বিজ্ঞাপন

পূর্ণিমা বিতর্ক থেকে ‘সিনেমায় ধর্ষণ কেন বিনোদন’ তর্কের শুরু

April 2, 2018 | 4:56 pm

জান্নাতুল মাওয়া।।

বিজ্ঞাপন

বিকটদর্শন ভিলেন সাঙ্গপাঙ্গদের সাহায্যে নায়িকাকে তুলে নিয়ে আসে তার অন্ধকার ডেরায়। তারপর নায়িকাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। হয়তো জামার একটা অংশ ছিঁড়ে ফেলে। কিংবা তারও বেশি কিছু। অন্যদিকে নায়িকা তারস্বরে চিৎকার করে বাঁচাও বাঁচাও বলে। তারপরই অলৌকিকভাবে নায়কের আগমন ঘটে এবং নায়ক নিমেষেই ভিলেন আর তার সঙ্গীসাথীদেরকে পিটিয়ে ছাতু করে পুলিশের হাতে তুলে দেয়। তারপর তারা সুখে শান্তিতে প্রেম করতে থাকে।
আমাদের চলচ্চিত্রে এই দৃশ্য বারবার ফিরে ফিরে আসে। এই পর্যন্ত কয়টি চলচ্চিত্রে এমন ধর্ষণের দৃশ্য রাখা হয়েছে তেমন কোন জরিপ পাওয়া না গেলেও চিত্রনায়িকা পূর্ণিমা জানিয়েছেন, তিনি এই পর্যন্ত ৫০টি চলচ্চিত্রে ধর্ষণ দৃশ্যে অভিনয় করেছেন। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত একটি অনুষ্ঠানে দেখা যায় পূর্ণিমা তার সহঅভিনেতা এবং চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় ভিলেন মিশা সওদাগরকে হেসে হেসে প্রশ্ন করছেন যে, সিনেমাতে তিনি এই পর্যন্ত কয়বার ধর্ষণ করেছেন।
এই প্রশ্ন করার সময় পূর্ণিমা মুখে ছিল হাসি। একটা পর্যায়ে সেই হাসি আরো বিকশিত হয় যখন মিশা জানালেন যে তিনি মৌসুমির পাশাপাশি পূর্ণিমার সাথেও ধর্ষণ দৃশ্যে অভিনয় করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। এছাড়াও মিশা জানালেন যখন বয়সে তিনি যুবক ছিলেন তখন তাকে বেশি ধর্ষণ দৃশ্যে অভিনয় করতে হত। এখন আর এই দৃশ্যে অভিনয় করতে হয়না।

পুরো কথোপকথনে দুইজনের মুখে ছিলো উচ্ছ্বসিত হাসি। অর্থাৎ ধর্ষণের মত একটি ভয়াবহ অপরাধ এখন চটুল হাস্যরসে ভরা একটা অনুষ্ঠানের কৌতুকের উপাদান হয়ে উঠেছে। বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রগুলোতে ধর্ষণের দৃশ্য এত বেশি আনা হয় যে মিশা সওদাগর এখন আর বলতেই পারছেন না যে তিনি কয়বার একজন ধর্ষকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন।
আমাদের চলচ্চিত্রে ধর্ষণ মানে হচ্ছে নায়ক নায়িকার পরিণয়ের একটি ধাপ। নায়িকার অসহায় আর্তচিৎকার শুনে দামাল নায়কের দুদ্দাড় ছুটে আসা। নায়ক যেখানে নায়িকাকে নিজের জ্যাকেট দিয়ে ঢেকে দেয়। ধর্ষণ দৃশ্যের হুটোপুটিতে নায়িকার হাঁটুর ওপরে উঠে যাওয়া জামা দেখে সিনেমা হলে দর্শকদের উত্তেজিত সিটি বাজানো। এইসবের মধ্যে জঙ্গলে পড়ে থাকা তনুর লাশ, সবুজ ধানক্ষেতে পড়ে থাকা বিউটির নিথরদেহ কিংবা রুপার শেষ নিঃশ্বাসের আর্তনাদ নেই। আছে শুধু বাণিজ্যিক বিনোদন।

বিজ্ঞাপন

গতবছর জাতীয় চলচ্চিত্র নীতিমালা অনুযায়ী চলচ্চিত্রে সরাসরি ধর্ষণ দৃশ্য দেখানোকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবুও কোন না কোন ভাবে এই দৃশ্যগুলো টেনে নিয়ে আসা হয় যেখানে যৌন সহিংসতাবিরোধী সচেতনতার চেয়েও বিনোদন হয়ে ওঠে মুখ্য বিষয়।
ধর্ষণের মত একটি অপরাধকে আমাদের চলচ্চিত্রমাধ্যমে হালকা করে দেখানো হচ্ছে কি না- এই প্রশ্ন রেখেছিলাম জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালক অমিতাভ রেজার কাছে। অমিতাভ রেজা বললেন, খুন- ধর্ষণের মত ক্রিমিনাল অ্যাক্টগুলোকে অপরাধ কাজ হিসেবেই দেখাতে হবে। যুগ যুগ ধরে আমাদের চলচ্চিত্রগুলোতে ধর্ষণদৃশ্য তৈরি করা হয়েছে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এবং পুরুষ দর্শকের কথা মাথায় রেখে। এটি যে একটি ভয়াবহ অপরাধ সেই ভয়াবহতাকে ছাপিয়ে এটি হয়ে উঠেছে যৌনদৃশ্য।

টু উইমেন ছবির একটি দৃশ্য

অমিতাভ আরও বলেন, টু উইম্যান চলচ্চিত্রে যেভাবে যৌন নির্যাতনের স্বীকার হওয়া একজন মানুষের যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে, আমাদের দেশের এতদিন ধরে চলে আসা চলচ্চিত্রগুলোতে ধর্ষণের পরে একজন নারীর মানসিক অবস্থা বা কষ্টের দিকগুলো তুলে ধরা হয় নাই। এই বিষয়টি নিয়ে অবশ্যই আমাদেরকে আরও সচেতন হতে হবে।
এই আলোচনা শুধু আমাদের দেশকেন্দ্রিক নয়। সারা বিশ্বেই এই আলোচনার পালে হাওয়া লেগেছে। গত ১৪ মার্চ গার্ডিয়ানে প্রকাশিত একটি ফিচারে উঠে আসে কীভাবে সারা পৃথিবীতে চলচ্চিত্রগুলোতে যৌন নির্যাতনের দৃশ্যগুলোকে শুধুমাত্র বানিজ্যিক উপাদান হিসেবে ব্যাবহার করা হচ্ছে। ফিচারটির শিরোনামে খুব শক্তভাবে লেখা হয়েছে, “চলচ্চিত্রে যৌন সহিংসতার দৃশ্যায়ন বিপজ্জনকহারে বেড়ে চলছে। এটি বন্ধ করতে হবে”। এই লেখাটিতেও উঠে আসে কীভাবে কখনও কখনও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্ন পরিচালকের দৃষ্টিকোন থেকে যৌন সহিংসতার দৃশ্য ফুটে উঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং চলচ্চিত্রবোদ্ধা ফাহমিদুল হকের কথাতেও ঠিক একই আক্ষেপ উঠে আসে। তিনি বলেন, বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রগুলোতে ধর্ষণের দৃশ্য ব্যবহার করা হয় বাণিজ্যের উপকরণ হিসেবে। এইসব চলচ্চিত্রের ফর্মুলাতে উপকরণ হিসেবে থাকে পাঁচটা গান, একটা রেপ সিন, বৃষ্টির সিন, খুনসহ বেশ কিছু গতানুগতিক উপাদান। অপরাধ হিসেবে ধর্ষণের যে মাত্রা এবং একজন মানুষের উপর এর যে নেতিবাচক প্রভাব তার কোন কিছুই এই চলচ্চিত্রগুলোতে উঠে আসেনা। এর ফলে চলচ্চিত্র অভিনেতাদের কাছে ধর্ষণের দৃশ্য আর বাকি সব দৃশ্যের মতই সাধারণ হয়ে উঠেছে। যা খুবই অনাকাঙ্খিত।

বিজ্ঞাপন

চলচ্চিত্রে ধর্ষণকে এত হালকাভাবে উপস্থাপনের প্রভাব আমাদের জনমানসে পড়ছে কি না- এই প্রশ্নের উত্তরে জনাব ফাহমিদুল বলেন, প্রভাব যে কতুটুকু সেটি আসলে দীর্ঘ গবেষণার বিষয়। তবে এর দায় পুরোপুরি গণমাধ্যমের ওপর চাপিয়ে দেয়ার পক্ষপাতীও নন তিনি। তিনি বলেন, দর্শকের ওপর মিডিয়া কতটুকু প্রভাব বিস্তার করবে সেই বিষয়টি নির্ভর করে দর্শকের মানসিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত অবস্থানের ভিত্তিতে। ফাহমিদুল হকের মতে, আমাদেরকে মন যোগানো ছবির চাইতে মন জাগানো ছবি তৈরির দিকে বেশি মনোযোগী হতে হবে।
এই কথাগুলোর সূত্র ধরে বলা যায় আমাদের দেশের বাণিজ্যিক মন যোগানো চলচ্চিত্রগুলোতে ধর্ষণ দৃশ্যকে ব্যবসার উপাদান হিসেবে দেখা হচ্ছে। অর্থাৎ আমাদের এক বিপুল সংখ্যক দর্শক ধর্ষণের দৃশ্যকে অপরাধ হিসেবে না দেখে তাদের যৌন প্রবৃত্তির অংশ হিসেবে দেখছে। দর্শকের এই দৃষ্টিভঙ্গিটাও ভয়াবহ। সাধারণ জনগণের দৃষ্টিভঙ্গি তৈরিতে চলচ্চিত্র শিল্পী এবং জনপ্রিয় নায়ক নায়িকাদের এই বিষয়ে যথেষ্ট দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে ষাটের দশকের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা কবরী সারোয়ার বললেন, এসব লেখালেখি করে কিছুই হবেনা। কয়জন পড়ে এসব লেখা? আমাদের চলচ্চিত্রকে রক্ষা করতে হবে। ভালো চলচ্চিত্র তৈরি করার জন্যে আমাদেরকে যথেষ্ট অনুদান দেয়া হয়না। তাহলে ভালো চলচ্চিত্র কীভাবে আসবে। এখন সাংবাদিকরা পূর্ণিমা কী বললো না বললো সেটা নিয়ে নাচানাচি শুরু করেছে। পূর্ণিমা কে? সে তো কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি না। কবরী দেশের বড়মাপের শিল্পপতি এবং ব্যবসায়ীদের প্রতি চলচ্চিত্র মাধ্যমকে বাঁচানোর জন্যে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
সমালোচিত অনুষ্ঠানটিতে নিজের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে পূর্ণিমা ইতিমধ্যেই বলেছেন যে, তিনি মনে করেন, তিনি ওই অনুষ্ঠানে নিছকই একটি দৃশ্য নিয়ে কথা বলেছেন যা তারা চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে নিয়মিত করে আসছেন। তখন কেন এই দৃশ্যগুলো নিয়ে কেউ সমালোচনা করেনা এই নিয়েও প্রশ্ন তোলেন আলোচিত এই নায়িকা।

এই বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরিন তাঁর সাম্প্রতিক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ফর্মূলা ফিল্মগুলোতে ধর্ষণ যতবার উপস্থিত হয়, তা গল্পের প্রয়োজনে নয়। ধর্ষণ উপযোগী করে চিত্রনাট্য রচিত হয়। তার সঙ্গে থাকে যৌননিপীড়নের রোমান্টিকিকরণ। নায়ক নায়িকাকে অনুসরণ করে, অতীষ্ঠ করে, অঙ্গভঙ্গি করে, শিষ দিয়ে, বা যেভাবে একা অথবা বন্ধুবান্ধবসহ গান গেয়ে ও নৃত্য করে প্রেমে পড়তে বাধ্য করেন, এর প্রতিটি আচরণই যৌননিপীড়ন ও অপরাধ। সিনেমায় এর পৌনঃপুনিক উপস্থাপন যৌন-নিপীড়নকে প্রেমিকসুলভ স্বাভাবিক আচরণ হিসেবে বুঝতে শেখায়। সিনেমাজগতের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের দায়িত্ব এই দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা যৌনঅপরাধের স্বাভাবিকীকরণকে প্রশ্ন করা। এ অবস্থার পরিবর্তনে কাজ করা। এ নিয়ে হাসাহাসি করা নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক একটি টিভি আলাপে পূর্ণিমা ও মিশা সওদাগর যেভাবে আলাপ করেছেন, তা ‘ধর্ষণ’ ফমুর্লা ফিল্মে যে একটি বিনোদন উপকরণমাত্র, সেই অসহ্য সত্যকেই পুনঃদৃঢ় করেছে। পূর্ণিমা-মিশার টেলিভিশন আলাপ সিনেমায় ধর্ষণ ও যৌন-নিপীড়নের বাণিজ্যিক ব্যবহার নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ সৃষ্টিতে সহায়তা করুক।

বিজ্ঞাপন

প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই, জোরালো প্রতিবাদ হচ্ছে। এই প্রতিবাদ শুধু পূর্ণিমা উপস্থাপিত অনুষ্ঠানটির বিরুদ্ধে না হয়ে হোক যৌন সহিংসতাকে বাণিজ্যিক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে। এই প্রতিবাদকে উস্কে দেবার জন্যে পূর্ণিমাকে ধন্যবাদ জানানো যেতেই পারে!

 

 

সারাবাংলা/জেএম/এসএস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন