বিজ্ঞাপন

প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সুষম বণ্টন না থাকায় বাড়ছে ধনীর সংখ্যা

September 22, 2018 | 11:50 am

।। এমদাদুল হক তুহিন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: দেশের প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। এমন প্রবৃদ্ধির দেশ বিশ্বেই অনেক কম। বেড়েছে মাথাপিছু আয়। স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ এখন মধ্য আয়ের দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবার পথে। বাস্তবায়ন হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের প্রকল্প। এতসব বিষয়ে এগিয়ে গেলেও ধনীর তালিকায় শীর্ষে থাকাকে অস্বস্তিকর ভাবেই দেখছেন আর্থিক খাত বিশ্লেষকেরা।

অর্থনীতিবিদ ও আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশের প্রথম ধাপে উত্তরণ, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি, আয় বৈষম্য, ঋণখেলাপী, দুর্নীতি ও অনিয়মের সামগ্রিক প্রভাবেই দেশে ‘অতি ধনীর’ সংখ্যা বেড়েছে। তাদের মতে, দেশে ‘অতি ধনীর’ উত্থান হঠাৎ কোনো বিষয় নয়। তবে, প্রবৃদ্ধির হারে বিশ্বের শীর্ষে থাকা ধনীর তালিকা বাংলাদেশের মত দেশের জন্য অস্বস্তিকর। যারা বিপুল এই সম্পদ অর্জন করেছেন, তার উৎস ও প্রক্রিয়া খতিয়ে দেখা উচিৎ।

সম্প্রতি প্রকাশিত লন্ডন ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ এক্স’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অতি ধনীর বাড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষেস। বাংলাদেশে অতি ধনী বাড়ার হার ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ। এরপরের অবস্থানে রয়েছে চীন। দেশটিতে অতি ধনীর সংখ্যা বাড়ার হার ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ। পরের অবস্থানগুলোতে রয়েছে ভিয়েতনাম, কেনিয়া, ভারত, হংকং এবং আয়ারল্যান্ড।

বিজ্ঞাপন

যাদের সম্পদের পরিমাণ ৩ কোটি ডলার বা তার চেয়ে বেশি তাদেরকেই অতি ধনী বা ‘আল্ট্রা হাই নেট ওয়ার্থ (ইউএইচএনডাব্লিউ) বলে মনে করছে ওয়েলথ এক্স। সে হিসেবে যাদের সম্পদ আড়াইশো কোটি টাকার বেশি তারাই অতি ধনী। ২০১২-১৭ সালের উপর ভিত্তি করে ওই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।

দেশে ‘অতি ধনী’ বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটার মূল কারণ হচ্ছে আমাদের এখানে আমরা শুধু প্রবৃদ্ধি নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। বন্টনের ব্যাপারে অর্থাৎ সমাজের মধ্যবিত্ত এবং নিচু স্তরে উন্নয়নের সুফল কিভাবে পৌঁছাবে সে ব্যাপারে কিন্তু কনফার্ম ছিলাম না। আমাদের কোনো পলিসিগত ইস্যু ছিল না। ফলে দিনে দিনে আয় ও সম্পদের বৈষম্য বাড়ায় অতি ধনীর সংখ্যা বেড়েছে।’

তবে, ধনী হওয়ার পথে তাদের নিজস্ব কিছু সক্ষমতা আছে উল্লেখ করে সাবেক এই গভর্নর বলেন, ‘তাদের হয়তো কিছুটা সক্ষমতা আছে কিন্তু তারা ক্ষমতার কাছাকাছি, রাজনীতির কাছাকাছি এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত। এজন্য তারা সরকারের নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পেয়েছে। ব্যাংকের সুবিধা নিয়েছে। বিপরীতে অন্যদের মধ্যে যারা অনেক দক্ষ আছে তারা কিন্তু এসব সুযোগ সুবিধা পায়নি। এতে উন্নয়নের যে নেতিবাচক দিক সেটা প্রকাশ পেয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

‘আমরা প্রবৃদ্ধি দেখছি, সুষম বন্টন দেখছি না। সমতা ভিত্তিক উন্নয়ন দেখছি না। তার জন্য শিক্ষা-স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান সবদিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আমাদের আর্থিক নীতি, বাজেট, রাজস্ব ব্যবস্থা ও কর কাঠামো সুষম উন্নয়নের জন্য সহায়ক নয়। এগুলোর সংস্কার হওয়া উচিৎ।’ বলেন ড. সালেহ উদ্দিন।

অতি ধনী বাড়ার কারণ জানতে চাইলে বিষয়টিকে ‘স্বাভাবিক’ উল্লেখ করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটা তো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়বেই। এটাতো স্বাভাবিক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশের আয় বাড়ে, সম্পদ বাড়ে, আয়ের যে বৈষম্য সেটাও অনেক বেড়েছে।  তাছাড়াও আয় বৈষম্য বৃদ্ধি আরেকটি কারণ। তবে আমাদের দেশে অতি ধনী বাড়ার প্রবৃদ্ধি হার বেশি। কিন্তু সংখ্যার দিক থেকে সেটি বেশি হবে না।’

মির্জা আজিজুল আরও বলেন, ‘উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রথম ধাপে সাধারণত আয় বৈষম্য বাড়েই। পরবর্তীতে হয়তো আস্তে আস্তে কমে। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে যারা এই অর্থটা অর্জন করেছে, সেটা কী বৈধ না অবৈধ পথে; তা খতিয়ে দেখা দরকার। আবার এই সম্পদগুলো দেশে আছে, না দেশের বাইরে গেছে সেটাও দেখা দরকার।’

ওয়েল এক্সের প্রতিবেদনে বাংলাদেশে সম্পদ ও আয় বৈষম্য বৃদ্ধির চলমান ঘটনারই প্রতিফলন ঘটছে বলে মনে করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন সময়ে বলে আসছি আমাদের দেশে এক অর্থে সম্পদের বৈষম্য বাড়ছেই। বিবিএস’র ২০১০ এবং ২০১৬ সালের যে খানা জরিপ, সেখান থেকেও যেটা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশের আয় বৈষম্য বাড়ছে। বাড়ছে সম্পদ বৈষম্যও। আর সেটারই একটা প্রতিফলন ঘটেছে এই রিপোর্টে।’

বিজ্ঞাপন

দেশে রাজস্ব নীতির মাধ্যমে সম্পদ পুন:বন্টনের নীতি নেই উল্লেখ করে মোস্তাফিজ বলেন, ‘করের মাধ্যমে আয় পুনঃবন্টনের যে প্রক্রিয়া বিভিন্ন দেশে আছে, যারা অনেক সম্পদ এবং আয়ের মালিক, তাদের উপর অনেক উচ্চ কর আরোপ করে সম্পদের পুনঃবন্টন করা, সেটা আমাদের দেশে নেই। বিপরীতে অনেক সময় দেখা যায় এই সব আয় এবং অনেক সম্পদ করের আওতার বাইরে থেকে যাচ্ছে।’

অতি ধনী বাড়ার কারণ উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘অনেকেই বিভিন্ন সম্পদ আয় করছেন যেগুলো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। সেগুলোর কারণেও আয় বৈষম্য বাড়ছে। ঋণ নিয়ে অনেকে ঋণ খেলাপী হচ্ছে। ঋণের টাকা ব্যাংকে ফেরত দেওয়া হচ্ছে না। সেটার কারণেও কারো কারো হাতে অনেক সম্পদ জমা হচ্ছে। এসব কারণে আমাদের দেশে অতি ধনীর সংখ্যা বাড়ছে।’

‘অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে কিছু কিছু মানুষের ধন-সম্পদ সৃষ্টি হবে, সেটা তো অস্বীকার করা যায়না। কিন্তু অতি ধনী বাড়ার ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধির হারে বিশ্বের শীর্ষে আছি সেটা কিন্তু স্বস্তিদায়ক কোনো ঘটনা নয়। এবং এটা হচ্ছে দুর্নীতি, ঋণখেলাপী, আয়কর না দেয়ার কারণে। আর এসব কারণেই একটা শ্রেণির কাছে অর্থের পাহাড় গড়ে উঠছে।’ বলেন সিপিডির এই বিশেষ ফেলো।

অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদের মতে, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সঙ্গে অতি ধনী বাড়ার সংখ্যা ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র এই রিসার্চ ফেলো বলেন, ‘দেশের দ্রুত উন্নয়নের কারণে মানুষের আয়ও দ্রুত বেড়েছে। গত পাঁচ বছরে আমাদের আয় বেড়েছে ৩১ শতাংশ। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সুফলটা মূলত ধনীরা পাচ্ছে। সেই বিচারে ধনীরা যেহেতু সুফলটা পাচ্ছে, ধনীদের ভিতরে আরও ধনীর সংখ্যা বাড়বে। ফলে যাদের উচ্চ আয় তাদের আয় আরও বেশি হারে বাড়ছে। এতে ধনীদের সংখ্যা বাড়ছে। যে ধনীর কাছাকাছি ছিল, সে এখন ধনী। যে ছোট ধনী ছিল, সে এখন বড় ধনী। গরিবের আয় কিন্তু সে হারে বাড়েনি। সরকারি হিসেব মতে, উচ্চ আয়ের ১০ শতাংশ মানুষের কাছে দেশের সম্পদের ৪০ শতাংশ। সেই ধারাবাহিকতায় যেহেতু ধনীদের আয় বাড়ছে সেহেতু ধনীদের সংখ্যা আরও বাড়ার কথা।’

সারাবাংলাকে ড. নাজনীন আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে ‘অতি ধনীর’ উত্থান হঠাৎ কোনো বিষয় নয়। গত কয়েক বছরে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে গতিধারা আমরা লক্ষ্য করছি সেটার গড় বিচারে একটি দেশকে দ্রুত এগিয়ে নিচ্ছে। পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করেছি অর্থনৈতিক অগ্রগতির সুফলটা ধনী শ্রেণির হাতেই যাচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতারই একটা ফলাফল এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। ধনী বাড়ার কারণ হচ্ছে যেহেতু উপরের শ্রেণির হাতে সবচেয়ে বেশি সম্পদ এবং এটা একটা রাইজিং ইকোনমি। রাইজিং ইকোনোমির মানেই হচ্ছে ধনীরা সবচেয়ে বেশি সুযোগ দ্রুত নিতে পারছে। যে গরীব সে দ্রুত নিতে পারছে না। তখন সরকারকে সম্পদ পুন:বন্টনের দিকে যেতে হয়। ধনীদের কাছ থেকে নিয়ে গরিবকে দেয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। তাহলে আয় বৈষম্যটা কমে।’

অতি ধনী সৃষ্টি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান আবদুল মজিদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমাজে যেখানে স্বচ্ছতার দায় নেই, সুশাসন নেই, ব্যাংকিং খাতে লুটপাট এবং ডাকাতি, প্রকল্প বাস্তবায়নে দ্বিগুণের বেশি খরচ, প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক নিয়োগেও ১৩ লাখ টাকার মতো ঘুষ সেখানে এই বৈষম্যতো বাড়বেই। সাধারণত যখনই সামষ্টিক অর্থনীতিতে ন্যায়-নীতি, নিয়ম-কানুন এবং বিচারের ঠিক থাকে না, যখন প্রতিকার ঠিক মতো না হয়; তখনই এগুলা হয়। আর তখনই একটি শ্রেণি অতি ধনী হয়ে উঠে।’

এদিকে, অতি ধনী বাড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সবার শীর্ষে থাকায় অর্থনীতিবিদরা শঙ্কা প্রকাশ করলেও বিষয়টিকে সুখবর হিসেবে দেখছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন। তার মতে, নিজ পরিশ্রমে যারা ‘অতি ধনী’ হয়েছেন তাদের অভিনন্দন প্রাপ্য।

সারাবাংলাকে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ‘কেউ যদি কর দেয়, দিয়ে যদি ধনী হয়, এটাতে কোনো সমস্যা দেখছি না। নিশ্চয়ই এটা তার অধ্যাবসায় ও কঠোর পরিশ্রমের ফসল। এটাতো সুখবর। আমি তো চাই বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটি বাংলাদেশে হোক। ধনী হওয়াতে দোষ নেই। তবে যে লোকগুলো ধনী হচ্ছে, তাদের যেভাবে কর দেয়ার কথা সেভাবে দিচ্ছে কি-না, সে সৎপথে ব্যবসা করছে কি-না, শ্রমিকের মজুরি ঠিক মতো দিচ্ছে কি-না তা খতিয়ে দেখা উচিৎ।’

ব্যবসায়ী সংগঠনের শীর্ষ নেতা শফিউল ইসলাম আরও বলেন, ‘যিনি ধনী হয়েছেন নিশ্চয় তিনি কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছেন, অনেক বিনিয়োগ করেছেন, অর্থনীতিতে তার অংশীদারিত্ব ছিল বলেই সে ধনী হয়েছে। যারা ধনী হয়েছেন তাদের ভিত্তিটা সঠিক কী-না, আমার মনে হয় তা গুরুত্বপূর্ণ।’

সারাবাংলা/ইএইচটি/জেএএম

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন