বিজ্ঞাপন

প্রোপাগান্ডার দিনবদল আর স্বাধীনতাবিরোধীদের মাস্টারস্ট্রোক

April 24, 2018 | 10:50 pm

।। রফিক উল্লাহ রোমেল।।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রচারণা তথা প্রোপাগান্ডার কৌশল বড়ই অদ্ভূত। একই সাথে অদ্ভুত এবং সঙ্গতিহীন। আবার একই সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু ‘মাস্টার সোর্স’  থেকে আদেশ পাওয়া।  এই মাস্টারসোর্সটি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবসময়ই স্বাধীনতাবিরোধী।  এরা বেশিরভাগ সময়ই সরাসরি জামায়াত ইসলামী ও শিবির, আবার কখনো তাদের অনুসারী প্রেতাত্মা।

দুই প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী বিএনপির নিজস্ব প্রোপাগান্ডা সার্কেল আছে বটে। কিন্তু তাদের পরিপক্কতা জামায়াত-শিবিরের ধারেকাছেও না। আওয়ামী লীগ এই বিষয়টির শিখতে শুরুই করেছে ২০০০’এর নির্বাচনে হারার পরে। বিএনপির এই সংক্রান্ত কোন সচেতনতা বা নিয়মিত ভাবনাই নেই। দেশের বাইরের ভাড়া করা দল দিয়ে চলে রাজনৈতিক দলটির এই কর্মকাণ্ড।  এমন কি অনেকসময় আওয়ামী ঘরানার লোকদের দিয়েও কাজ চালিয়ে নেয় তারা।  তবে বিএনপির মুল যুদ্ধ যেহেতু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে, তারা তাই সবসময়ই চায় ঘুরে ফিরে জামায়াতের অনুসারী প্রেতাত্মা হতে।

বাংলাদেশে আওয়ামীবিরোধী যে কোনো আন্দোলনে অনিবার্যভাবেই জামায়াত আর তাদের বাস্তুসংস্থানে থাকা হালের ইসলামিক স্টেট (আইএস), সৌদি ঘরানার আন্ডারগ্রাউন্ড ও বিভিন্ন দলে ঘাপটি মেরে থাকা সদস্যরা সক্রিয় থাকে। এই বাস্তুসংস্থানে বিএনপি নেই। আর এই খেলা বিএনপির জন্মেরও আগের। তবে বিএনপি এই বাস্তুসংস্থানের প্রধান সুবিধাভোগী। তবে নিজে এই খেলার অংশ হতে জাতীয়তাবাদী দলটি কোনোদিন চায়নি অথবা তাদের সেই সক্ষমতাই নেই।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময়ে যা হয়েছে, তাতে বিএনপির ভবিষ্যৎ আশা ভরসার স্থলটিও বিলীন হয়ে গেছে বললে অত্যুক্তি হবে না। এই ঘটনায় আর রাজনীতির কিছু আর বাকি নেই।  পুরোটাই আক্রোশ আর দমনপীড়ন।  সাংবাদিকের ক্যামেরা কেড়ে নেয়ার ঘটনায় অবাক হওয়ারও কিছু নেই।

কারো নেতৃত্বে যখন কোনো কিছু হয়, তখন নেতৃত্বের সাফল্য-ব্যর্থতা সেই বস্তু বা অর্জনের সাফল্য-ব্যর্থতায় রূপান্তরিত হয়।আওয়ামী লীগ দেশ স্বাধীন করেছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীন করেছেন- এই বিশ্বাসটিওকে মানুষ চ্যালেঞ্জ করতে ছাড়েনি।  বাসন্তীর জাল, দুর্ভিক্ষ, শেখ কামালের ব্যাংক লুট ইত্যাদি একাত্তর পরবর্তী প্রোপাগান্ডায় জাতির মহানতম সত্যটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছিল বারবার।

অথচ এই ঘটনাগুলোর বড় অংশই সরাসরি মিথ্যা, নয়তো সাজানো। বাকি অংশ অতিরঞ্জিত।  আর অতি অল্প অংশ সত্য। সেই অতি অল্প অংশ দিয়েই জনগণের উপলব্দিকে সুনিপুণভাবে পরিবর্তন করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

স্বাধীনতার এতো বছর পরে আজও স্পষ্টভাবে জানা যায়নি কুড়িগ্রামের চিলমারিতে অমন জাল পরে ঘুরে বেড়ানো নারীর সংখ্যা কত ছিল! বা আদৌ ছিল কি! কোন ব্যাংকটি শেখ কামাল তার দলবল নিয়ে দখল করতে গিয়েছিলেন। এসব বস্তুনিষ্ঠ তথ্যগুলি জানাই গেল না, অথচ ঘটনাগুলো ছড়িয়ে গেল সবার মুখে মুখে।! জানা ও প্রচারের সম্ভাবনা কিন্তু কম ছিল না।  কারণ যারা এই ঘটনাগুলোকে প্রচার করেছেন তারাতো দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন।

বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর সারাদেশে সেনা নামিয়ে ভয়ংকর অবস্থা সৃষ্টি করে বলা হয়েছিল, বঙ্গবন্ধুর জানাজায় মানুষ হয়নি কারণ মানুষ তাকে পছন্দ করতেন না। অথচ বিরোধী দলের ডাকা হরতালে যখন মানুষ আসে না, তখন বলা হয় সরকার আসতে দেয়নি।

বিডিআরের হত্যাকাণ্ডের দিনে দেড়শ’র ওপরে অফিসার হত্যার খবর রটে যায়, যদিও সেখানে এত অফিসার ছিলেনই না। হেফাজতের বিশ হাজার গুমের খবর রটে যায়।  মানুষের অনেকে বিশ্বাসও করে। কিন্তু একরাতের মধ্যে যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আর বিমানবাহিনীর পাঁচশ সেনা-কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছিল কোর্ট মার্শালের নামে তার কোনো বিচারই হয়নি।

‘শহীদ’ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডে এমন লোকের কোর্ট মার্শালে ফাঁসি হয়েছে যিনি ঘটনাস্থলেই ছিলেন না। প্রধান সন্দেহভাজন জেনারেল মঞ্জুরকে আইনের আওতায় আনার আগেই হত্যা করা হয়। সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার কেউ করতেই চায়নি।  জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বারবার ক্ষমতায় থেকেও জিয়া বা মঞ্জুর কারো হত্যাকাণ্ডেরই পুনঃতদন্ত করেনি। কেন করে নি? কার স্বার্থে! এসব প্রশ্নের জবাব চাইতে গেলেই মুখে রা।

বিজ্ঞাপন

শিশুপুত্র পরিবারসহ জাতির জনককে হত্যা আর জাতীয় চার নেতার হত্যাসহ সব হত্যাকাণ্ডকে আইন করে বন্ধ রাখা হয়েছিল। আইন করে হত্যাকাণ্ডের বিচার বন্ধ, কোন শাসনব্যবস্থা এটা সমর্থন করে! অথচ এইসবই হয়েছে আমাদের দেশে।

বিচারহীনতার রাজনীতি আর সংস্কৃতি দেশে কবে কিভাবে শুরু হয়েছে সেই ইতিহাসটাই ইতিহাস থেকে ধুয়ে মুছে সাফ করে ফেলা হয়েছে অতি সন্তর্পনে। কখনো আইন করে- যেমন ইনডেমনিটি, কখনো সংবিধান পরিবর্তন করে, যেমন পঞ্চম সংশোধনি, কখনো আগা থেকে গোড়া পুরো পাঠ্য বই পরিবর্তন করে। যেমন আমরা ছেলেবেলায় সমাজপাঠ থেকে শিখিইনি বঙ্গবন্ধু কে! স্বাধীনতার ঘোষণা ২৭ মার্চ একজন মেজর পড়ে শোনালেও বইয়ে কেন লেখা ২৬ মার্চ আমাদের জাতীয় দিবস!

এসব অন্যায় আর অনাচার আমরা আমাদের মত মানিয়ে নিয়েছিলাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করে প্রচার করছিলাম- থাক, এর চেয়ে শান্তিতে থাকাটাই উত্তম!

এখন যারা সুফিয়া কামাল হলের ছাত্রলীগের নেত্রী এশা বা চট্টগ্রামের নেতা রনির কীর্তিকলাপে ঘুমাতে পারছেন না, মস্তিষ্কে বিকৃতি অনুভব করছেন- তারা ইন্দু, তারা, জোসেফ, প্রকাশ, বিকাশ, সুইডেন আসলাম, পিচ্চি হান্নান, কালা জাহাঙ্গীরের নামই শোনেননি কখনো। শোনেননি পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির নাম। আবছা শুনছেন বাংলা ভাইয়ের নাম। জানেনই না কারা কবে কিভাবে এদের উচ্ছেদ শুরু করেছিল…।

গুলশানের হলি আর্টিজানের পরের সাত দিন যে পুরো ঢাকা শহরে প্রায় কবরের নিস্তব্ধতা ছিল, তার কারণ কিন্তু এটাই।  সংগ্রামমুখর বাংলাদেশকে এই প্রজন্ম দেখেননি। তাই সংগ্রাম সম্পর্কে এদের কোনো ধারণা নেই। এদের মধ্যে সবচেয়ে ভাল যে বোঝেন, তার বোঝার মাত্রাটিও অনেক অনেক কম। এদের জন্মই উন্নয়নশীল বাংলাদেশে আর উন্নয়নকে গালি দিতে দিতে।  ঠিক যেমনি করে একাত্তর পরবর্তী সব রাজাকার আর মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরাই এদেশে বড় ব্যবসায়ের মালিক হয়েছিল। স্বাধীনতা কে গালি দিতে দিতে, ঠিক সেভাবেই।

পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতাকে গালি চলতো, বাকশালের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার চলতো, তখনো ছাত্রলীগের নেতাদের গালাগাল চলতো। আর যারা এই গালাগাল করতো, এখানকার আওয়ামী লীগ তাদের অনেককেই পরম মমতায় দলে জায়গা করে দিয়েছে!

এখনো তেমনভাবে উন্নয়নকে গালাগাল চলে।  সময় যায়।  প্রজন্ম বদলায়।  কিন্তু প্রোপাগান্ডার ধরণ বদলায় না।  স্বাধীনতাবিরোধী আর তাদের অনুসারী প্রেতাত্মাদের মাস্টারস্ট্রোকও থামে না।

 

লেখক : সিইও ,কনটেন্ট ম্যাটারস, ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, সারাবাংলা ডট নেট

সারাবাংলা/ এসবি

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন