়ডারি, এপ্লিক এসব ব্যবহার করা হয়েছে ডিজাইনের মাধ্যম হিসেবে।

বৈশাখ উপলক্ষে বিশেষ ধরণের গয়না, ব্যাগ, জুতা?

শাহীন আহমেদ: মেয়েদের গহনায় মেটাল, ব্রাস, কাঠ ইত্যাদি বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। আমাদের নিজস্ব গহনা ডিজাইনাররা নিজেদের মত করে নিজস্ব মোটিফ দিয়ে গহনা ডিজাইন করে সবসময়। সব যে লাল সাদায় হয় তা না, মোটিফেই নজরে দেওয়া হয় বেশি। পার্স, ব্যাগ এসবেও দেশীয় মোটিফ ব্যবহার করা হয়।

কাঁচামাল ব্যবহার করেন কোন দেশি?

শাহীন আহমেদ: অঞ্জনসে যেসব কাঁচামাল ব্যবহৃত হয় তার প্রায় নব্বই ভাগই দেশি। কাপড়গুলো নরসিংদী, টাঙ্গাইল থেকে সংগ্রহ করা হয়।

দেশীয় পোশাককে কিংবা ফ্যাশনকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা কতটা গুরুত্বপূর্ণ কিংবা সেটা করতে আমাদের করণীয় কী কিংবা কী করছি?’

শাহীন আহমেদ: এ বিষয়ে আসলে আমরা সেভাবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ করছি তা নয়। অনেকসময় প্রবাসীরা নিজেদের জন্য কিংবা উপহার দিতে দেশীয় কাপড় কিনে নিয়ে যান।

আসলে পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে আমাদের দেশের আবহাওয়ার বড় ধরণের ভিন্নতা আছে। এটাও আসলে আমাদের দেশি কাপড় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জনপ্রিয় না হওয়ার একটা কারণ। তবে মাঝে একসময় সারা পৃথিবীতে ফতুয়া বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এটা কিন্তু একেবারেই আমাদের দেশীয় পোশাক। এরকমভাবে আস্তে আস্তে অনেক পোশাকই আসতে পারে। বিদেশি অনেক ফ্যাশন হাউজই এখন উপমহাদেশীয় প্যাটার্ন অনুসরণ করছে। নিশ্চয় আমরা ভালো করছি দেখেই তারা এসব অনুসরণ করছে।

এমন কি হতে পারে না যে আমাদের সরকারপ্রধান কিংবা আন্তর্জাতিক তারকারা যখন বিদেশে কোন অনুষ্ঠানে যান তখন অঞ্জনস বা এদেশীয় কোন ডিজাইনারের পোশাক পরে গেলেন। এতে করে আমাদের দেশীয় ফ্যাশনের আরও প্রচার হতে পারে?

শাহীন আহমেদ: (হাসতে হাসতে) এটা খুবই ভালো হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এরকম উদ্যোগ কেউ নেয়নি। আশা করি একদিন এরকম হবে।

সারাবাংলার পক্ষ থেকে আপনাকে অনেক শুভেচ্ছা , ধন্যবাদ।

শাহীন আহমেদ: আপনাকে ও সারাবাংলাকেও শুভেচ্ছা।

 

আলোকচিত্র- আবদুল্লাহ আল মামুন এরিন

 

 

সারাবাংলা/আরএফ/এসএস

 

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন