Saturday 07 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

ক্র্যাকপ্লাটুনের অপারেশন জর্দার টিন

রহমান রা’আদ
২০ অক্টোবর ২০২২ ১৪:৪৬

একাত্তরের মে মাস। সেক্টর-২ এর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ আরবান গেরিলাদের প্রথম দলটিকে মেলাঘরের ট্রেনিং শেষে পাঠালেন ঠিক ঢাকার হৃদপিণ্ডে, তাদের উপর হিট অ্যান্ড রান পদ্ধতিতে আচমকা গেরিলা হামলা চালিয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে পাল্টা ভয় দেখানোর দায়িত্ব দেওয়া হলো। অকুতোভয় এই গেরিলা দল সেই দায়িত্ব এতটাই অভূতপূর্ব বীরত্বে ও দুর্ধর্ষ সাহসিকতায় পালন করেছিলো যে, কিছুদিন পর থেকে আচমকা গেরিলা হামলার ভয়ে সন্ধ্যার পর পাকিস্তানীরা নিয়মিত টহল দিতেও বের হতে চাইত না।

মে’র মাঝামাঝি থেকেই ঢাকার এই আরবান গেরিলা দলের জন্য বেশ কয়েকটি গোপন আস্তানা বা হাইডআউট নির্দিষ্ট হয়, যেখানে ঝটিকা অপারেশন করে মুহূর্তের মধ্যে আশ্রয় নেওয়া যেত। সীমান্তের ওপার থেকে অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ আনার পর সেগুলো নিরাপদে রাখা এবং পরবর্তী অপারেশনের প্ল্যানিং এবং কো-অর্ডিনেশনের জন্যও এই ধরণের হাইডআউটগুলো ছিলো খুবই জরুরী। এখান থেকে পরবর্তীতে অবাঙ্গালী, উর্দুভাষী বিহারী এবং পাকিস্তানী সেনাদের উপর আচমকা অজস্র হামলা চালানো হয়। বলাই বাহুল্য, এসব অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানী ও বিহারীদের মধ্যে প্রচণ্ড আতঙ্ক সৃষ্টির লক্ষ্য পুরোপুরি সফল হয়েছিল।

এর মাঝে কিছু অপারেশন ছিল একেবারেই সাদামাটা এবং এতে কোনও ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার হত না। ছোট প্লাস্টিক মাইন এবং বুক ভরা অসমসাহস— এইটুকু সম্বল করেই দুর্ধর্ষ এই তরুণেরা নরক নামিয়ে আনতো পাকিপন্থীদের উপর। এইসব ছোট মাইন দেখতে ছিল জর্দার কৌটার মতো। যারা জর্দা দিয়ে পান খেয়ে অভ্যস্ত, তারা এই মাইনের আকার ও ধরণ সম্পর্কে সহজে বুঝবেন। একটা জর্দার টিন এবং একটি মাইনের মধ্যে একমাত্র যে পার্থক্যটি ছিল, তা হলো মাইনের গায়ের রঙ ছিল ফিকে সবুজ। এগুলো ব্যবহার করা ছিল খুবই সহজ এবং যে কেউ অনায়াসে প্যান্টের পকেটে দুটি, তিনটি করে মাইন লুকিয়ে রেখে হাঁটা-চলা করতে পারতো।

১৯৭১ সালের জুনের শুরুতেই মেজর খালেদ মোশাররফের নির্দেশে ঢাকার আরবান গেরিলাদের প্রথম ১৭ জনের যে দলটি প্রবেশ করেছিল বিশেষ এসাইনমেন্টে, সেই দলের হাবিবুল আলম, মায়া, জিয়াউদ্দিন, স্বপনদের দলটি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ৯ই জুন প্রথমবারের মতো সরাসরি গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করলো পুরো ঢাকা জুড়ে। খালেদ মোশাররফ তাদের বলেছিলেন ঢাকার আশেপাশে বোমা ফাটাতে, যেন পাকিস্তানীরা ভয় পায় এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিদল ভয়ংকর পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারে। কিন্তু এই অসম সাহসী দলটি সরাসরি গিজগিজে পাকিস্তানী সেনাদের কড়া পাহারা ফাঁকি দিয়ে ভেতরে ঢুকে ঢাকার গ্রীনজোন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আক্রমণ চালায়, প্রচণ্ড বিস্মিত সেক্টর কমান্ডার খালেদ বিরক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘দিজ আর অল ক্র্যাক পিপল, বললাম ঢাকার আশেপাশে আক্রমণ চালাতে, এরা সরাসরি ইন্টারকন্টিনেন্টালেই আক্রমণ চালিয়েছে!’

এই অপারশনের পর আরবান গেরিলাদের এই দলটি আন-অফিশিয়ালি ক্র্যাক প্লাটুন হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠতে শুরু করে। হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সফল অপারেশন শেষে মেলাঘরে ফেরার পর সেক্টর-২ গেরিলাযুদ্ধের প্রশিক্ষক এবং সেকেন্ড-ইন-কমান্ড মেজর এ টিম এম হাবিবুল আলমকে জানান, ১২ থেকে ১৫ জনের একটি দল নিয়ে তাকে আবার ঢাকায় আসতে হবে। এই দলটির সঙ্গে থাকবে এসএলআর রাইফেল, পিইকে এক্সপ্লোসিভ, ভারতে তৈরি স্টেনগান ও ক্ষুদ্র প্লাস্টিক মাইন অর্থাৎ জর্দার কৌটাসহ আরও অন্যান্য মাইন।

উল্লেখ্য, বাঙ্গালীদের মধ্যে জর্দার টিন অতি পরিচিত হওয়ায় এই অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন জর্দার টিন’। এই ক্ষুদে মাইন ব্যবহার করে যেকোনো স্থানে, যেকোনো সময় গাড়ী, জিপ, ট্রাক বা বাসের চাকা উড়িয়ে দেওয়া যেত। কেউ এই মাইন মাড়িয়ে গেলে তার এক পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু অঙ্গহানি বা প্রাণহানির চেয়েও এই জর্দার টিন শত্রুপক্ষের ভয়ংকর ক্ষতি করেছিল মূলত আচমকা যেখানে সেখানে বিস্ফোরিত হয়ে তাদের ভেতর অকল্পনীয় আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিয়ে। সন্ধ্যার পর স্রেফ এই পুঁচকে জর্দার টিনের ভয়ে পাকিস্তানীরা নিয়মিত টহলে বাইরে বেরোনোই বন্ধ করে দিয়েছিল!

তবে ঢাকা শহরে এই জর্দার টিনের আক্রমণের ফলাফলটা প্রায় সময়ই হতো ভয়াবহ। এই বিচ্ছুদের টিকিটাও ছুঁতে না পেরে নাকানিচুবানি খাওয়া পাকিস্তানী কাপুরুষের দল অক্ষম আক্রোশে জ্বলতে জ্বলতে ভারী অস্ত্র নিয়ে সংশ্লিষ্ট এলাকা ঘিরে ফেলে নিরীহ অসামরিক বাঙ্গালীদের ধরে প্রচণ্ড অত্যাচার এবং নির্যাতন করতো এবং মাঝে মাঝে মেরে ফেলার জন্য ধরে নিয়ে যেত। তবে মজার ব্যাপার হলো, বাঙ্গালীদের সঙ্গে সঙ্গে তারা স্থানীয় বিহারীদেরও এইসব ঘটনা কেন ঘটলো, সেই অপরাধে পেটাতো।

যেহেতু বিহারীরা, বিশেষ করে মিরপুর ও মোহাম্মদপুরের বিহারীরা মার্চের শেষ থেকেই নির্বিচারে হাজার হাজার বাঙ্গালীদের জবাই ও টুকরো টুকরো করে মেরে ফেলার কাজে নিয়োজিত ছিল এবং তারা সুযোগ পেলেই পাকিস্তানীদের চর হিসেবে বাঙ্গালীদের অত্যাচার করতো, নিদারুণ উপহাস এবং অপমান এবং টিটকারি করে জঘন্যভাবে অপমান করতো, সুতরাং ক্র্যাকপ্লাটুনের এই বিচ্ছুরা বিহারীদের একটা শিক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

হাবিবুল আলম এবং বদিউল আলম একসঙ্গে বসে এই প্ল্যানটা তৈরি করেন। তাদের লক্ষ্য মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্প, যেখানে প্রতিদিনই বাঙ্গালীদের ধরে আনা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে, মেরে ফেলা হচ্ছে এবং যখনই যেভাবেই সুযোগ পাওয়া যায়, তখনই অপমান করা হচ্ছে বাঙ্গালীদের। বদি-আলমসহ গেরিলারা বাঙ্গালী ভাইবোনদের প্রতি বিহারীদের এই গালাগালি এবং অত্যাচার সহ্য করতে পারছিলেন না। তাই আলম এবং বদি একদিন সন্ধ্যায় আলমের বাবার ট্রায়াম্ফ হেরাল্ড গাড়িটি নিয়ে বেশ স্বাভাবিক ভদ্রলোকের মতো আওরঙ্গজেব রোড ধরে মোহাম্মদপুরের দিকে রওয়ানা হলেন। এরপর প্ল্যান অনুযায়ী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল ও কলেজের পেছন দিয়ে বামে মোহাম্মদপুরের দিকে মোড় নিয়ে পুরো এলাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘোরে এবং খুব কৌশলে গাড়ি থামিয়ে ৬ থেকে ৮টি মাইন বিভিন্ন রাস্তায় পাতেন। এরপর একেবারে স্বাভাবিকভাবে গাড়ি চালিয়ে ভিন্ন রাস্তা ধরে ধানমন্ডি চলে আসেন।

ফলাফল হয় ভয়ংকর। রাতের বেলা মোহাম্মদপুর এলাকায় টহল দিতে বেরিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের বেশ কয়েকটি ডজ পেট্রল ট্রাক এই মাইনের উপর দিয়ে চলে যায় এবং ট্রাকের চাকাগুলো উড়ে গিয়ে ট্রাক উল্টে যায়। পাকিস্তানী সেনারা প্রচণ্ড আতঙ্ক এবং ভয়ে ইঁদুরের বাচ্চার মত ছোটাছুটি শুরু করে। তারপর আরও সেনা এসে সারা রাত ধরে তাদের বিশ্বস্ত বিহারীদের এলাকা মোহাম্মদপুরের প্রতিটি বাড়িঘরে তল্লাশি চালায় এবং প্রত্যেক বিহারীকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে সারা রাত জিজ্ঞাসাবাদ করে। অনেক বিহারীকেই প্রচণ্ড পেটানো হয়। এই ঘটনায় বিহারীরা পুরোপুরি হতভম্ব হয়ে একেবারে স্তব্ধ হয়ে যায়, সারা রাত আপ্রাণ চেষ্টা করেও তারা পাকিস্তানীদের বোঝাতে পারেনি যে তারা এই মাইন বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত না।

বর্বর পাকিস্তানীদের ‘লয়্যাল ডগ’ বিহারীদের জন্য এটা ছিল এক বিশাল শিক্ষা, তারা সন্দেহ করছিল যে এই কাজ মুক্তিযোদ্ধাদের, কিন্তু তাদের হাতে কোনও প্রমাণ ছিল না। কারণ একেবারে স্বাভাবিক ভদ্রলোকের মতো চমৎকার দামী কাপড়চোপড় পরে দামী গাড়ি হাঁকানো বদি-আলমসহ ক্র্যাকপ্লাটুনের গেরিলাদের দেখলে ঘুণাক্ষরেও কারো বোঝার উপায় ছিল না যে এরাই অসম সাহসে স্বয়ং শয়তানের ধূর্ততাকেও হার মানিয়ে দেওয়ার সাহসে সারা ঢাকা শহরে নাচিয়ে বেড়াচ্ছে পাকিস্তানীদের! ঢাকাকে নিরপরাধ বাঙ্গালীদের বধ্যভূমিতে পরিণত করা পাকিস্তানী নরপশুদের রীতিমত ভীত সন্ত্রস্ত উদ্ভ্রান্ত ইঁদুরের বাচ্চায় পরিণত করা ক্র্যাকপ্লাটুনের এই ইতিহাস ছিল পৃথিবীর আরবান গেরিলাযুদ্ধের এক অসামান্য কীর্তি!

তথ্য কৃতজ্ঞতা: ব্রেভ অফ হার্ট/ হাবিবুল আলম বীর প্রতীক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ক্র্যাকপ্লাটুনের অপারেশন জর্দার টিন ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা'আদ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর