Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

নারীর মানসিকতা আজও বদলায়নি

আঞ্জুমান রোজী
১৭ মে ২০২২ ২১:৩৩

নারীবাদের চর্চা বাংলাদেশে নতুন নয়। বলতে গেলে একশো বছর আগে থেকেই নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়ার হাত ধরে এই উপমহাদেশে নারীবাদের চর্চা শুরু। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের বাংলাদেশে নারীবাদ চর্চার ক্ষেত্র তৈরি হয়। এই একশো বছরের মধ্যে অনেক মহীয়সী নারী এসেছেন। তারাও নারী জাগরণে, নারীর সচেতনতা বৃদ্ধিতে অনেক অবদান রেখে গেছেন। আপাতদৃষ্টিতে এসব কর্মকাণ্ডের প্রক্রিয়ায় নারীর জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছে। নারী শিক্ষিত হচ্ছে, বড় বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বড় বড় ডিগ্রি নিচ্ছে; সামাজিকভাবে অনেকাংশে নারী তার স্বীকৃতি আদায়ে সোচ্চার হচ্ছে। আসলে আমরা সকলে বেগম রোকেয়ার তৈরি করা পথ ধরেই হেঁটে যাচ্ছি। কিন্তু সেই তৈরি করা পথ কি খুব একটা প্রশস্ত হয়েছে! অর্থাৎ নারীর মানসিকতা কি বদলেছে! হয়েছে কি আধুনিকমনস্ক যাতে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পারে! না-কি যেটুকু তৈরি হয়েছিল, সেটুকুর মধ্যেই আমরা আছি! যদিও বাস্তবতা বলে, বাংলাদেশে সেই পথ এখন কণ্টকাকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

এখন কথা হচ্ছে, এতো এতো বছর ধরে নারীবাদের চর্চা অব্যাহত থাকলেও নারীরা সেই অর্থে সচেতন হয়নি। নারীর মানসিক অবস্থাও খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। যে কাজটা বেগম রোকেয়া স্বয়ং করার চেষ্টা করে গেছেন। যেমন, কিভাবে নারীকে জাগানো যায়, কিভাবে নারীর মগজে আঘাত করে বুঝিয়ে দেয়া যায় যে সেও মানুষ এবং এই পৃথিবীতে মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার সবরকম অধিকার তার আছে। নারী কারোর অধীন নয়। নারী নিজেই একক সত্তা। তাকে বুঝতে হবে, সেও পারে মাথা উঁচু করে এই পৃথিবীর বুকে সদর্পে বাঁচতে। এই মানসিকতার বীজ কি সব নারীর মধ্যে বপন করা সম্ভব হয়েছে! স্বল্পায়ু বেগম রোকেয়ার প্রতিটি দিন এই কাজে ব্যপ্ত ছিল। ঘরে ঘরে, দ্বারে দ্বারে গিয়ে, এমনকি প্রচুর চিঠি আদান-প্রদান করে নারীদের সঙ্গে কিংবা নারীর অভিভাবক পুরুষের সঙ্গে নারীদের বিষয়ে কথা বলেছেন এবং লিখে গেছেন নারীর সচেতনতামূলক অনেক লেখা। তিনি প্রতিদিন অনেকটাই নির্ঘুম কর্মযজ্ঞ চালিয়েছেন নারীকে শিক্ষিত সচেতন করে তুলতে। বিশ্রামহীন অনবরত এই কাজ করতে গিয়ে বেগম রোকেয়া মাত্র বায়ান্ন বৎসর বয়সে চিরবিদায় নেন। রেখে গেছেন অসম্পূর্ণ অনেক কাজ। সেই অর্থে আমরা যারা নিজেদের নারীবাদী বলি কিংবা বিগত কয়েক দশকের নারীবাদী যারা ছিলেন, তারা কতটুকু কাজ করে গেছেন বা আমরা করে যাচ্ছি! অর্থাৎ বেগম রোকেয়ার অসম্পূর্ণ কাজগুলি কি করতে পারছি। নাকি আমাদের কাজের ধারাবাহিকতায় কোনো ঘাটতি আছে! নাকি কোনো অবহেলা। নাকি শুধু নারীবাদী বলে নিজেকে প্রদর্শন করা হচ্ছে!

এই বিষয়ে অনেক বড় প্রশ্ন করা যায়, কিন্তু উত্তর। সেটা চিরকালের মতো অধরাই থেকে যাচ্ছে। যদিও আমরা জানি, পুরুষতান্ত্রিকতার কারণে নারী মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছে না। তারপরও কি নির্দিষ্ট করে কোনো উত্তর দিতে পারি! পারি না, কারণ নারী নিজেই সচেতন নয়। অধিকাংশ নারীর মানসিকতা এখনো অন্ধকার যুগেই আছে। আজও নারীকে অবলা বলা হয়। ভাবা হয় দুর্বল মনে করে। এই মানসিকতার জন্য আমরা সবসময় পুরুষতান্ত্রিক সামাজিক এবং পারিবারিক বিধিব্যবস্থাকে দায়ী করে আসছি। কিন্তু নারী কি ইচ্ছে করলে পারে না এই বিধিব্যবস্থা ভেঙে বের হয়ে আসতে! এখনকার সময়ে অবশ্যই পারে। যেসমস্ত নারী আজ প্রতিষ্ঠিত তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জন করে এগিয়ে যাচ্ছেন, সেসমস্ত নারী একাই এই পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তবে এর সংখ্যা আশানুরূপ নয়। অধিকাংশ নারী এখনো জানে না যুদ্ধটা কিভাবে করতে হয়। আবার কেউ জানলেও সেই নারী ভীতসন্ত্রস্ত থাকে। এখানে নারীর উপর শারিরীক, মানসিক নির্যাতনটাই মুখ্য। এসব উৎরিয়ে খুব কম নারীই পেরেছে নিজের মুক্তি খুঁজে নিতে।

আবার আরেকটা বিষয়ও লক্ষণীয় যেসমস্ত নারী জীবনে চড়াই-উৎরাই পার করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন, তারা অনেকেই পেছন ফিরে তাকান না। তাকান না তার আশেপাশের নারীদের প্রতি। সবার সবরকম ক্ষমতা থাকে না। কারোর বোঝার ক্ষমতা অনেক কম কিংবা না-ই, তাদের পাশেও সচেতন নারীদের থাকা উচিৎ। আর কিছু না করলেও এই দুর্বল চিত্তের নারীদের সাথে কথা বলে বলে ওদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করা যায়। কাজ অনেকভাবেই করা যায়। কেউ লিখে লিখে সচেতনতা বাড়ানোর চেষ্টা করছে, কেউ কেউ সভা-সমিতি করে করছে, কেউ মাঠপর্যায়ে কাজ করে যাছে। তবে এসমস্ত কাজ খুবই অপ্রতুল। বেগম রোকেয়া যে মোটিভেশনাল পদ্ধতিতে নিবেদিত প্রাণে কাজ করে গেছেন, আমরা কি সেই অর্থে খুব ডেডিকেটেড হতে পেরেছি! বাস্তবতা হলো আমরা পারিনি। তাই তো নারীর মধ্যে আধুনিকায়নের মানসিকতাও লক্ষ্য করা যায় না। কারণ, আমাদের পুরুষের মন রক্ষা করে সমাজ সংসারে নারী হিসেবে সম্মানটা ঠিক রেখে কাজ করতে হচ্ছে। এই বলয়বৃত্ত ভাংতে না পারলে নারীর মানসিকতাও বদলাবে না।

সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সব নারীর পাশে সচেতন নারীদের থাকা, একতাবদ্ধ হওয়া; কিন্তু বাস্তবে আমরা এমন দৃশ্য খুব একটা দেখতে পাই না। যার কারণে নারীবাদ চর্চায় একশত বছরেও নারীর তেমন অগ্রগতি হয়নি। হয়নি বলতে নারী এখনো মানুষ হিসেবে নিজেকে চিনতেই পারল না। কারণ সক্রিয় নারীবাদীরা সেই বীজ সব নারীদের মনে বপন করতে পারেননি। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিষয়টা অর্থাৎ নারীমুক্তির বিষয় আরো দুরুহ হয়ে যাচ্ছে। হাজার বছরের ধর্মীয় গোঁড়ামিতে নারীকুল অন্ধকার যুগে তলিয়ে যাচ্ছে। নারীর মানসিকতাই পরিবর্তন করতে পারলো না যে সমাজ, সেই সমাজ উন্নতির কথা বলে কিভাবে?

আরো আরেকটা বিষয় না উল্লেখ করলেই নয়। প্রায় দশ বছর ধরে নারীবাদ বিষয় নিয়ে পড়ছি এবং লিখে যাচ্ছি। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলি, নারী সংক্রান্ত অধিকাংশ লেখাগুলো হয় তাত্ত্বিক ধরণের। অবশ্যই নারীবাদ একটি দর্শন। এই বিষয়ের উপর অনেক তত্ত্ব, উপাত্ত এবং তথ্য রয়েছে। তার উপরে রয়েছে একটি ইতিহাস। নারীবাদের ইতিহাস অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় বিশ্বে আজ নারীরা অধিকার আদায়ে এতো সচেতন। এর সমস্তটুকুই পশ্চিমা ধাঁচে নারীবাদের চর্চা। যেই চর্চাটা ছিল বেগম রোকেয়ার একান্তই নিজস্ব চিন্তাচেতনার। বেগম রোকেয়ার সঙ্গে পশ্চিমা নারীবাদের সংশ্রব থাকা তো দূরে থাক, উনি এই ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। যদিও এখন বিশ্বে প্রথম সারির দশজন নারীবাদীর মধ্যে বেগম রোকেয়া একজন অন্যতম। অবশ্যই তিনি তার সময় থেকে অগ্রসরমান ছিলেন। কিন্তু বেগম রোকেয়া কাজ করেছিলেন নিজ কৃষ্টি, সংস্কৃতির মধ্যে থেকে নারীকে সচেতন করে তোলার জন্য। বিষয়টা হলো মানসিকতার পরিবর্তন। এরজন্য দরকার মানুষের কাছাকাছি মাটি সংলগ্ন থাকা। যে কাজটা বেগম রোকেয়া সযত্নে নিজ দায়িত্বে করে গেছেন।

নারীবাদ নিয়ে তাত্ত্বিক ধরণের লেখা দরকার আছে। এ সমস্ত লেখা দরকার হলো সমাজ পরিবর্তনে পরিকল্পনার জন্য। যা সাধারণ নারীদের বোধের বাইরে। তাছাড়া এসমস্ত লেখা একটা বিশেষ শ্রেণি অর্থাৎ এলিট শ্রেণির মানুষের মধ্যে ঘুরপাক খায়। সাধারণ নারীর কাছে পৌঁছায়ও না। আবার এই তাত্ত্বিক নারীবাদ নিয়ে লাইভ ভিডিও হয়েছে অনেক। যার অনেককিছুই সাধারণ নারীরা ধরতে পারেননি। বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে এমন তাত্ত্বিক নারীবাদ চর্চা করলে তাও কিছুটা গ্রহণযোগ্যতা রাখে। পশ্চিমা ধাঁচের নারীবাদ যতই বাংলাদেশে ব্লান্ট করার চেষ্টা করা হোক না কেন, তা দেশের সাধারণ মানুষ কতটুকু নিতে পারছে, তা-ও ভেবে দেখা উচিৎ। এদিক থেকে নারী সংক্রান্ত অনলাইন পত্রিকা ফ্যামিনিস্ট ফ্যাক্টরের সম্পাদক শারমিন শামসের কাজগুলো বেশ বাস্তবমুখী। সহজ, সরল ভাষায় নারীর বোঝার মতো করে বিষয়গুলো তুলে আনছেন।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর সমস্যা বেশ ভিন্নতা রাখে। নারী যে সমস্যাগুলো নিয়ে জীবনযাপন করছে, সেই সমস্যাগুলো অঙ্গুলি নির্দেশ করে বুঝিয়ে দেয়া যাতে নারী অনুধাবন করতে পারে যে, সে কেমন জটিল এবং কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা মূলতই অমানবিক। কারণ, বাংলাদেশের অধিকাংশ নারী মনে করে, এটাই নারীর স্বাভাবিক জীবন। এই মানসিকতা ভাংতে হলে ওদের মতো করে ওদের ভাষায় কথা বলে ওদের কাছে যেতে হবে যা তাত্ত্বিকভাব সম্ভব নয়। উদ্ভট কিছু উদাহরণ দিলে অধিকাংশ শিক্ষিত নারী দেখেছি এসব কানের পাশ দিয়েও নেয় না। সহনশীল এবং সহজবোধ্য করে সাধারণ জীবনযাপনে অভ্যস্ত নারীদের মধ্যে মানুষ হিসেবে সচেতনতা গড়ে তোলার কাজটা করা যেতে পারে। এই কাজগুলো করা উচিৎ রুট লেবেল থেকে। তাই বলছি, নারীর মানসিকতা প্রথমে বদলানো দরকার। নারী সচেতন হলেই সে শিক্ষিত হবে। আসবে অর্থনৈতিক মুক্তি। যে কাজটা বেগম রোকেয়া শুরু করে গেছেন বটে কিন্তু আমারা তার চর্চা বাস্তবমুখী হয়ে করে যেতে পারিনি বলেই আজ আমাদের নারীদের এই দুর্দশা। তবুও আশাবাদী, মুক্তি একদিন আসবেই।

লেখক: কবি, সাহিত্যিক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

আঞ্জুমান রোজী নারীর মানসিকতা আজও বদলায়নি ফিচার রোকেয়া সরণি


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর