Sunday 08 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শূন্য থেকে শুরু…

জোহরা শিউলী
২৩ এপ্রিল ২০২১ ১৩:৪৭

বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা বদলে যাওয়ার অন্যতম অংশীদার আমাদের প্রান্তিক আর খেটে খাওয়া নারীরা। জীবন ও জীবিকায় তাদের ব্যাপক অংশগ্রহণেই বদলে গেছে দেশের অর্থনীতির চিত্র। সে গার্মেন্টসে কাজ করা হাজার হাজার বালিকা বা তরুণী হোক কি দুর্গম গ্রামের খেটে খাওয়া কোন নারী। তাই বলা যায় এরাই বাংলাদেশ, এরাই বাংলাদেশের এগিয়ে চলার প্রতীক। এমনই কিছু সংগ্রামী নারী যারা একদম শূন্য থেকে শুরু করে নিজেদের অবস্থান বদলেছেন, তাদের গল্পই নিয়মিতভাবে উঠে আসবে সারাবাংলা ডট নেটের ‘এরাই বাংলাদেশ’ শিরোনামের  ধারাবাহিকে। লিখবেন, লেখক, সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী জোহরা শিউলী

‘স্বামী মারা যাবার পর নিঃস্ব হয়ে যাই আমি। কোলে তখন দেড় বছরের ছেলেসন্তান। শ্বশুরবাড়িতে ঘরে জায়গা হয়না, তাদের বারান্দায় ছোট্ট ছেলেটাকে নিয়ে থাকতাম। শীত-ঝড়-বৃষ্টিতে এই খোলা বারান্দায় ছেলেটাকে বুকে চেপে বসে থাকতাম। মানুষের বাড়িতে কাজ করে দুজনের অন্ন জোগাড় করতাম। সেই কষ্টের দিন পার করে আজ আমি স্বাবলম্বী। আমি ও আমার ছেলে পড়াশোনা করে হয়েছি শিক্ষিত।’- আত্মশক্তিতে বলীয়ান তৃপ্তি মন্ডল নিজের কথা এভাবেই বললেন।

তৃপ্তি মন্ডল। খুলনা জেলার খলিসীবুনিয়ার স্বাবলম্বী নারী। জীবন হেরে যাবার নয়। ঘুরে দাঁড়ানোর। পরাজয়কে হেটিয়ে বিদায় করার। নিজ জীবন দিয়ে তাই তিনি দেখিয়েছেন। শূন্য থেকে শুরু করে কীভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়, গ্রামের মানুষের কাছে তার-ই প্রতীক এখন তিনি। ১৯৭৭ সালে নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া এই নারীর বিয়ে হয় ১৯৯২ সালে। তখন তিনি দশম শ্রেনীর ছাত্রী। স্বামীর ছিল অনির্ধারিত স্বল্প আয়। তারপরও কেটে যেত দিন। ১৯৯৬ সালে স্বামী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৯ বছরে বিধবা হন তিনি। কোলে তখন দেড় বছরের শিশুসন্তান। স্বামী মারা যাবার পর শ্বশুরবাড়িতে অনাদর-অবহেলা। আশ্রয় খোঁজেন বাবার বাড়ি। সেখানেও ভাইদের সংসারে অপাঙতেয়। আবার ফিরে আসেন শ্বশুরবাড়ি। কিন্তু থাকার জায়গা নেই। ততদিনে তার ঘর শ্বশুর নিজের করে নিয়েছেন, সাফ জানিয়ে দেন তার থাকার জন্য কোনো ঘর বরাদ্দ নেই। দিশেহারা তৃপ্তি মন্ডল কোথায় আশ্রয় নেবেন বুঝতে পারেন না। নিরুপায় হয়ে ছেলেকে নিয়ে শ্বশুরের ঘরের বারান্দায় থাকা শুরু করেন। কোনোরকম আবাস তো না হয় জুটল, এবার তো নামতে হবে অন্নের সন্ধানে। তাই তিনি আশে-পাশের বাড়িতে ঝি গিরির কাজ শুরু করলেন। ছেলেকে নিয়ে কাজ করতেন, দুজনের তিনবেলা খাবারের সমস্যার সমাধান হলো।

-মানুষের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করতেন। সেখান থেকে আপনি এবং আপনার ছেলে একসঙ্গে এসএসসি, এইচএসসি পাশ করেন। ছেলে এমবিএ পাশ করেছে। এটা কীভাবে সম্ভব?

চোখে-মুখে আত্মতৃপ্তি ফুটে উঠা মুচকি হাসি দিয়ে তৃপ্তি মন্ডল জানালেন- ‘আমি তো দশম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছিলাম। মানুষের বাড়ির ঝি-গিরির কাজ তো আমার বেশিদিন ভালো লাগে নাই। চিন্তা করছিলাম কীভাবে এই অবস্থা থেকে বের হওয়া যায়। শ্বশুরবাড়ির দুই প্রতিবেশি সুব্রত ও বিশ্বজিৎকে দেখতাম বিভিন্ন সামাজিক উন্নয়নের কাজ করতো। তাদেরকে বলার পর তারা আমাকে হাঙ্গার প্রোজেক্টের স্বেচ্ছাসেবকদের এক কর্মশালায় নিয়ে যায়। সেই কর্মশালায় আত্মশক্তি, ভবিষ্যত প্রত্যাশা, সবাই মিলে কাজ করা, সমিতি গড়ে পুজিঁ গড়ে তোলা বিষয়গুলোতে আমার ভাবনার মোড় খুলে যায়। আমি মানুষের বাড়িতে পেটে-ভাতে কাজ বাদ দিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের আরএমপি কার্যক্রমে রাস্তার কাজে যোগ দেই। এই কাজের ফলে খাওয়া-পরার চিন্তা কমে যায়। এরপর সিদ্ধান্ত নেই, আমার ছেলের জীবন যেন এমন কষ্টের না হয়। তাই ওকে নিয়মিত পড়াশোনা করানো শুরু করি। সেইসঙ্গে আমিও শুরু করি বয়সোপযোগি পড়াশোনা। ২০০০ সালে আমি ও আমার ছেলে একসঙ্গে এসএসসি পাশ করি। ২০০২ সালে এইচএসসি। নিজে আর না পড়লেও ছেলেটাকে এমবিএ করিয়েছি।’

উচ্চশিক্ষার স্বপ্নের পথে হাঁটতে দরকার হয়েছে অর্থের। রাস্তার কাজে কিছু টাকা সঞ্চয় করেছিলেন তিনি। ২০০৩ সালে নারী নেতৃত্ব বিকাশের ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে বুঝতে পারেন আত্মশক্তির বিষয়টি। সঞ্চিত টাকা দিয়ে দুটি সেলাই মেশিন কেনেন। পার্শ্ববর্তী বান্ধা গ্রামে একটি দোকান নিয়ে দুজন নারীশ্রমিক রেখে তিনি তার সেলাইয়ের দোকান চালু করেন। দোকানভাড়া-শ্রমিকদের বেতন দিয়ে মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হতো। ছেলের পড়াশোনার খরচের পর কিছু টাকা হাতে থাকত। তা নিয়ে তিনি বসে থাকেননি। নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেকে প্রতিনিয়ত দক্ষ করে তুলেছেন। পুষ্টি, কৃষি, মৎস্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে বাড়ির চারপাশে সবজির বাগান, মাছ চাষ করেছেন। আর্থিক স্বচ্ছলতায় নিজের জমিতে ঘর তুলেছেন। সেলাইয়ের দোকান প্রতিষ্ঠা করেছেন। শুধু নিজে স্বাবলম্বী হয়ে থেমে থাকেননি, গ্রামের অনেক অসহায় নারীদের সেলাই প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করে তুলছেন। তাদের ঘুরে দাঁড়াতে মানসিক শক্তি দিচ্ছেন।

যে তৃপ্তি মন্ডলের ঘর ছিল না। বারান্দায় চটের বস্তায় যাপন করেছেন জীবন, সেই তৃপ্তি মন্ডলের নিজস্ব টাকায় হওয়া ঘরে এখন তিনি বাস করছেন উচ্চশিক্ষিত-কর্মজীবী পুত্র আর পুত্রবধু নিয়ে। অভাব-অনটন নয়, প্রকৃতির বৈরি আবহাওয়ার আতংক নয়, এখন তার ঘরে খেলা করে প্রশান্তির ঝিরিঝিরি বাতাস।

লেখক- সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার (পাবলিকেশন ও ডকুমেন্টেশন), দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ

সারাবাংলা/আরএফ

খেটে খাওয়া নারী জোহরা শিউলী টপ নিউজ দি হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ প্রান্তিক নারী বদলে যাওয়া বাংলাদেশ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ভূতের গলির বাসায় মিলল বৃদ্ধের মরদেহ
৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ১১:০০

সম্পর্কিত খবর