May 21, 2018 | 6:05 pm
।। ওমর ফারুক হিরু, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট ।।
কক্সবাজার: মেয়ে-নাতনী আর দুই প্রতিবেশীসহ ইফতারের প্লেট নিয়ে মাগরিবের আজানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন রাবেয়া খাতুন (৪৮)। তবে সেসব প্লেটে ছিল না ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু-বেগুনির মতো ইফতারের প্রচলিত সব খাবার। এর বদলে সেসব প্লেটে ছিল শুধুই ভাত আর ডাল। দু’জনের প্লেটে পান্তা ভাতও দেখা গেল।
উখিয়ার লম্বাসিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এ চিত্র দেখা গেল দ্বিতীয় রোজায়। কেবল লম্বাসিয়া ক্যাম্পই নয়, প্রায় সব রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চিত্রই এক। মিয়ানমারের রাখাইন থেকে জীবন নিয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মুসলিম ধর্মাবলম্বী রোহিঙ্গারা ক্যাম্পগুলোতে এভাবেই ইফতার করছেন। তবে ইফতারের খাবারে জাঁকজমক না থাকলেও এখানে যে কোনো ধরনের বাধা-বিপত্তি ছাড়া রোজা রাখতে পারছেন, তাতেই খুশি রোহিঙ্গারা।
ছেনুআরা বেগম, শামসুল আলম, ছৈয়দ করিমদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাখাইনে নির্বিঘ্নে রোজা রাখতেই সমস্যায় পড়তে হতো রোহিঙ্গাদের। সেহেরিতে ঘরে আলো জ্বললে মারধর মগরা; রোজা রাখার কথা জানতে পারলে রোজাও ভাঙিয়ে দিত। বাংলাদেশে এসে এ ধরনের কোনো বাধা ছাড়াই রোজা রাখার সুযোগ পেয়েই মানসিকভাবে প্রশান্তি অনুভব করছেন তারা।
রোহিঙ্গারা বলছেন, বাংলাদেশে আসার পর দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের সহায়তা পেলেও রমজান মাস উপলক্ষে বিশেষ কোনো সহায়তা পাননি রোহিঙ্গারা। ফলে ডাল-ভাত কিংবা মুড়ি দিয়েই তাদের ইফতার করতে হচ্ছে; সেহরিতেই ওই ডাল-ভাত, কখনো সাথে একটু ডিম। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের দুয়েকটি মসজিদে অবশ্য ইফতারের জন্য ছোলা-মুড়ি বা খেজুরের দেখা মিলছে।
মিয়ানমারের মংডু’র ছেনুআরা বেগম (৪০) আছেন উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, ‘কী করব, আমাদের কেউ ইফতার দেয়নি! ত্রাণ থেকে যে চাল-ডাল দিয়েছে, ওই দিয়েই সেহরি-ইফতার করতে হচ্ছে। গতকাল তো শুধু পানি আর মুড়ি খেয়ে ইফতার করেছে। সেহেরিতে দুইটা ডিম চার জনে ভাগ করে খেয়েছি।’
সেহরি-ইফতারের খাবার খুব ভালো না হলেও কোনো বিপত্তি ছাড়া রোজা রাখতে পেরেই খুশি রাবেয়া খাতুন। মিয়ানমারে জোর করে রোজা ভাঙিয়ে দেওয়া হতো, সেহেরি খেতে উঠলে মার খেতে হতো বলেও জানান তিনি।
রাবেয়া বলেন, ‘ওখানে (রাখাইন) বেশিরভাগ রোহিঙ্গার ঘরে বিদ্যুৎ নেই। তাই রমজানে সেহেরির সময় কারো ঘরে প্রদীপ জ্বালালেই রাখাইনরা মারধর করত, খাবার নিয়ে যেত। এখানে অন্তত শান্তিতে নামাজ-রোজা করতে পারছি। সেহেরির সময় কেউ মারধর করছে না, জোর করে রোজা ভাঙাচ্ছে না, ইফতারে বাধা দিচ্ছে না। এতেই আমরা খুশি।’
কুতুপালং ক্যাম্পে গিয়ে দেখা গেল, পুরুষ রোহিঙ্গাদের অনেকেই ইফতার করছেন মসজিদে। হাবিবুর রহমান (৪০) নামে একজন জানালেন, প্রথম দুই রোজায় তিনি মসজিদে ইফতার করেছেন। ইফতারে ছিল ছোলা, মুড়ি খেজুর।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এফ-ব্লকের প্রধান (রোহিঙ্গাদের ভাষায় মাঝি) শামশুল আলম বললেন, দ্বিতীয় রমজান পর্যন্ত তারা সেহেরি-ইফতারের জন্য কোনো সহায়তা পাননি। তার জানামতে, আশপাশের ব্লকগুলোতেও কোনো সহায়তা আসেনি। সে কারণেই ডাল-ভাত দিয়েই চলছে তাদের সেহেরি-ইফতার।
তবে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-ব্লকের মাঝি ছৈয়দ করিমের ভাষ্য রাবেয়া খাতুনের মতোই। বাংলাদেশে নিরাপদে সেহেরি আর ইফতার করার সুযোগ পেয়েই খুশি তিনিও। সারাবাংলা’কে তিনি বলেন, ‘মিয়ানমারে অনেক ঝুঁকি নিয়ে রোজা রাখতে হতো। বেশিরভাগ দিনই কিছু না রেখেই রোজা রাখতাম। কিন্তু এখানে সেহেরির সময় মসজিদ থেকে মাইকিং করা হয়। রোজা আছি, এটাও সবাইকে বলা যায়। এটা ওখানে (রাখাইন) ভাবতেই পারতাম না।’
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ইনচার্জ রেজাউল করিম জানান, ‘এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ইফতার বা সেহেরি দেয়নি কেউ। তবে কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু রোহিঙ্গাদের মধ্যে ইফতার-সেহেরি দিয়েছে। তাছাড়া, রোহিঙ্গারা আমাদের মতো ইফতার করতে অভ্যস্ত না। তারা ইফতারের সময় ভাত-ই খেয়ে ফেলে।’
উখিয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ নিকারুজ্জামান জানান, ডাব্লিউএফপি’র পক্ষ থেকে প্রতিদিন এক লাখ ৯০ হাজার রোহিঙ্গা পরিবারকে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। এর বাইরে কিছু এনজিও এবংব্যক্তি উদ্যোগেও কেউ কেউ ইফতার সামগ্রী নিয়ে আসতে শুরু করেছেন।
রোহিঙ্গা শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. আবুল কালাম আজাদ সারাবাংলা’কে বলেন, ‘ রমজান মাসে রোহিঙ্গাদের জন্য বাড়তি কোনো ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। তাদের যেসব খাবার দেওয়া হয়, সেসব খাবার থেকেই তারা ইফতার-সেহেরি করছেন। আশা করছি, দুয়েকদিনের মধ্যেই তাদের ইফতার ও সেহেরির জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।’
সারাবাংলা/টিআর