বিজ্ঞাপন

নাম তার বাবুলাল

December 1, 2018 | 11:11 pm

তার নাম এলে, বেলে কিংবা টেলে হলেও ক্ষতি নেই। যেকোনো একটা নাম হলেই হলো। তার নামে কোনো বিশেষ দিবস নেই, তার নাম যাপিত জীবনে বিশেষ কোনো অনুরণন তৈরি করেনা। তবু বেঁচে থাকার পাঠশালার নিয়ম অনুযায়ী, তার একখান নাম আছে।

বিজ্ঞাপন

তার নাম বাবুলাল। তার নামের আগে জনাব, সাহেব এর ভার নেই, নামের শেষ পদবি মুক্ত। ঝরঝরে। তার লম্বা মেদহীন শরীর, নুইয়ে পড়া প্রায়। সেকি বয়সের ভারে, নাকি অভ্যাসের দোষে, কেউ জানেনা। তাকে এমন করেই দেখছে সবাই। গত বিশ বছর ধরে তাকে দেখতে এমনি লাগে, ষাট, কিংবা সত্তরের কোঠা পার হওয়া। হয়তো বয়সের রেখা তাকে ছুঁয়েছে, কিংবা সে বয়সকে। কে জানে? সে আছে, তাকে আপাতদৃষ্টিতে দেখতে একই লাগে। কেউ তাকে খুব কাছ থেকে, খুব তীব্র কিংবা তীক্ষ্ণ ভালোবাসা বা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখেছে বলে। তার সাথে কথা বলতে গেলে, তার দিকে তাকানোর খুব একটা প্রয়োজন নেই, নিতান্তই চোখে পরে যাওয়া, বেখেয়ালি দৃষ্টিতেও তার সাথে কথা বলা যায়। আর সেই কারণেই তার বয়সের রেখায় তেমন তারতম্য হয়েছে কিনা তা কেউ বলতে পারবেনা জোর দিয়ে। তবে আপাতদৃষ্টিতে, তার সার সাদা ফিনফিনে কয়েক মুঠো চুলের গোছা, আর নুইয়ে যাওয়া শরীর দেখলে মনে হয়, সে সব সময়ই এমন, এমনই ছিল।

নাম তার বাবুলাল। সেটা হয়তো প্রতিদিন নতুন করে কারো মনে থাকেনা। প্রয়োজনও নেই। কিন্তু প্রতিদিন সে আসে। সে প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ঠিক ঠিক আসে। সে উৎসবের দিন আসে, সে ঝড়ের দিনেও আসে, সে বসন্তের দিন আসে, ভরা মাঘেও আসে। গত বিশ বছর ধরে, উনিশ-বিশ সময়ের ব্যবধানে সে ঠিকঠাক এসে পড়ে। সে ঠিক তখন আসে, যখন শহুরে দালানের আধুনিক মার্বেলের মেঝেওয়ালা ফ্ল্যাটগুলোর বাসিন্দারা প্রাতরাশে ব্যস্ত থাকেন। সারাদিনের জন্য ঘরের বাইরে থাকার প্রস্তুতি নিতে থাকেন, এমন ব্যস্ত সকালের শুরুতে, বাবুলাল সব দরজার ঘণ্টি বাজায়। একে একে বহুতল দালানের, সব দরজায়। তার কোনো তাড়া নেই। এটাই তার কাজ। সে ঘণ্টি বাজালে দরজার ওপাশ থেকে কণ্ঠ শোনা যায়, “ওই যে ময়লাওয়ালা এসেছে, ময়লার বালতি দিয়ে আসো।” দরজা খোলা হবে। নানা রঙ্গের প্লাস্টিকের বালতি ভরা ময়লা, নিপুণতার সাথে বাবুলাল তার ইয়া বড় পেটমোটা ডাব্বায় ভরে, সে ডাব্বা কে দু হাতে তুলে নিয়ে চলে যায় অন্য দরজায়। প্রতিদিন সে এমন করে সংসারের জমে থাকা দেখতে পাওয়া দৃশ্যমান আবর্জনা সাফ করে নেয়।

“আমি বাবুলাল”, যেদিন কেউ দরজার ওপাশ থেকে জিজ্ঞেস করে, ‘কে?, সে এমন করেই টেনে টেনে বলে, “আমি বাবুলাল, ময়লাওয়ালা।”

বিজ্ঞাপন

বাবুলাল সর্বভুক প্রায়। প্রতিদিন ময়লার বালতির সাথে, ছোট ছোট প্যাকেটে প্রায়শই সে এ বাড়ি ও বাড়ির পাঁচমিশালি খাবার পায়। বেঁচে যাওয়া খাবারগুলো ময়লার বালতিতে ফেলতে যাদের মনে পিনপিন কষ্ট হয়, তারা যত্ন করে আলাদা প্যাকেট করে সেগুলো বাবুলালকে দেয়। সেগুলোর মধ্যে বাসি খাওয়াও থাকে, সুস্বাদু ভালো খাবারও। বাবুলাল খাবারের মান বিবেচনা করে, ময়লার বালতিতে ফেলে, কিংবা নিজের খাবার জন্য আলাদা করে তার পুরোনো খয়েরি রঙের আইসক্রিমের কৌটায় ভরে রাখে। আর মার্বেলের ফ্ল্যাটের মানুষগুলো নিজের হাতে খাবার অপচয় করার পাপ থেকে রক্ষা পায়।

বাবুলাল, সে কোন ধর্মের কেউ সঠিক জানেনা। সে কুরবানি ঈদে বাড়ি বাড়ি মাংস টোকায়, ঈদে বকশিস চায়, পুজোতে ও। তাই ঠিক জানা হয়না সে কোন ধর্মের, গোত্রের? দিনের শুরুতে প্রয়োজনীয় যা কিছু ফেলে দেয়া হয়, ব্যস্ত চলন্ত দিনের মাঝে সে আবর্জনা বা তার সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষের কথা কে মনে রাখে?

বাবুলাল, সে আজ আসেনি কাজে। তার ছেলের ঘরে মেয়ে হয়েছে। নাতনি। আজ সে কাজে আসবেনা। বিশ বছর পর আজ তার ছুটি। প্রথম ছুটি। আজ সকালে এ বাড়ি ও বাড়ির দরজার ঘন্টি বাজছেনা। বালতি ভরা ঘরের আবর্জনা, আজ যার যার ঘরে অবহেলায় পড়ে আছে। প্রতিটি ঘরের আনাচে কানাচে জমতে থাকা ধুলো, তথাকথিত সম্পর্কের আর জীবনের না দেখা আবর্জনার সাথে সাথে, আজ সংসারের দৃশ্যমান আবর্জনাও স্তুপ হয়ে আছে, ঘরে ঘরে। আজ সবাই তাকে খুঁজছে, “আজ ময়লাওয়ালা আসেনি?” ‘বাবুলাল’ নাম ধরে কিংবা ‘ময়লাওয়ালা’ নামে তাকে খুঁজছে সবাই। উপচেপড়া বালতির ময়লা সামাল দিয়ে আজ যে যার সকাল শুরু করছে। আজ সংসারগুলোর দৃশ্যমান ময়লা সাফ করবার জন্য কেউ আসেনি। আজ বাবুলাল আসেনি। আজ বাবুলাল ময়লাওয়ালা ছুটি নিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কিযী তাহনিন: গল্পকার, উন্নয়ন ও সেবাকর্মী। ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার বাংলাদেশ কার্যালয়ে কর্মরত

[প্রিয় পাঠক, কিযী’র জানালা থেকে সারাবাংলা.নেট এর একটি নতুন আয়োজন। আপনারা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন উপরের গল্পটি নিছক কোনও গল্প নয়, এটিই সমাজের এক নিত্য চিত্র। কিযী তাহনিন তার গল্পগুলোয় এমন সমাজের বিষয়গুলো তুলে ধরবেন গল্প বলে বলে। আশা করি এর মধ্য দিয়ে হয়তো সচেতন হয়ে উঠবে সমাজ, পাল্টাবে মানুষগুলোর মন-মানসিকতা।]

আগের গল্পগুলো পড়ুন এখানে-

** আহা মন, আহারে মন

** বাক্সবন্দি

** এ গল্পের নাম জানিনা

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন