বিজ্ঞাপন

পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষ: স্থায়ী সমাধান কোথায়?

January 14, 2019 | 8:33 pm

।। রাজু আহমেদ।।

বিজ্ঞাপন

রফতানি আয়ের দিক থেকে দেশের সবচেয়ে বড় খাত পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের ঘটনা প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠেছে। নানা দাবিতে তাদের বিক্ষোভ-বিদ্রোহ সবসময় শান্তিপূর্ণ থাকছে না। শ্রমিক আন্দোলন তীব্র হওয়ার পর কারখানায় আগুন দেওয়ার মতো ঘটনাও বিভিন্ন সময়ে ঘটতে দেখা গেছে। প্রতিবার শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে উঠলেই মালিক সংগঠনের নেতারা ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ সামনে এনেছেন। তাদের মতে, বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাতকে ধ্বংস করতে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র চলছে। সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরাও প্রায় একই ধরনের বক্তব্য দিয়ে থাকেন। কিন্তু ২০০৬ সাল থেকে বার বার শ্রমিক আন্দোলনের পর একই ধরনের বক্তব্য দেওয়া হলেও সরকার বা মালিকপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো ‘ষড়যন্ত্রকারী শক্তি’ চিহ্নিত করতে পারেনি। বরং আন্দোলনের তেজ কমে এলে সামনের সারিতে থাকা শ্রমিকদের ওপর ছাঁটাইসহ নানা নির্যাতন চালানো হয়েছে। পোশাক শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে কথা বলেন, এমন দায়িত্বশীল শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। তবে কোনো কিছুতেই পোশাক শিল্পে শ্রমিক আন্দোলন একেবারে থেমে যায়নি।

এ পর্যন্ত পোশাক শিল্পে যতগুলো আন্দোলন হয়েছে, তার প্রায় সবগুলোই বেতন-ভাতা কেন্দ্রিক। বেতন বৃদ্ধি, বকেয়া বেতন আদায়, ঈদ বোনাস পরিশোধ ইত্যাদি দাবিতে আন্দোলনে নামছেন শ্রমিকরা। প্রথমে দুয়েকটি এলাকায় স্বল্পসংখ্যক শ্রমিক রাস্তায় নামলেও দ্রুতই তা ব্যাপক রূপ ধারণ করে। মোটামুটি এটাই পোশাক শ্রমিক আন্দোলনের সাধারণ চিত্র। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

এবার শ্রমিক অসন্তোষের সূচনা মজুরি কাঠামো নিয়ে। সরকার গঠিত মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী গত বছরের নভেম্বরে পোশাক শিল্পের জন্য নতুন মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ডিসেম্বর থেকে এই মজুরি বাস্তবায়ন শুরু হয়। এতে সর্বনিম্ন গ্রেডের শ্রমিকদের ন্যূনতম মোট মজুরি ২ হাজার ৭০০ টাকা বাড়িয়ে ৮ হাজার টাকা করা হয়। মজুরি কাঠামো ঘোষণার পর অনেক শ্রমিক সংগঠনই এ নিয়ে আপত্তি জানায়। তবে শুরুতে সাধারণ শ্রমিকদের মধ্যে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। তাদের মধ্যে অসন্তোষ শুরু হয় ডিসেম্বর মাসের বেতন পাওয়ার পর। দেখা যায়, আগের মজুরি কাঠামোর সঙ্গে গত পাঁচ বছর ধরে পাওয়া বর্ধিত বেতন সমন্বয় না করায় তিনটি গ্রেডের শ্রমিকদের মূল বেতন কমে গেছে। শুধু তাই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওপরের পদের সঙ্গে নিচের পদের মোট বেতনের পার্থক্য নেই বললেই চলে। বাড়ি ভাড়ার অংশ বাড়িয়ে মোট বেতন বেশি দেখানো হলেও মূল বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ একেবারেই সামান্য। এতে শ্রমিকদের বার্ষিক বেতন বৃদ্ধির পরিমাণ যেমন কমে যাবে, তেমনি উৎসব ভাতা পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিজ্ঞাপন

এসব কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলনে শ্রমিকরা নামে। এবারও কেউ কেউ ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ সামনে আনলেও সরকার দ্রুত এ বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন দায়িত্ব নিয়েই পোশাক শিল্প শ্রমিকদের এই সমস্যা সমাধানে তৎপর হন বাণিজ্যমন্ত্রী ও শ্রম প্রতিমন্ত্রী। ত্রিপক্ষীয় মজুরি কাঠামো নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। তবে এর মধ্য দিয়ে পোশাক শিল্পে শ্রমিক অসন্তোষের স্থায়ী সমাধান হচ্ছে— এ কথা হলফ করে বলা যায় না।

পোশাক শিল্প শ্রমিকদের সাম্প্রতিক আন্দোলনগুলোকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে বিচারের চেষ্টা করা হলেও তাদের বাঁচার মতো ন্যূনতম মজুরি এবং ট্রেড ইউনিয়ন অধিকারের মতো মৌলিক বিষয় দু’টিকে সামনে নিয়ে এসেছে। শ্রমমান উন্নয়নের জন্য আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার কারণে সরকার ও মালিক পক্ষও শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে।

মালিকপক্ষ থেকে প্রতিবারই বলা হয়েছে, শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হলে উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) অনেক আগের একটি জরিপে দেখা গেছে, একটি পোশাক কারখানায় ১০০ টাকা মূল্যের পণ্য উৎপাদনে মজুরি ছাড়া মোট ব্যয় হয় ৬৯ টাকা। ফলে এক্ষেত্রে মূল্য সংযোজিত হয় ৩১ টাকা। এর মধ্যে মালিক পায় ২৪ টাকা, আর শ্রমিকরা পায় ৭ টাকা। গত বছর প্রকাশিত অক্সফামের এক জরিপ প্রতিবেদনে দেখা যায়, বিশ্বের সাতটি বৃহৎ পোশাক উৎপাদনকারী দেশের মধ্যে বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি সবচেয়ে কম। দেশে একজন শ্রমিকের মানসম্মত জীবনযাপনের জন্য ২৫২ ডলার সমপরিমাণ অর্থ প্রয়োজন। সেখানে তিনি মজুরি পান মাত্র ৫০ ডলার। শুধু পোশাক শিল্প নয়, সামগ্রিকভাবেই দক্ষিণ এশিয়া বা এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে শ্রমিকের মজুরি গড় হিসেবে সবচেয়ে কম। বাংলাদেশে গড়ে একজন শ্রমিকের প্রতিদিনের মজুরি ১৭৬ টাকা ৬৭ পয়সা (২ দশমিক ১৯ ইউএস ডলার)। এর পরিমাণ ভারতে ২ দশমিক ৪০ ডলার, পাকিস্তানে ৩ দশমিক ১৫ ডলার, মিয়ানমারে ২ দশমিক ১৬ ডলার।

বিজ্ঞাপন

শ্রমিক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রতিবারই মালিক সংগঠনের পক্ষ থেকে যে বক্তব্য দেওয়া হয়েছে, তার মোদ্দা কথা হলো— দেশের পোশাক শিল্প ধ্বংসের জন্য তৃতীয় একটি পক্ষ গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ কারণেই পোশাক কারখানাগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ তৈরি করা হচ্ছে। তাদের বক্তব্যে মনে হয়, দেশের লাখ লাখ পোশাক শ্রমিক খুব সুখে আছে। আর তাদের এ সুখ সহ্য হচ্ছে না তথাকথিত তৃতীয় শক্তির। ফলে নিরীহ শ্রমিকদের নামে ভাড়া করা লোক এনে কারখানা ভাঙচুর ও আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পকে ঘিরে দেশি-বিদেশি কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ কাজ করছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। এ বিষয়ে প্রকৃত তথ্য উদঘাটনের দায়িত্ব সরকারের। এ ধরনের স্পর্শকাতর বিষয়ে বার বার শুন্যে ঢিল না ছোঁড়ে, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে সত্য-মিথ্যা নির্ণয় করা জরুরি। কারণ প্রমাণ ছাড়াই বার বার ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ সামনে নিয়ে আসায় শুধু শ্রমিক আন্দোলনই কলঙ্কিত হচ্ছে না, বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যেও তা ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ফলে প্রকৃতপক্ষেই কোনো ‘ষড়যন্ত্র’ কাজ করছে কি না, সে বিষয়ে সঠিক তথ্য উদঘাটন ও প্রচার করা জরুরি।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি হলো— কর্মপরিবেশ, মজুরি বা অন্য কোনো সমস্যা না থাকলে শ্রমিকরা কেন বার বার ‘ষড়যন্ত্রকারীদের’ দ্বারা বিভ্রান্ত হবেন? আসলেই কি সুখে আছেন তারা? সাংবাদিকতা পেশার কারণে গত দেড় দশকে পোশাক শিল্পের সাধারণ শ্রমিক, শ্রমিক নেতৃত্ব এবং বিজিএমইএ-বিকেএমইএ নেতাদের সঙ্গে বহুবার এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছি। শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ ও জীবনযাত্রা দেখে নিজের বোধ-বুদ্ধিতে যতটুকু বুঝেছি, সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করলেও দেশের পোশাক শিল্পের শ্রমিকরাই সবচেয়ে বেশি বঞ্চিত। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মজুরি-শোষণের শিকার হয়ে শ্রমিকদের প্রাত্যহিক জীবন হয়ে উঠেছে অমানবিক। দিন-রাত পরিশ্রম করে উৎপাদন সচল রাখলেও অত্যন্ত কম মজুরি ও সুযোগ-সুবিধা পায় এ শিল্পের শ্রমিকরা। এই মজুরিও সময়মতো মাসের প্রথম সপ্তাহে দেওয়া হয় না। শ্রমিকরা যেন কাজ ছেড়ে যেতে না পারে, সেজন্য অনেক কারখানায় প্রতি মাসের মজুরি ১৫ থেকে ২০ দিন পরে দেওয়া হয়। অনেক কারখানায় ওভারটাইম বাকি থাকে দেড় দু’মাসের। আহত-নিহত হলে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে বলে কোথাও কোথাও শ্রমিকদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। ছুটি নিতে হয় বিনা বেতনে। অধিকাংশ কারখানায় ছুটির দিনেও কাজ করতে হয়। সেক্ষেত্রে ওভারটাইম মিলে মূল বেতনের সমান হারে। মালিকদের আন্তরিকতা সত্ত্বেও অনেক ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের আচরণ শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি করে। এসব সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের বিক্ষোভ, মানববন্ধন, বিজিএমইএ ঘেরাও ইত্যাদি কর্মসূচি প্রায় নিয়মিত ঘটনা। বৃহৎ পরিসরেও প্রায় প্রতিবছরই রাস্তায় নামছেন শ্রমিকরা। কখনও কখনও তাদের আন্দোলন পরিণত হচ্ছে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে।

একদিকে শ্রমিক অসন্তোষ, অন্যদিকে এর পেছনে ‘দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র’ রয়েছে— এ ধরনের অভিযোগ বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। ফলে শ্রমিক আন্দোলনের নেপথ্যের প্রকৃত কারণ নির্ণয় করে অতি দ্রুত এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি পূরণ করাই হবে ‘ষড়যন্ত্রের’ দুয়ার বন্ধ করার সবচেয়ে শক্তিশালী উপায়। কারণ শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ না থাকলে কোনো ষড়যন্ত্রকারী তা ব্যবহার করে ফায়দা নিতে পারবে না। আর এরপরও ‘ষড়যন্ত্র’ অব্যাহত থাকলে তা উদ্ঘাটন করা সহজ হবে।

বিজ্ঞাপন

শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনাগুলো সময়মতো পরিশোধ ও নির্যাতনমূলক ব্যবস্থাগুলোর অবসান ঘটাতে না পারলে কোনো ব্যবস্থা দিয়েই শ্রমিকদের ক্ষোভ দমন করা যাবে না। আর সব সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন নিয়মিতভাবে শ্রমিকদের অভিযোগগুলো তুলে ধরার ব্যবস্থা। কর্মস্থলে দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন দিলে, আইন ভঙ্গকারী কর্মকর্তা বা নিরাপত্তাকর্মীদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করলে, দুর্মূল্যের বাজারে তাদের ন্যায্য মজুরি নিয়মিত পরিশোধ করলে এবং মানবাধিকার রক্ষায় সচেষ্ট হলে শুধু শ্রমিকদের ক্ষোভের প্রশমনই ঘটবে না, কারখানার উৎপাদনশীলতাও বৃদ্ধি পাবে। শ্রমিকদের মধ্যে কারখানার প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হলে এ শিল্পের বিরুদ্ধে যে কোনো ষড়যন্ত্র তারাই রুখে দেবে।

লেখক: প্রধান প্রতিবেদক, জিটিভি

razubangla@hotmail.com

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags:

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন