Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

বর্ণবাদের বেড়াজালে বন্দি জীবন

রুবা তালুকদার
২৬ আগস্ট ২০২১ ১১:৩৩

“মেয়েটি দেখতে ভালো, কিন্তু গায়ের রঙটা একটু চাপা” কথাটির মাধ্যমেই বুঝতে পারি সাদা আর কালো রঙের মধ্যে আকাশ সমান পার্থক্য। সাদা আর কালো রঙ দিয়ে মেয়েদের সৌন্দর্য, গুণ বিচার করা হয়। কথায় আছে “আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারি।” কথাটি দ্বারা বুঝতে পারি আমাদের সমাজের অস্থিমজ্জাজুড়ে বর্ণবাদের অস্তিত্ব ঠিক কতটা গভীর।

মূলত, বর্ণবাদের চর্চা সভ্যতার শুরু থেকেই। ষোড়শ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বর্ণবাদের শুরু হয়। সেই সময়ে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকানদের দাস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রে নেওয়া হত। সময় পরিক্রমায় বর্ণবাদ ভিন্নমাত্রা যোগ করে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। বাংলাদেশ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। এখানে বর্ণবাদের প্রধান শিকার হয়ে থাকে মেয়েরা। জীবনের প্রতিটি ধাপে কালো মেয়েরা অবহেলিত। কালো মেয়েদের অকল্যাণের প্রতীক হিসেবে ধরা হয়। কোন পরিবারে কালো মেয়ে জন্ম নেয়া মানে মা-বাবার মাথায় আকাশ সমান বোঝা। শুধু তাই নয় কালো মেয়ের জন্ম থেকে শুরু করে তাদের মা-বাবা দুশ্চিন্তায় দিন পার করেন। পাত্রস্থ করতে পারলেই যেন তাদের দায়মুক্তি।

অবাক করার মতো হলেও সত্য যে, খবরের কাগজে ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন দেখলে বুঝতে পারি সমাজে মেয়েরা কতটা নিষ্পেষিত। এখানে ফলাও করে লেখাই থাকে মেয়ের গায়ের রঙ ফরসা হতে হবে। কালো মেয়েরা যেন পাতে তোলার অযোগ্য। পাত্রপক্ষরা মনে করে কালো মেয়ে নিয়ে আসা মানে তাদের বংশধররা কালো হবে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে অনেক সময় তাদের বিয়ে হলেও শ্বশুরবাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্নহত্যার পথ বেছে নেয়।

কালো মেয়েদের কদর কেবল কবিদের কবিতায় শোভা পায় বাস্তবে যা ধোঁয়াশা। বিজ্ঞাপন, চলচ্চিত্র কিংবা মডেলিংয়ের মতো আলো ঝলকানো প্লাটফর্মে কালো মেয়েরা যেন বড্ড বেমানান। এই বর্ণিল জগতে নিজেদের মেকআপের আদলে সাজিয়ে তোলেন। আবার টেলিভিশনে গায়ের রঙ ফরসাকারি ক্রিমের বিজ্ঞাপন প্রচার করে। যেখানে রোল মডেল হিসেবে নেওয়া হয় সাদা চামড়ার কাউকে। বিজ্ঞাপনগুলো এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যেন কালো হওয়াটা একটা অন্যায় আর সাদা হওয়া মানে নিজেকে আত্নবিশ্বাসী আর আকর্ষণীয় করা । যা বর্ণবাদকে উসকানি দিচ্ছে। তাইতো কালো মেয়েরা তাদের প্রকৃত রঙ আড়াল করতে ঝুঁকে পড়ছে ত্বকফরসাকারী ক্রিমের দিকে। আর এসব ক্রিমে রয়েছে উচ্চমাত্রায় মার্কারি, লেডের মতো বিষাক্ত পদার্থ যা ত্বকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং এতে ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কিন্তু দিনে দিনে এসব ক্রিমের চাহিদা বেড়েই চলেছে এবং তার সাথে যুক্ত হচ্ছে বিউটি পার্লারগুলো। কালো মেয়েরা একটু ফরসা হওয়ার আশায় এসব জায়গায় ছুটে যাচ্ছে।

কালো মেয়েরা পোশাক পরিচ্ছদ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভোগে, কারণ ছোটবেলা থেকেই তাদের বুঝিয়ে দেয় সব রঙে তাদের মানায় না। কোন পোশাক কালো রঙকে একটু আড়াল করবে এই নিয়ে তাদের ভাবতে হয়। তারা বন্ধু, প্রতিবেশী, সমাজের মানুষ দ্বারা হেনস্তার শিকার হন। যা তাদের মানসিকভাবে দুর্বল করে তোলে।

১৯৬০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিলে জাতিগত বৈষম্যের প্রতিবাদে শান্তিপূর্ণ মিছিলে পুলিশ গুলি করে ৬৯ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। অনেকে আহত হন। যুগে যুগে মানুষ এভাবে বর্ণবাদের শিকার হচ্ছে। আমরা জাতি হিসেবে নিজেদের সভ্য হিসেবে দাবি করি। সত্যিই কি আমরা সভ্য হতে পেরেছি? নাকি সভ্য হওয়ার মুখোশ পরে অন্তরে অসভ্যতাকে লালন করছি? সত্যি বলতে আমরা আধুনিক যুগে বাস করলেও প্রাচীনকালের কুসংস্কার, ধ্যানধারণা থেকে বের হতে পারি নি। আর এই দায়ভার রাষ্ট্র ও সমাজব্যবস্থার। আমাদের সমাজব্যবস্থাই এমন যেখানে কালো মেয়েরা পদে পদে লাঞ্চনা-গঞ্জনার শিকার হতে হয়। তারা কর্মজীবনে নানা প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হয়ে থাকে ।

১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২১ মার্চকে বিশ্ব বর্ণবৈষম্য নির্মূল দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। তবে সত্যিই কি সমাজ থেকে বর্ণবাদ নির্মূল হয়েছে? নাকি সমাজের অবকাঠামোতে জেঁকে বসে রাজত্ব করছে। বাস্তব চিত্র তো এটাই যারা বর্ণবাদ নিয়ে কথা বলছেন দিন শেষে তারাই তাদের ছেলে বা আত্নীয়ের জন্য ফরসা বউ খুঁজেন। আসলে বর্ণবাদ একটি ক্ষত যা ছড়িয়ে পড়েছে ক্যান্সারের মতো। ছোটবেলা থেকেই সাদা আর কালো রঙের পার্থক্য শেখানোর মধ্য দিয়ে তাদের মনে ক্ষতটা ঢুকিয়ে দেই। আমরা তখনই বর্ণবৈষম্য এড়াতে পারি যখন সমাজের কিছু ভ্রান্ত ধারণা সমাজ থেকে নির্মূল করবো। ব্যক্তিমূল্যবোধ আর সচেতনতাকে কাজে লাগিয়ে বর্ণবৈষম্যকে পেছনে ফেলে মেধা, বুদ্ধি, যোগ্যতা, সাহসকে সাফল্যের মাপকাঠি হিসেবে ধরতে হবে।

কালো আর ধলো বাহিরে কেবল, ভিতরে সবাই সমান রাঙা। এই মর্মে নিজেদের পরিস্ফুটিত করার মধ্য দিয়েই আমরা বর্ণবাদের কলুষতা থেকে আলোর পথে উন্মোচিত করবো। নারীরা যেন সৌন্দর্যকে পুঁজি না করে বরং তার কর্মদক্ষতা, সাহসিকতা, বুদ্ধি দ্বারা এগিয়ে যেতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। তরুণ সমাজকে প্রাচীন ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে আধুনিক বর্ণবাদহীন সমাজ গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পাশাপাশি নারীদের অধিকারগুলো বাস্তবায়নের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী

সারাবাংলা/এসবিডিই

নারী বর্ণবাদ রোকেয়া সরণি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর