Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

সিভি রাইটিং: পক্ষে-বিপক্ষে এবং মধ্যবর্তী বাস্তবতা


৯ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০৩:৪৪

মোনালিসার স্রষ্টা বহুগুণে গুণান্বিত কালজয়ী চিত্রশিল্পী লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি’কে খুব সম্ভবত প্রথম সিভি (কারিকুলাম ভিটা) লেখার কৃতিত্ব দেওয়া হয়। ১৪৮২ সালে ভিঞ্চি-ই সর্বপ্রথম ডিউক অব মিলানের নিকট সামরিক প্রকৌশলী পদে চাকরির আবেদন করতে যেয়ে তার কর্মদক্ষতার বর্ণনা দিয়ে যে নথিটি তৈরি করেছিলেন সেটিকেই আজকের বহুল ব্যবহৃত সিভি বা রিজিউমি-এর প্রথম ব্যবহার বলা যেতে পারে। তবে সিভি’র ইতিহাস বিষয়ে আমার এই জ্ঞান সামান্য কিছু গুগোল সার্চের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তাই কোনো পাঠকের কাছে যদি এ সম্পর্কে অন্য কোনো তথ্য থাকে তবে আমি অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। তবে সিভি বা রিজিউমি-এর ইতিহাস বর্ণনা করা আমার এই আলোচনার উদ্দেশ্য নয়।

“নিজের সিভি নিজেই লিখব- এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু কয়েক বছর আগে দেশে হঠাৎ করে সিভি রাইটিং নামে একটি নতুন পেশার(!) আবির্ভাব হলো। সিভি লেখকগণ দাবী করলেন যে নিজের সিভি নিজে না লিখে পেশাদার সিভি লেখক দিয়ে লেখালে অনেক বেশি ফায়দা হবে। মূলত সামাজিক মাধ্যমে তারা সিভি রাইটিং-এর পক্ষে জোর প্রচারণা চালালেন। সিভি লেখকদের এই প্রচারণার সাথে সাথেই সামাজিক মাধ্যমে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। অল্প সংখ্যক দেশি নেটিজেন এই সিভি রাইটিং-এর পক্ষে কথা বললেও অধিকাংশই এই পেশাদারী সিভি রাইটিং-এর তীব্র বিরোধিতা করেন এবং দুই পক্ষের এই বিপরীতমুখী অবস্থা এখনও চলমান । আজকের এই আলোচনার উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশে সিভি রাইটিং-এর প্রেক্ষাপট এবং এর বাস্তবতা নিয়ে কিছু কথা বলা।

প্রথমেই সিভি এবং রিজিউমি এই দু’টোর মধ্যে পার্থক্যটা একটু বুঝে নেই। সিভি এবং রিজিউমি এর মধ্যে পার্থক্য হলো মূলত ফরম্যাটে। রিজিউমি হলো সংক্ষিপ্ত সংস্করণ যা সাধারণত চাকরীর আবেদনের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। আর সিভি হলো দীর্ঘ সংস্করণ যা কিনা মূলত অ্যাকাডেমিক বা গবেষণা বা প্রকাশনার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। তাই আমাদের দেশে যাকে আমরা সাধারণত সিভি বলে থাকি, প্রকৃতপক্ষে তা হলো রিজিউমি। কিন্তু আজকের এই আলোচনার সুবিধার্থে আমরা রিজিউমিকে সিভি বলব। কেননা সিভি নামেই আমাদের দেশে এটা বেশি পরিচিত।

সিভি নিয়ে বিশদ আলোচনা করার আগে আমাদের জেনে নেওয়া উচিত এই ডকুমেন্টটির উদ্দেশ্য কী। আমার দৃষ্টিতে সিভি হলো একটি ‘পার্সোনাল মার্কেটিং টুল’ যা আপনার কর্মদক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং পেশাগত অর্জনের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরে। একটা সিভির মূল উদ্দেশ্য হল যাচাই পদ্ধতি ( Selection Process) এর প্রথম ধাপ অর্থাৎ স্ক্রিনিং (Screening) পর্যায়টি অতিক্রম করে আপনাকে প্রাথমিক লিখিত পরীক্ষা অথবা সাক্ষাৎকার পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া। তাই স্ক্রিনিং পর্যায়ের পর সিভির গুরুত্ব খুবই সামান্য। কারণ এই পর্যায়ের পর প্রতিটি ধাপই আপনাকে প্রত্যক্ষভাবে নিয়োগদাতার কাছে আপনার যোগ্যতা প্রমাণ করেই ডিঙ্গাতে হবে।

এখন দেখি সিভি লেখকগণ সিভি রাইটিং-এর পক্ষে কী কী যুক্তি দিয়ে থাকেন। নিচে তাদের বিভিন্ন প্রচারণার কয়েকটি তুলে ধরা হলো—

•আপনি যেখানে যেতে পারবেন না, আপনার সিভি ঠিকই সেখানে চলে যেতে পারবে। তাই ভাল সিভির গুরুত্ব অপরিসীম যা কিনা একমাত্র পেশাদার সিভি লেখকের পক্ষেই লেখা সম্ভব।

•ভিন্ন ভিন্ন জায়গা থেকে ভিন্ন ভিন্ন গাইডলাইন পেয়ে যারা দিশেহারা, তাদের জন্য সিভি রাইটিং একটি বড় সাহায্যের জায়গা। প্রত্যেকে তার নিজ নিজ জীবন দর্শন থেকে আপনাকে আইডিয়া দেবে, কিন্তু পেশাদার সিভি লেখক যেহেতু শত শত পেশার মানুষ নিয়ে কাজ করেন, তাই তিনি আপনাকে সঠিক একটা ধারনা দিবেন।

• সিভি লেখককে তার কাজের বিনিময়ে পারিশ্রমিক দেওয়া হবে আপনার ক্যারিয়ার এর জন্য একটা বিনিয়োগ, যা আপনাকে ক্যারিয়ার এর বিভিন্ন ধাপে নিজেকে উন্নততর পর্যায়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।

• আপনার সিভিটি যতোই ভালো হোক না কেন, একজন পেশাদার সিভি লেখক সেটিকে আরও ভালো এবং গ্রহণযোগ্য করে দিতে পারেন।

•“Resume writing is expensive if you think your career is cheap. Resume writing is cheap if you think your career is expensive.”

সিভি লেখকগণ তাদের এই প্রচারণা শুধু উপরে উল্লেখিত বাক্যগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। পেশাদার সিভি লেখক দিয়ে সিভি না লেখালে আপনার কী বিপদ হতে পারে তাও উল্লেখ করেছেন। যথা-

• ভাল করে শুনে রাখেন, এই যে সব টেম্পলেট (সামাজিক মাধ্যমে বিভিন্ন জন প্রদত্ত) নিচ্ছেন, এগুলোতে সিভি বানিয়ে চাকরির আবেদন করলে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে আপনার সিভি গ্রহণযোগ্য হবে না।

আর একজন বিজ্ঞ সিভি লেখক আরও এককাঠি উপরে যেয়ে রীতিমত পেশাদার সিভি লেখক ব্যবহার করা বা না করার উপর ভিত্তি করে জনগণের একটা গ্রেডিং স্ট্রাকচারও তৈরি করে ফেলেছেন—

• সেকেলে: যারা চাকরির আবেদনের জন্য কম্পিউটার কম্পোজের দোকান থেকে সিভি বানিয়ে নেয়।
• গড়পড়তা: যারা ইন্টারনেট থেকে বা অন্য কারও কাছ থেকে সিভি টেম্পলেট নিয়ে নিজেরাই সিভি লিখেন।
• স্মার্ট: যারা সিভির গুরুত্ব বুঝে শুধু তার কোম্পানির থেকে সিভি লিখিয়ে নেবে। এবং এর ফলে তিনি বিদ্যুৎ গতিতে ইন্টারভিউ কল পেয়ে যাবেন নির্ঘাত।

এতক্ষণ সিভি লেখকের কথা শুনলাম। এবার আসেন এ ধরনের প্রচার বা প্রচারণার পক্ষে বা বিপক্ষে সামাজিক মাধ্যমে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে বা এখনও হচ্ছে সে বিষয়টি একটু দেখে নেই-

সিভি রাইটিং এর পক্ষে:  সিভি রাইটিং এর সমর্থকের সংখ্যা খুবই কম। নিচে এমন একটি মন্তব্য দেয়া হল—

“Offering CV writing service, or any service you never heard of, does not make anyone “ধান্দাবাজ”. There are lots of business all around the world which are not known in Bangladesh. CV writing is one of them. If you think you do not need professional CV writer, nobody is forcing to take their service. But that does not give you right to humiliate the person who offers such service.”

সিভি রাইটিং এর বিপক্ষ: এই লাইন এতোই লম্বা যে, আমি যদি সব মন্তব্যগুলো এখানে তুলে দিতে চাই, তবে এইরকম ১৫ বা ২০ টা আর্টিকেলেও জায়গা হবে কিনা সন্দেহ। তাই নিচে কিছু (যেগুলোতে অন্তত প্রকাশ করার মত শালীন ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে) মন্তব্য তুলে ধরলাম—

• যে সকল ব্যক্তি গ্রাজুয়েশন শেষ করে নিজের একটি সিভি নিজে লিখতে পারে না, তাদের চাকরী পাওয়ার কোন যোগ্যতা নাই।

• সিভি লেখকদের দিয়ে সিভি লিখিয়ে নেওয়ার জন্য সিভি লেখকগন যেসকল যুক্তি দিচ্ছেন, তার প্রতিটাই একেবারে খোঁড়া যুক্তি। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে “শিক্ষিত” লোকজন এই ধরনের কাজকে প্রোমোট করছে।

• সিভি রাইটিং কিনা আবার একটা পেশা! অত্যন্ত হাস্যকর ব্যাপার।

• “LinkedIn এ না আসলে হয়ত জানতেও পারতাম না আমাদের দেশে যোগ্যতার মাপকাঠি হল কার সিভি কত সুন্দর, কার LinkedIn এর হেডশট/প্রোফাইল ছবি কত আকর্ষণীয়। এটাও হয়তো জানতে পারতাম না যে নিজের যোগ্যতা প্রকাশের জন্য “অন্যকে” টাকা দিয়ে সিভি বানাতে হয়। তাদেরকে নাকি আবার বলা হয় পেশাদার সিভি লেখক!

এখন আসুন এই বিতর্কের বিভিন্ন বিষয় গুলো একটু পর্যালোচনা করি—

সিভি রাইটিং একটি পেশা হতে পারে কিনা: পেশার সঠিক সংজ্ঞা আমার জানা নেই। ধরে নিই “যে কাজ করে সততার সঙ্গে কোনো ব্যক্তি জীবিকা নির্বাহ করতে পারে তাকেই পেশা বলে” । সিভি রাইটিং সেবা প্রদানের মাধ্যমে যদি কেউ জীবিকা নির্বাহ করতে পারে, তবে তাকে “পেশা” বলতে ব্যক্তিগতভাবে আমার কোন আপত্তি নেই। কারণ, আমি বা আপনি পৃথিবীর কয়টি পেশা সম্পর্কেই বা জানি? এই পৃথিবীতে আমাদের অজানা অনেক ধরনের পেশা আছে; সব পেশা সম্পর্কে যে আমাকে বা আপনাকে জানতে হবে এমন কোন কথা নেই। তাছাড়া এমন নয় যে, সিভি রাইটিং পেশা বাংলাদেশেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়েছে। সিভি রাইটিং-এর সবচেয়ে বেশি প্রচলন ওই সকল দেশে যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি। আপনি একটু গুগোলিং করলেই দেখতে পাবেন যে বিশ্বে অনেক প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি অর্থের বিনিময়ে সিভি রাইটিং সার্ভিস দিয়ে থাকে। সার্ভিস এর প্রকারভেদে এবং আপনার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে সিভি রাইটিং ফি ১০০- ৩ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে। সুতরাং সিভি রাইটিং পেশা কি বা না এই আলোচনার কোন প্রয়োজন আমি দেখি না।

অনেকেই হয়ত ভাববেন যেহেতু আমি নিজে এইচআর কনসালটিং পেশায় আছি, তাই সিভি রাইটিং-এর পক্ষে বলা তো আমার জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, আজ পর্যন্ত সিভি রাইটিং সার্ভিস দিয়ে আমি এক টাকাও উপার্জন করিনি। তবে হ্যাঁ, বন্ধুবান্ধব বা সাবেক সহকর্মীদের অনুরোধে অনেক সময় অনেকের সিভি লিখে দিয়েছি বা লিখতে সাহায্য করেছি এবং এখনও করে চলেছি। যদি কোনো ব্যক্তি নৈতিকভাবে সিভি রাইটিং সার্ভিস দিয়ে অর্থ উপার্জন করে তবে এতে তার লজ্জা পাবার বা অসম্মানিতবোধ করার কোনো কারণ আমি অন্তত দেখতে পাইনা।

যে নিজের সিভি বা রিজিউমি নিজে লিখতে পারে না, সে চাকরি করবে কিভাবে?

আমার প্রায় দেড় দশকের অধিক সময় এইচআর-এ কাজ করার সুবাদে কয়েক সহস্র সিভি দেখার সুযোগ হয়েছে। আমার সাম্প্রতিক কয়েকটি বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করছি:

• কিছুদিন আগের কথা, একটা এক্সিকিউটিভ সার্চ অ্যাসাইনমেন্ট (যাকে আমরা হেড হান্টিং বলে থাকি ) নিয়ে কাজ করতে যেয়ে বাংলাদেশের প্রথম সারির একটি এমএনসি কোম্পানির একজন ফাংশনাল হেড ( ২০ বছরের উপর পেশাগত অভিজ্ঞতা )-এর সিভি আমার হাতে পেলাম। তার সিভি খুলে দেখলাম যে, সিভিটি সর্বমোট ৯ পৃষ্ঠার। প্রথম পৃষ্ঠা জুড়ে তিনি শুধু তার প্রফেশনাল ফিলোসফির’র কথা উল্লেখ করেছেন। এছাড়াও পুরো সিভি জুড়ে অনেক বিস্তারিত এবং অতিরিক্ত তথ্য আছে যা সিভিতে উল্লেখ করার কোন প্রয়োজন নেই। এখন, আমার কিন্তু তার পেশাগত যোগ্যতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন করার সাহসই নেই। কারণ তার ক্যারিয়ার ট্র্যাক রেকর্ড একেবারে পাঁচ তারকা মানের। কিন্তু আমার এ কথা বলতেও দ্বিধা নেই যে, তিনি অনেক অসাধ্য সাধন করার যোগ্যতা রাখলেও অন্তত একটা সিভি’র কী উদ্দেশ্য এবং তা কিভাবে লিখতে হয় এই বিষয়টি ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় হউক, তিনি এখনও অবগত হননি।

দ্বিতীয় আর একজনের কথা বলতে চাই। তিনি বিভিন্ন দেশি বিদেশি প্রতিষ্ঠানে ২৫ বছরের বেশি কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন একজন পেশাজীবী। তার সিভি প্রায় ৮ পৃষ্ঠার। কিন্তু তার সাথে যোগাযোগ করতে যেয়ে তার সিভিতে কোথাও ফোন নম্বর খুঁজে পেলাম না। প্রথমে ভেবেছিলাম তিনি হয়তো বা ফোন নম্বর উল্লেখ করতে ভুলে গেছেন। কিন্তু হঠাৎ কী মনে করে যেন Ctrl F “Phone” চাপ দিতেই তার সিভির ৩য় পৃষ্ঠার এক কোনে তার ফোন নম্বরটি পেলাম। এখন আপনি বলুন, কয়জন রিক্রুটার Ctrl F দিয়ে আপনার সিভি থেকে ফোন নম্বর খুঁজে বের করবেন?

• আরেক ধরনের পেশাদারদের দেখা পেয়েছি যারা ফুটবল এর পরিভাষায় “ওয়ান ক্লাব প্লেয়ার” অর্থাৎ পাওলো মালদিনি, রায়ান গিগস, পল স্কোলস এর মতো এই ধরনের পেশাজীবীগণ ক্যারিয়ারের শুরুতে কোনো প্রতিষ্ঠানে যোগদান করে সেখানেই লম্বা সময় পার করেছেন। অনেক সময় পার করার পর বা ক্যারিয়ারের শেষ প্রান্তে এসে, যেকোনো কারণেই হোক, যখন চাকরি খুঁজতে শুরু করলেন, তখন ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না কিভাবে সিভি লিখবেন । তার কারণ, আজ পর্যন্ত তারা কখনোই চাকরি খোঁজার প্রয়োজন বোধ করেননি। তাই সিভি লেখারও প্রয়োজন হয়নি।

• মিড ক্যারিয়ার ট্র্যানজিশন আরও একটি অন্যতম কারণ। অনেক পেশাজীবী আছেন যারা ১০, ১৫ বা ২০ বছর একটি পেশায় যেমন সামরিক বাহিনী, সরকারি প্রতিষ্ঠান, মারচেন্ট মেরিন বা উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করে ক্যারিয়ারের এক পর্যায় কর্পোরেট বা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে যোগদানের মাধ্যমে তাদের পেশা পরিবর্তন করতে ইচ্ছুক হোন। এই রকম পরিস্থিতিতে তারাও ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না যে, তাদের পূর্বের পেশার অভিজ্ঞতা বা অর্জনগুলোকে কিভাবে সিভিতে তুলে ধরবেন যা কিনা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রাসঙ্গিক হবে।

• সর্বশেষ যে গ্রুপটি নিয়ে বলব, সংখ্যার বিচারে এদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এদের মূল সমস্যা হল- “ইংরেজি ভাষার উপর সার্বিক দুর্বলতা”। এদের মধ্যে যেমন অনেক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দক্ষ পেশাজীবী (চাকরিরত বা সাময়িকভাবে বেকার) আছেন তেমনি সদ্য কলেজ বা ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করা শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীও আছেন। একটা চাকরির জন্য হন্য হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক পর্যায়ে হয়তো মনে করেন, “একটা চাকরির জন্য সবই তো করলাম। এবার সিভি লেখক দিয়ে সিভিটা লিখিয়ে দেখি ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয় কী বা না। এখন আপনি আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, যদি ইংরেজি দুই পৃষ্ঠা লিখতে না পারে, তবে বিবিএ বা এমবিএ পাশ করল কিভাবে? অত্যন্ত যুক্তিসংগত প্রশ্ন। জবাবে আমি বলব, দুই পৃষ্ঠা বাদ দেন, ইংরেজিতে একটা বাক্য ঠিক মতো লিখতে পারে না এরকম হাজার নয়, লাখ লাখ ডিগ্রিধারী ব্যক্তি এই দেশে আছেন। আমার মনে হয়, এই বিষয়টি একটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, চলমান এবং জাতীয় পর্যায়ের আলোচনা। তাই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে আমি নিজেকে যোগ্য মনে করি না।

উপরের এই বিশদ আলোচনা করার মূল উদ্দেশ্য হলো যারা সিভি লিখতে অপারগতাকে পেশাগত যোগ্যতা না থাকার সঙ্গে সমার্থক মনে করেন তাদের বক্তব্যের বিপরীতে বাস্তব কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরা। মূল কথা হলো, বাংলাদেশে পেশাগত ক্ষেত্রে দক্ষ কিন্তু বিভিন্ন কারণে নিজের সিভি নিজে লিখতে পারেন না বা লিখেন না এই ধরেনের ব্যক্তির সংখ্যা অনেক কম তা বলা যাবে না। অর্থাৎ, আপনার পছন্দ হোক বা না হোক, এ দেশে সিভি রাইটিং সার্ভিস নিয়ে ব্যবসা করার জন্য একটা মার্কেট বর্তমানে আছে এবং এটাই বাস্তবতা। তবে এই মার্কেট এর সাইজ বা পটেনশিয়াল কি তা আমার জানা নেই। দেশে বেকারত্বের হারের সাথে এই মার্কেট এর সাইজ এর একটা পজিটিভ কোরিলেশন থাকলেও থাকতে পারে বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশের এই নব্য সিভি লেখকদের মার্কেটিং ট্যাকটিকস নিয়ে কিছু বলতে চাই- 

আমি আগেই বলেছি যে সিভি রাইটিংকে পেশা হিসেবে দেখতে আমার কোনো আপত্তি নেই। বিভিন্ন কারণে এই সার্ভিসটি একটা চাহিদা যে বাংলাদেশে আছে তাও দৃশ্যমান। তবে এই চাহিদা তৈরি (Demand Creation) করতে যেয়ে এসকল সিভি লেখকগণ যে প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন তা নিয়ে আমি একটু আলোকপাত করতে চাই-

• এই সিভি লেখকগণ সবচেয়ে বেশি যে পদ্ধতি অনুসরণ করছেন তা হলো “ভীতি প্রদর্শন” বা Fear Mongering। ধরুন কোনো তথ্য-উপাত্তের উপর ভিত্তি করে তিনি বলেন যে, সামাজিক মাধ্যম থেকে প্রাপ্ত টেম্পলেট দিয়ে সিভি বানালে ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে সেই সিভি রিজেক্ট হবে ? তার এই দাবীর পিছনে কোন প্রমাণ আছে কি ? আমি আমার ১৫ বছরের এর অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি যে, তার এই দাবীর কোনোই বাস্তব ভিত্তি নেই।

• তিনি কিসের উপর ভিত্তি করে এই বানী চিরন্তনী তৈরি করলেন যে, “Resume Writing is expensive if you think your career is cheap. Resume Writing is cheap if you think your career is expensive!” তার মানে তিনি কি বলতে চাচ্ছেন যে তাকে টাকা দিয়ে সিভি লেখালেই আমার ক্যারিয়ার একেবারে উড়তে থাকবে ? এই কথার মধ্যে আমি কোনো সত্যতা দেখিনা, বরং এর মাঝে আছে এক ধরনের কাল্পনিক আশ্বাস।

• এবার আসুন “Categorization of Target Consumers”. মনগড়া একটি পদ্ধতি বানিয়ে কনজ্যুমারদের তিনি তিনটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ফেললেন। এই তিন ক্যাটাগরির মধ্যে সবচেয়ে ভালো ও যোগ্য কারা? সেই সকল ব্যক্তিগণ যারা নিজের মেধা ও শ্রম ব্যবহার করে নিজের সিভি নিজে না লিখে তার কাছে যেয়ে অর্থের বিনিময়ে সিভি লিখিয়ে নিবেন। এর থেকে খোঁড়া বা হাস্যকর কোনো যুক্তি কি আর হতে পারে? আমি তা পাঠকদের বিচারের উপর ছেড়ে দিলাম।

আপনার কি সিভি লেখকদের কাছে যাওয়া উচিত হবে কি না?

প্রথমত: আমার দৃষ্টিতে ২-৩ পৃষ্ঠার একটি সিভি লেখা জানা একটি বেসিক স্কিল। আপনার ইংরেজিতে দক্ষতা যদি মাঝারি মানেরও হয়, গুগোলে সার্চ করে কয়েকটি স্যাম্পল দেখে কিংবা ইউটিউবে কয়েকটা ভিডিও টিউটরিয়াল দেখে আপনি খুব সহজেই নিজের সিভি নিজে লিখে ফেলতে পারবেন। বিশেষত, আপনি যদি একজন ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট হয়ে থাকেন, আপনার জন্য ১-২ পৃষ্ঠার একটি সিভি লেখা খুবই সহজ কাজ হওয়া উচিত। ক্যারিয়ারের এই পর্যায়ে নিজের সিভি নিজে না লিখতে পারা সত্যিই দুঃখজনক এবং মনে রাখবেন, প্রায় সব ধরনের রিক্রুটারই একে একটা “অযোগ্যতা” হিসেবেই দেখবেন। তবে, যাদের অনেক বছরের ডাইভার্স কাজের অভিজ্ঞতা আছে এবং ঠিক বুঝতে পারছেন না যে, চাকরির ধরনের সাথে মিল রেখে কাস্টমাইজ করে কিভাবে সিভি লিখতে হবে, কিংবা মিড ক্যারিয়ার ট্রানজিশন এর চেষ্টা করছেন অথবা অনেক অভিজ্ঞতা ও কর্মদক্ষতা থাকা সত্ত্বেও ইংরেজি ভাষায় দুর্বলতাটা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেননি, এবং সিভি লিখতে যেয়ে আপনি কোনো পরিচিত বা বন্ধুবান্ধবদের সাহায্য ও পাচ্ছেন না, তবে আপনি হয়তোবা সিভি লেখকদের কাছে যাওয়ার কথা বিবেচনা করতে পারেন।

তবে এক্ষেত্রে আপনাকে নিম্নোক্ত বিষয়ে সাবধান করে দিতে চাই—

• যদিও সিভি লেখকরা বলবেন যে সিভি লিখতে যেয়ে তারা কোন নির্দিষ্ট টেম্পলেট ব্যবহার করেন না এবং প্রত্যেকটা সিভিই ইউনিক, বস্তুতপক্ষে তাদের এই দাবী সঠিক নয়। যত ভালো সিভি লেখকই হোক, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখবেন যে তারা ঘুরেফিরে ৪/৫টি টেম্পলেট বা স্টাইল‘ই ব্যবহার করেন। আপনি যদি হুমায়ুন আহমেদ বা জন গ্রিশামের দুইটি বই পড়ে থাকেন, তবে তৃতীয় বইটি পড়তে গেলে লেখকের নাম জানা না থাকলেও তার লেখার ধরন দেখে সহজেই আপনি লেখকের পরিচয় পেয়ে যাবেন। এখন ধরুন, আপনি সিভি লেখক দিয়ে তৈরি আপনার সিভি দিয়ে একটি চাকরির জন্য আবেদন করলেন। এখন, সিভিটা হাতে পেয়ে রুক্রুটার বা মানবসম্পদ ব্যবস্থাপক যদি বুঝে ফেলেন “আরে, এটা তো অমুকের লেখা সিভি” এবং সে যদি দুর্ভাগ্যক্রমে “যার সিভি লেখার যোগ্যতা নেই, তার কোনো চাকরি করারই যোগ্যতা নেই” এই মতবাদের অনুসারী হয়, তবে আপনার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র সিভি লেখক দিয়ে সিভি তৈরির কারণে রিজেক্ট হয়ে যেতে পারেন।

• আমি আগেই বলেছি, সিভির মুখ্য উদ্দেশ্য হলো আপনাকে প্রাথমিক যাচাই ধাপটি অতিক্রম করতে সাহায্য করা। তবে সিভির আরও একটি সেকেন্ডারি ব্যবহার হলো সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে সাক্ষাৎকার গ্রহণে সাহায্য করা। অর্থাৎ, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী আপনার সিভিটি সামনে রেখে সেখানে প্রদত্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে আপনাকে প্রশ্ন করতে পারেন; এটা একটি খুবই সাধারণ ঘটনা। এখন সিভি লেখক আপনার সিভিতে যে সকল তথ্য দিয়েছেন তার উপর যদি আপনার পরিপূর্ণ দখল না থাকে, তবে কিন্তু আপনি এই সব প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না। সেক্ষেত্রে চমৎকার সিভি থাকা সত্ত্বেও আপনার কোনো ফায়দা হবে না, বরং আপনি ধরা পড়ে যেতে পারেন যে আপনি সিভি লেখক দিয়ে সিভি তৈরি করিয়েছেন এবং সাথে সাথেই আপনার চাকরিপ্রাপ্তীর সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায় নেমে আসতে পারে।

পরিশেষে বলতে চাই, একজন বিবেকবান ব্যক্তি হিসাবে আমাদের সকল ধরনের নৈতিক পেশা বা কাজকেই সম্মান করা উচিত। তাই সিভি লেখকদের সাহায্য নিয়ে কেউ যদি তার ক্যারিয়ার-এ সামান্যতম উপকারও পায়, আমি সেই প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানাই। আমার দৃষ্টিতে এই পেশা “খারাপ” কিংবা “এটা কোনো পেশা হলো” এই ধরনের যুক্তির উপর ভিত্তি করে সামাজিক মাধ্যমে কাউকে অপমানজনকভাবে আক্রমণ করা বা অশালীন ভাষায় গালাগালি করা মোটেও উচিত নয় এবং এই ধরনের কাজকে আমি একেবারেই সমর্থন করি না। তবে সিভি লেখকদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই, যদিও আপনারা অনেক সময়ই বলেন “আমি নতুনদের সিভি লিখি না”, কিন্তু আমার বিবেচনায় আপনারা অহেতুক ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং মিথ্যা আশ্বাসমূ্লক যে সকল প্রচারণা করেন তার মূল লক্ষ্য কিন্তু সেই সকল সদ্য পাশকৃত শিক্ষিত বেকারগণই। মনে রাখবেন, মানুষের বেকারত্বের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে অনৈতিকভাবে প্রচার প্রচারণার মাধ্যমে যদি ব্যবসা করতে চান, তাকে আমি বা সমাজের কোনো বিবেকবান মানুষ কখনোই সমর্থন জানাবে না। আশা করি, আপনারা সৎ উদ্দেশ্যে এবং পেশাজীবীদের সাহায্যের মানসিকতা নিয়ে কাজ করে নিজেদের এবং সমাজের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।

সিভি রাইটিং


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর