বিজ্ঞাপন

পাইপলাইন আছে, পর্যাপ্ত গ্যাস নেই!

July 20, 2018 | 8:36 am

|| জোসনা জামান ||

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে পাইপলাইন নির্মাণ করা হলেও গ্যাস সংকটের কারণে পূর্ণাঙ্গ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। ফলে দেশে পর্যাপ্ত গ্যাস না থাকা সত্ত্বেও পাইপলাইন নির্মাণের যৌক্তিকতা নিয়ে দেখা দিয়েছে প্রশ্ন। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাইপলাইন নির্মাণের আগে সার্বিক গ্যাসের পরিস্থিতি বিবেচনা করা উচিত। গ্যাসের অভাবে এখন হয়তো পাইপলাইনটি নষ্ট হয়ে যেতে পারে।

অন্যদিকে এই গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইন নির্মাণের সময় দেখা দিয়েছিল ৭ ধরনের জটিলতা। যে কারণে বাস্তবায়নে অতিরিক্ত সময় লেগেছে ২৪২ দশমিক ৮৬ শতাংশ। অর্থাৎ আড়াই বছরে বাস্তবায়নে লক্ষ্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত শেষ হয়েছে ৮ বছরে। ফলে সঠিক সময়ে সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে সাধারণ মানুষ।

দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সরবরাহের জন্য ‘মনোহরদী-ধনুয়া এবং এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড় গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন’ প্রকল্পের ক্ষেত্রে উঠে এসেছে এ চিত্র। প্রকল্পটির প্রভাব মূল্যায়ন করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) নিয়োগ করা ভেনাস কনসাল্টিং প্রাইভেট লিমিটেড। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত খসড়া প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

উন্নয়ন প্রকল্পের এ অবস্থার কারণে অর্থের অপচয় হচ্ছে কি না এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে. মুজেরি সারাবাংলা’কে বলেন, গ্যাস পাইপলাইন নির্মাণের আগে উচিত ছিল গ্যাসের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করা। অর্থাৎ দেশে কয়েক বছরে বড় কোন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়নি বা গ্যাসের পর্যাপ্ত সরবরাহও বাড়েনি। যদি পর্যাপ্ত গ্যাসই না থাকে তাহলে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে পাইপলাইন তৈরি করে লাভ কি? এক্ষেত্রে অর্থের সঠিক ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন আছে। শুধু এই প্রকল্পই নয়, অন্য যে কোন উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে অবশ্যই সম্ভাব্যতা যাচাই করা উচিত। তাছাড়া এ প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা গেছে নানা জটিলতায় নির্ধারিত মেয়াদে অনেক বেশি সময় লেগেছে। ফলে সব দিক থেকেই ক্ষতি হয়েছে। প্রকল্প থেকে যেরকম উপকার পাওয়ার কথা ছিল তা সময় মতো আসেনি।

এ বিষয়ে আইএমইডির সচিব মো. মফিজুল ইসলাম সারাবাংলা’কে বলেন, প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করার কাজ চলছে। এরপরে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সুপারিশসহ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে এবং ভবিষ্যতে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকবে।

আইএমইডির প্রতিবেদন বলা হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর বর্তমানে কার্যকর রয়েছে। তবে উৎসে গ্যাস সংকটের কারণে সঞ্চালন পাইপ লাইনটি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতায় গ্যাস সঞ্চালন করতে পারছে না। প্রতিবেদন তৈরির জন্য পরিচালিত জরিপে অংশ নেয়া আবাসিক উত্তরদাতাদের ৮১ শতাংশ বলেছেন তাদের সংযোগে গ্যাসের অবস্থা ভাল। ১৮ শতাংশ বলেছে মোটামুটি ভাল এবং ১ শতাংশ বলেছে খারাপ।

বিজ্ঞাপন

তবে প্রকল্পের পরে সংযোগ প্রাপ্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রতিনিধিদের মতে, এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ফলে তারা উৎপাদন শুরু করতে পেরেছেন। কিন্তু গ্যাসের সরবরাহ আশানুরূপ না হওয়ায় তাদর উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। সরবরাহ পর্যাপ্ত পেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন দিগুণ হতে পারতো।

সুপারিশ দিয়ে গিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উক্ত প্রকল্পের শতভাগ সুফল পেতে হলে গ্যাস সঞ্চালন পাইপলাইনটি যেন তার সর্বোচ্চ সঞ্চালন ক্ষমতায় গ্যাস সঞ্চালন করতে পারে পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই প্রকল্পের উদ্দেশ্য পুরোপুরি পূরণ হবে।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে যেসব জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল সেগুলো হচ্ছে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ কার্যকরে ৬ মাস দেরি হয়। এছাড়া ভূমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন আইনি জটিলতা কাটাতে সময় লেগেছে ৩ বছর। প্রকল্পের স্কোপ নির্ধারণে বিলম্বের কারণে ২ বছর পর ধনুয়া-এলেঙ্গা সেকশন পাইপলাইন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পাইপলাইন সরবরাহের জন্য গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) চায়না পাইপলাইন প্রস্ততকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারে ইস্পাতের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চুক্তি মূল্যে পাইপলাইন সরবরাহে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে জিটিসিএল কর্তৃপক্ষ চুক্তিটি বাতিল করতে বাধ্য হয়।

তবে প্রতিষ্ঠানটির নিরাপত্তা জামানত বাবদ জমা থাকা ১১ কোটি ১২ লাখ ৯০ হাজার টাকা জরিমানা হিসেবে নগদায়ন করা হয়। পরবর্তীতে পুনরায় আন্তর্জাতিক দরপত্র প্রক্রিয়া করতে ২ বছর সময় চলে যায়। টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন যথাযথভাবে পূরণ না করায় জিটিসিএল কর্তৃপক্ষকে ইনডাকশন ব্যান্ড কেনার জন্য তিন বার এবং কোটিং ম্যাটেরিয়াল কেনার জন্য দুই বার দরপত্র আহ্বান করতে হয়। ফলে এক বছর দেরি হয়।

বিজ্ঞাপন

নদী ক্রসিং এর জন্য ইপিসি ঠিকাদার নির্বাচনে কেবলমাত্র একটি দরপত্র দাখিল হয়েছিল। এই একটি ঠিকাদারের অভিজ্ঞতা এবং ট্র্যাক রেকর্ড ইত্যাদি সঠিকভাবে যাচাইয়ের জন্য দেড় বছর সময় ব্যয় হয়। এছাড়া ধনুয়া এমএমএসের জন্য ইপিসি ঠিকাদার নির্বাচনের সময় একটি দরপত্র দাতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অন্যান্য দরপত্র দাতা প্রতিষ্ঠান অভিযোগ করায় এডিবি দরপত্র বাতিল করে দেয়। এ কারণে ২ বছর সময়ে চলে যায়।

সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে দেশের অনেক বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও সার কারখানা স্থাপিত হয়েছে। বিশেষ করে ঘোড়াশাল, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, বাঘাবাড়ী, খুলনা ও ভেড়ামারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হওয়ায় গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়। গ্যাসের ঘাটতি পূরণে গ্যাস পাইপলাইন স্থাপন জরুরী হয়ে পড়ে। এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পেট্রোবাংলার আওতাধীন জিটিসিএলের মাধ্যমে পাইপলাইন স্থাপনের জন্য ‘মনোহরদী-ধনুয়া এবং এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব পাড় গ্যাস সঞ্চালন পাইপ লাইন’ নির্মাণ প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়। এটির দৈর্ঘ্য ৫১ কিলোমিটার এবং ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন ছিল।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় ধরা হয় ৪৫০ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ১৬৯ কোটি ১১ লাখ টাকা, এডিবির ঋণ ২৭১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং জিটিসিএলের ১০ কোটি ১৯ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়। প্রকল্পটি ২০০৬ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০৯ সালের জুনের মধ্যে বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু প্রথমবার মেয়াদ বাড়িয়ে করা হয় ২০১১ সালের জুন পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে বাস্তবায়ন শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয় বার মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এতেও বাস্তবায়ন না হওয়ায় ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়।

সারাবাংলা/জেজে/এসএ/এএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন