বিজ্ঞাপন

পাহাড় দোলে বৈসাবিতে

April 10, 2018 | 12:10 pm

সালেক খোকন, অতিথি লেখক

বিজ্ঞাপন

পাহাড়ি আদিবাসীদের প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। ত্রিপুরাদের বৈসুক থেকে ‘বৈ’, মারমাদের সাংগ্রাইং থেকে ‘সা’, আর চাকমাদের বিঝু থেকে ‘বি’, – এভাবে তিনটি নামের আদ্যক্ষর এক করে হয় ‘ বৈ-সা-বি’।

এ উৎসবে পাহাড়ি আদিবাসীদের কন্ঠে থাকে বৈসাবির সুর। তারা গায়- ‘তুরু তুরু তুরু রু- বাজি বাজাত্তে/পাড়ায় পাড়ায় বেরেবং বেক্কুন মিলিনে/এচ্যে বিজু, বিজু, বিজু….’(ভাবার্থ: তুরু তুরু শব্দে বাঁশি বাজে, গ্রামে ঘুরে বেড়াব সবাই মিলে, আজ বিজু, আজ বিজু)।

ত্রিপুরাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ও প্রধানতম উৎসব হলো বুইসুক বা বৈসুক। চৈত্র মাসের শেষের দুই দিন ও নববর্ষের প্রথম দিনটিতে এরা পালন করে এ উৎসব। চৈত্রের শেষ দুই দিনের প্রথম দিনটিকে এরা ‘হারি বুইসুক’ আর শেষ দিনটিকে বলে ‘বুইসুকমা’। আর নববর্ষের প্রথম দিনটিকে বলা হয় ‘বিসিকাতাল’।

বিজ্ঞাপন

প্রথম দিন আদিরীতি অনুসারে ত্রিপুরা ছেলেমেয়েরা গাছ থেকে ফুল তোলে, ফুল দিয়ে ঘর সাজায় ও কাপড় ধুয়ে পরিষ্কার করে নেয়। অতঃপর ঝুঁড়িতে ধান নিয়ে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেয়। ওইদিন ভালো ও পরিস্কার কাপড়চোপড় পরে আদিবাসীরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ায়। এ সময় ঘরে ঘরে বিচিত্র ধরণের পিঠা আর মদ পান করানো হয়। বৈসুক উৎসব শুরু হলে ‘গরাইয়া’ নৃত্যর দল বাড়ি বাড়ি গিয়ে নৃত্য পরিবশেন করে। নৃত্য দলের একজনের কাঁধে বাঁধা শূলে থাকে একটি খাদি। ঘরের উঠোনে এ শূলটি বসানো হলে, ওই ঘরের মালিককে গরাইয়া দেবতার পূজা দিতে হয়। নৃত্য শেষে প্রতিবাড়িতেই শিল্পীরা সুর করে ওই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে। তখন মদ, মুরগির বাচ্চা ও চাল তুলে দেওয়া হয়। এভাবে প্রত্যেক বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা সামগ্রী দিয়ে গরাইয়া দেবতার পূজা করে ত্রিপুরারা।

আবার ‘তাইংখুং’ মারমা পঞ্জিকা বছরের প্রথম মাস। এ মাসেই উদযাপিত হয় মারমাদের নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠান ‘সাংগ্রাইং’। সংক্রান্তি শব্দ থেকেই এসেছে ‘সাংগ্রাইং’ শব্দটি। মারমাদের বিশ্বাস, এ পৃথিবীতে সাংগ্রাং নামে এক ধর্মীয় দেবী মানুষের সৌভাগ্য আর কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসেন। তাই স্বর্গ থেকে পৃথিবীতে পা রাখার ক্ষণটি থেকেই শুরু হয় সাংগ্রাইং উৎসব। যে ক’দিন দেবী অবস্থান করবেন সে ক’দিনই চলে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।

এ উৎসব চলে সাধারণত তিনদিন। প্রথম দিনটিকে এরা বলে ‘পাইং ছোয়াইক’। এর শাব্দিক অর্থ ‘ফুল তোলা’। এ দিন মারমা যুবতীরা গোলাপ,জবা, গন্ধরাজ, বেলীসহ নানা ধরনের পাহাড়ি সুগন্ধি ফুল সংগ্রহ করে। বুদ্ধ পূজার রাত্রে সেসব ফুল সাজিয়ে দলবেধে ওইদিন ভোরবেলা সবাই বৌদ্ধবিহারে গমন করে। বুদ্ধমূর্তির বেদীতে ভক্তিসহকারে সেই ফুল রেখে তারা প্রার্থনা নিবেদন করে এবং নানা রংয়ের মোম ও ধূপকাঠি জ্বালিয়ে রাখে।

বিজ্ঞাপন

উৎসবের আগেই বেদীর স্থানটুকু ফুল ও মাল্যে ভরিয়ে দেওয়া হয়। ওইদিন প্রাতঃকালেই প্রবীণেরা অষ্টশীল গ্রহণ ও উপবাস পালনের জন্য বিছানাপত্রসহ অবস্থান নেয়। বিকেলে মন্দিরের বুদ্ধমূর্তি নিয়ে সকল বয়সী মারমারা সারিবদ্ধভাবে গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। ওই রাতে মারমা যুবক-যুবতীরা গান-বাজনায় ব্যস্ত থাকে। এ সময় তারা নানা পদের ও হরেক রকমের পিঠা-পায়েস তৈরি করে।

উৎসবের দ্বিতীয় দিনটি সাংগ্রাইং দেবীর আগমন দিবস। তাই ভোর থেকে রাত অবধি ঘরে ঘরে চলে প্রবীণ পূজা। পূজার্ঘ্যর জন্য কলা, পেঁপে, নারকেল ইত্যাদি রঙিন কাগজে মুড়ে মোমবাতির প্যাকেটসহ তা বুদ্ধ মূর্তির বেদীতে রেখে প্রার্থনা করা হয়।
‘সাংগ্রাইং আপ্যাইন’ হচ্ছে উৎসবের তৃতীয় দিন। এটা দেবীর নির্গমন দিবস। তাই ভোরে মঙ্গলাচরণ ও স্তত্র পাঠ, সকালে অষ্টশীল গ্রহণ ও পিণ্ডদান, বিকেলে গোলাপ ও চন্দন মিশ্রিত জলে বুদ্ধ স্নান, সন্ধ্যায় প্রদীপ পূজা এবং রাতের আরতি দানের মধ্য দিয়ে দিবসের সমাপ্তি।

এ ছাড়া মারমা সমাজে রিলংবোয়ে বা জলকেলি অনুষ্ঠানের প্রচলন রয়েছে। এটি যুবক-যুবতীদের মধ্যে সামাজিক ঐক্য,সম্প্রীতি, প্রেম-ভালোবাসায় বিশেষ ভূমিকা রাখে। এ অনুষ্ঠানে যুবতীরা প্যান্ডেলের ভিতরে পানিভর্তি নৌকা বা ড্রামকে পেছনে রেখে সারিবদ্ধভাবে পানির পাত্র হাতে নিয়ে নৌকার গা ঘেঁষে বসে থাকে। যুবকেরা বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে নেচে গেয়ে প্যান্ডেলের দিকে এগোতে থাকে। প্রত্যেকের হাতে থাকে খালি বালতি ও মগ। যুবতীরা যুবকদের দিকে পিঠ রেখে উল্টোদিকে ফিরে সারিবদ্ধভাবে নৌকার পাশে বসে। প্রতিটি যুবক পছন্দানুযায়ী এক একজন যুবতীকে লক্ষ্য করে নির্দিষ্ঠ স্থান থেকে পিঠের উপর পানি নিক্ষেপ করে। দু’ তিনবার পানি পড়ার পর যুবতীটি উঠে ঘুরে দাঁড়িয়ে যুবকের মুখোমুখি হয়। অতঃপর নৌকা বা ড্রাম থেকে পানি তুলে যুবকের মুখের দিকে পানি ছুঁড়ে মারে। যুবকের বালতির পানি শেষ না হওয়া পর্যন্ত উভয়ে পরস্পরের প্রতি এভাবে পানি ছুঁড়তে থাকে। তবে কৌনিক বা আড়াআড়িভাবে পানি নিক্ষেপ নিষেধ থাকে। অনুষ্ঠান চলাকালে কেউ কোন অশোভন, অশালীন বা অশ্লীল আচরণও করতে পারে না।

চাকমাদের বিজু উৎসবের সঙ্গে দুলে ওঠে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম। চাকমারা বাংলা বর্ষের শেষ দিনটিকে মূলবিজু, তার আগের দিনটিকে ফুলবিজু এবং নববর্ষের প্রথম দিনটিকে নতুন বছর বা ‘গুজ্জেই পজ্জা’ দিন বলে। এ তিনদিন ধরেই এরা বিজু উৎসব পালন করে।

বিজ্ঞাপন

ফুল বিজুর দিনে বাড়ির ছেলে মেয়েরা সকালে ঘুম থেকে উঠে বিভিন্ন ফুল তুলে নিজ নিজ বাড়িতে আনে। অতঃপর তারা সেগুলো দিয়ে বুদ্ধ পূজা, গৃহ দেবতার পূজা করে থাকে। এ সময় ঘরবাড়ি ও আঙিনা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফুলে ফুলে বাড়ি ঘর সাজানোর পর পোষা গরু, মহিষ ইত্যাদির গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেওয়া হয়। ফুল বিজুর দিনে গ্রামের সবাই একত্রিত হয়ে পরিকল্পনা করে এবং বন্য জন্তুর মাংস সংগ্রহের জন্য শিকারে বের হয়। কেউ কেউ মাছ ধরতে যায় নদীতে। মেয়েরা নানা তরিতরকারি সংগ্রহের জন্য বেরিয়ে পড়ে জঙ্গল ও ক্ষেত খামারে। এ সময় এরা গন্ধকী, কাটুবের আগা বা মূল, একদাজ্যা কচুর দিগ, কেতকী, গোলাক বেত ও মরিচা বেতের আগা ইত্যাদি সংগ্রহ করে আনে। বিকেলে গোয়ালঘরে, স্নান ঘাটে সুতালি বাতি বা মোম জ্বালিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়। সন্ধ্যার পরেই শুরু হয় নানারকম পিঠা বানানো।

মূল বিজুর দিন প্রতি বাড়ির লোকেরা খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে নদীতে বা জলাশয়ে স্নান সেরে নেয়। অতঃপর দলে দলে নদী, পাহাড়ি ছড়া বা জলাশয়ে ফুল ভাসিয়ে দিয়ে চাকমারা পুরোন বছরের গ্লানি ভুলে নতুন বছরকে স্বাগত জানায়। মেয়েরা স্নান সেরে ফুল বিজুর দিনে সংগ্রহ করা প্রায় ২০ রকমের শাকসবজি দিয়ে রান্না করে ‘পাঁচন’ নামক এক ধরণের ঐতিহ্যবাহী খাবার। অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে আগতদের তা খেতে দেওয়া হয়। এছাড়া এদিনে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যুবক-যুবতী সকল বয়সীরাই বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যায়। এ সময় নানা ধরণের খাদ্য ও প্রিয় পানীয় ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়।

গুজ্জেই পজ্জা’র দিন বা তৃতীয় দিন বা নববর্ষের প্রথম দিন চাকমারা দল বেঁধে উপাসনালয়ে গিয়ে নতুন বছরের সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে। গ্রাম্য ছেলেমেয়েরা এ দিনটি গিলাখেলা, গুদু (হাডুডু) খেলাসহ বিভিন্ন খেলাধুলা ও আমোদের মধ্যে অতিবাহিত করে। যুবক-যুবতীরা মহানন্দে আকাশ প্রদীপ জ্বালায় এবং বাজি ফোটায়। সন্ধ্যায় প্রতিঘর, ক্যাংঘর, স্নানঘাট, গরু-মহিষের ঘরে আলোকসজ্জা করা হয়। মূল বিজু বা বৎসরের শেষ দিনে নানা প্রকার পানীয় ও উত্তম খাদ্যদ্রব্য খাওয়া হয়। তাই এর পরদিন নববর্ষের প্রথম দিনে এরা বিশ্রাম নেয়। এ কারণেই চাকমারা এ দিনটিকে ‘গুজ্জেই পজ্জা’র দিন অর্থাৎ শুয়ে থাকার দিন বলে।

আদিবাসী উৎসবগুলো খুবই বৈচিত্র্যময় হয়ে থাকে। উৎসবে তাদের দলগত নাচ, গান, বিশ্বাসের নানা আচার আর প্রাণখোলা আড্ডায় তারা ভুলে যায় হিংসা-বিদ্বেষের সকল বিভেদ।

ছবি: ডেনিম চাকমা

সারাবাংলা/এমএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন