বিজ্ঞাপন

পেয়ারউদ্দিন খানের সাদা সুখ 

March 4, 2018 | 2:05 pm

কিযী তাহনিন

বিজ্ঞাপন

ট্রেনের ফার্স্টক্লাস কামরার ভেতর হন্তদন্ত হয়ে তিনি  ঢোকেন। মাঝবয়সী, মাথার সামনে থেকে ক্রমশ কমতে থাকা সাদা-কালো কোঁকড়া চুলের ফাঁকে, মোটা-সিঁথি উঁকি ঝুঁকি দেয়। মাঝারি উচ্চতা, চেহারায় পরিশ্রমের রেখা, সে রেখায় মধ্যবিত্ত ভাব প্রকট। হাতে মাঝারি সাইজের  খয়েরি রঙা কাপড়ের ব্যাগ।

ট্রেনে ঢুকেই বসে থাকা যাত্রীকে প্রশ্ন ছোড়েন: ভাই  এটা  টু বি না?

ওহ ডান দিকেরটা? হ্যাঁ হ্যাঁ এই তো, ভাই একটু দেখি, একটু সাইড, এই তো এই তো, হ্যাঁ ব্যাগটা একটু রাখি, ব্যাস, এই যে ব্যাস।

বিজ্ঞাপন

বসে, (সামনের যাত্রীর দিকে তাকিয়ে) আর একটু হলেই ট্রেন মিস করতাম ভাই, মিসেসের কারণে মিস, হা হা হা।

আসলে মিসেসের যন্ত্রণায়, আর বলেন না। গেলো ঈদে ছোটশালা বসুন্ধরা সিটি থেকে একটা দামি শাদা শার্ট কিনে দিয়েছিল। সেটা আজ পরেছিলাম। ফার্স্ট ক্লাসে চড়বো। আমাদের মতো মানুষের তো আর ফার্স্ট ক্লাসে চড়ার সুযোগ হয় না।

কথার মাঝে, জানালার বাইরে তাকিয়ে, চা-অলা কে ডাকেন।এই পিচ্চি, এই, দেখি একটা দৈনিক সূর্যের তাপ দাও তো, হ্যাঁ, ভাংতি দাও।  ভাংতি নাই মানে। বিক্রি বাট্টা করো ভাংতি থাকে না কেন?  আমার কাছেও নাই।  যাও, ওই সামনের দোকান থেকে চা নিয়ে আসো। ভাংতি করে আনো।

বিজ্ঞাপন

সামনে তাকিয়ে যাত্রীকে জিজ্ঞেস করেন, ভাই আপনি খাবেন?

(বাইরে তাকিয়ে চা-অলাকে) তাইলে এক কাপই আনো, প্লাস্টিকের কাপে আনবা। দৌড় দৌড়, ট্রেন ছেড়ে দিবে।…

(সামনে তাকিয়ে যাত্রীর উদ্দেশ্যে) ওহ তা যা বলছিলাম, আসার আগে, মিসেস দোআ পরে মাথায় ফুঁ দিতে যেয়ে, হাতের খুন্তির ঝোল লাগিয়ে দিলো সাদা শার্টে। বোঝেন? তা তোমার রান্নাঘরের খুন্তি হাতে নিয়ে দোয়া পড়তে আসার  দরকার কী? তারপর আর কি? হুলস্থূল।

আমার বড় জ্যাঠাশের বুদ্ধিতে শার্টের ওই হলুদ জায়গা ধুয়ে তার উপর এক গাদা ট্যালকম পাউডার লেপ্টে দিলো। সেই হলুদ আর পাউডার মাখামাখি হয়ে কেমন লালচে হয়ে যাচ্ছে-তাই হয়ে গেলো। সেটা পরে কি আর আসা যায় বলেন? তাই এই পুরনো শার্ট পরেই চলে এলাম।

বিজ্ঞাপন

(বাইরে তাকিয়ে চা-অলাকে আবার) এই যে, হ্যাঁ  দাও, আস্তে, কাপ তো গরম দেখি।  এই নাও এই দুই টাকা রেখে দাও। লাগবে না। বকশিস।

(চা খেতে খেতে, সামনের যাত্রীকে) ভাই কী করেন?

বলেন কী! ভাই টেলিকমে চাকরি করেন? বিশাল ব্যাপার। এখন তো ওদেরই জয় জয়কার। চিটাগংয়েই পোস্টিং নাকি? ওহ আমার ও। আমি অবশ্য ছোটোখাটো একটা চাকরি করি। জাহাঙ্গীর ব্রাদার্সের যে রূপা সয়াবিন তেল আছে না, ওই ডিপার্টমেন্টের ম্যানেজার।

হ্যাঁ তারা তো এখন সর্ষের তেলও  চালু করেছে। বলেন কী! আপনি খান নাকি? আরে, আপনার ঠিকানা দেন। আমি অনেক ফ্রি তেল পাই। এত দিয়ে কী করবো? আপনাকে পাঠিয়ে দিবো।

হা হা হা,  আরে না  ভাই ভুলবো না, দেখেন। ঠিক পাঠাবো। এই কোম্পানিতেই তো বারো বছর হয়ে গেলো। তিন বছর হলো চিটাগাংয়ে পোস্টিং। অফিসের অ্যানুয়াল পিকনিক ছিল, সেখানেই তো এই ঢাকা-চিটাগং ট্রেনের ফার্স্ট ক্লাস টিকেট জিতলাম লটারীতে, নাইলে কি আর আমার সামর্থ্য।

হালকা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, হাতের পেপারে চোখ রাখে।

আস্তে করে বলে, ট্রেন এত দেরি করছে কেন কে জানে, একবার বাইরের দিকে  তাকিয়ে, টেনের বাইরে দাঁড়ানো বাদাম খাওয়া মানুষটিকে জিজ্ঞেস করে, কি ভাই ট্রেন এত দেরি কেন? ছাড়বে না?

(সামনের দিকে তাকিয়ে যাত্রীকে উদ্দেশ্যে), বুঝেন, ভিআইপি যাবে, আর আমাদের দুর্ভোগ।

পেপার পড়ে মন দিয়ে, পেপারের দিকে তাকিয়েই বলে, পত্রিকাওয়ালাদেরও আজকাল খবরের অভাব পড়েছে। দেখেন কি লিখেছে, ‘নায়ক পুলক খান আজ চট্টগ্রামের একটি নতুন শপিং কমপ্লেক্স উদ্ভোধন করবেন’ বোঝেন নিউজের অবস্থা।

আজ তো তাইলে ওই রাস্তায় ভয়ানক ভিড় হবে। সব নায়ক দেখতে যাবে। লোকজনের তো খেয়ে দিয়ে কাজ নেই। ধুরর।…

পেপার ভাজ করে সামনের যাত্রীকে প্রশ্ন করেন, ভাই কি বিয়ে করেছেন?

হা হা হা, তাইলে তো আপনি সাহসী মানুষ।  আমি তো বলি, বিয়ে করতে বুকের পাটা লাগে। সাহসী মানুষ ছাড়া সম্ভব না। তা আমার মিসেসের আবার উত্তরের অভাব হয় না, বলে, ‘তুমি সাহসী না কচু। পুরো গুষ্টি নিয়ে আমাকে দেখতে আসছো। আর আমি এত মানুষের সামনে বসে একা পরীক্ষা দিছি। সাহসী হইলাম আমি।’

কথাটা কিন্তু সত্যি ভাই। আমার বৌ সাহসী মানুষ, পরিশ্রমীও।  এই যে আমার আপ ডাউনের চাকরি।  একা সংসার সামলায়। বাচ্চাদের স্কুল। স্বল্প আয়ের সংসার, কিন্তু আনন্দ আছে। দুঃখ নাই তেমন।

হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে, দেখেছেন ভাই? কত ক্যামেরা। সাংবাদিক। ওহ ওই ভিআইপির জন্য। বাহ্…

নাহ কোনো দুঃখ যে একদম নাই এটা ঠিক না, আছে। একটা স্বপ্ন ছিল আমার ছবি কখনো পত্রিকায় ছাপা হবে। তা হলো না। একবার বাজার করতে গেছি। টিভির সাংবাদিক ক্যামেরার সামনে দাঁড় করিয়ে বাজারদর নিয়ে প্রশ্ন করলো। আমিও খুব গুছিয়ে উত্তর দিলাম। পুরো সন্ধ্যা খবর ছেড়ে বসে থাকলাম, দেখলো না।

এর মাঝে টিকেট চেকার আসে পাশে, টিকিট চেক করতে। কথার ছন্দপতন হয়।

জ্বি জ্বি, আমার টিকেট টু বি, টিকেট দিচ্ছি।

উফ, কই গেলো টিকেট, এইখানেই তো ছিল। হায় হায়। দাঁড়ান ভাই দিচ্ছি দিচ্ছি, একটু। এইযে এই যে, (ব্যাগের পকেট থেকে বের করে দেয়), এই যে টু বি।

জ্বি? আমার নাম হলো পেয়ারুদ্দিন খান। আমার সিট না মানে? টিকেটে লেখা আছে আমার সিট নম্বর, অফিস থেকে কেটে দিয়েছে এই টিকেট।

প্রমাণ কী? এটা আমার সিট না? কার সিট? নায়ক পি খান? মানে পুলক খান? তো তো আমার নাম ও তো পি খান, পেয়ারুদ্দিন খান। এই যে এই যে দেখেন আমার ন্যাশনাল আইডি।

না, আমি সিট ছেড়ে উঠবো না। বললেই হলো।  টিকেটের লেখা সিটে আমি বসেছি। পি খানের নামে সিট বুক করা। আমার নাম পি খান। আমি কেন উঠবো। এটা কোন আইন? আমি অভিনেতা না সত্যি। কিন্তু সুযোগ থাকলে আমিও।

জ্বি আর রসিকতা করবো না। কিন্তু সিট ছেড়ে উঠবো না। আর বুঝলাম না নায়ক মানুষ ট্রেনে যাচ্ছেন কেন? উনারা তো প্লেনে চলাফেরা করে?

জ্বি, অবশ্যই আমার মাথাব্যথা না। কিন্তু এই সিট আমার, এইটা আমার মাথাব্যথা।

জ্বি ভাই, আমি তো কথা বলছি একজনের সাথে। আপনি আবার মাঝখান থেকে এসে কথা বলছেন কেন? ওহ ওহ, ওয়ালাইকুম সালাম। আমি বুঝেছি ভাই, আপনি নায়কের পিএস। আপনিও সম্মানিত ব্যক্তি। কিন্তু ভাই, আপনি কোন যুক্তিতে আমাকে উঠাবেন। আমি নায়ক না সেটা তো আমার দোষ না, সুযোগের অভাব (হা হা)l

ফার্স্ট ক্লাসে সিট্ খালি নাই আর সেটাও আমার দোষ না। আমার নাম পেয়ারুদ্দিন খান শর্টে পি খান, এই দোষও তো আমার না।বাপ মা নাম রাখসে।

ভাই আমি দুঃখিত। নায়ক সাহেবকে সেকেন্ড ক্লাসে যেতে হচ্ছে, উনার অভ্যাস না। কিন্তু আমি আমার সিট ছাড়বো না। দুঃখিত ভাই।

বড় করে নিঃস্বাস ছাড়েন তিনি। যাক বিদায় হলো। মগের মুল্লুক নাকি বলেন? এসে হম্বিতম্বি করলো আর সিট্ ছেড়ে দিবো? নায়ক হয়েছে তো কি হয়েছে?

কি ব্যাপার, এত ক্যামেরা। আরে এরা আমার ছবি তুলছে? সাংবাদিক নাকি। বলেন কী!

জানালার বাইরে সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে, ভাই আমার কোনো দোষ নাই, এটা আমার সিট টু বি, আমার নাম পি খান, পেয়ারউদ্দিন খান। একটু ভুল বোঝাবোঝি হয়েছিল, মিটে গেছে।

জ্বি জ্বি, নায়ক সাহেব সেকেন্ড ক্লাসে, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমি সেই লোক। জ্বি জ্বি,  আমার কারণেই। ঠিক, আমার নামও পি খান। নাম মিলে গেছে। কিন্তু সিট কিন্তু আমার ভাই। উনারা ভুল বুঝতে পেরেছেন। ফার্স্ট ক্লাস সিট আমার।

ছবি তুলছেন নাকি ভাই? কোন পত্রিকা ভাই?

পেয়ারউদ্দিন খান ওরফে পি খান হেসে ছবির জন্য পোজ দেয় জানালার বাইরে তাক করা সাংবাদিকের ক্যামেরায়।

ট্রেন চলতে শুরু করে।

সামনের যাত্রীর দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ সুখী পি খান বলেন, নাহ ভাই, এ জীবনে আর কোনো দুঃখ নাই। কাল পত্রিকায় আমার ছবি ছাপা হবে। শুধু যদি আজ সেই সাদা সুন্দর সাদা শার্টটা পরা থাকতাম। আহা।

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন