Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

কেমন ছিল একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর?

ফারুক ওয়াহিদ
১৪ ডিসেম্বর ২০২২ ১৬:২৩

একাত্তরে বিজয়ের মাসের ১৪ ডিসেম্বর দিনটি ছিল মঙ্গলবার। বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে এসেও একাত্তরের এ দিনটি অবরুদ্ধ ঢাকাবাসীদের জন্য ছিল শ্বাসরুদ্ধকর। মিত্র ও মুক্তিবাহিনী বিজয়ের বেশে ঢাকার কাছাকাছি চলে আসায় ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বাঙালির বিজয় তখন সুনিশ্চিত।

এমন একটি সময়ে আত্মসমর্পণের মাত্র দুই দিন আগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনে গেছে, তখন তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আল সামস, আল মুজাহিদদের নিয়ে নীল-নকশায় নামে। বাঙালি জাতিকে চিরদিনের জন্য মেধাশূন্য দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার অপচেষ্টায় এবং বাঙালি জাতি যেন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে সেই উদ্দেশ্যে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী তথা বরেণ্য শিক্ষাবিদ, গবেষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, কবি ও সাহিত্যিকদের কারফিউয়ের মধ্যে শীতার্ত রাতের আঁধারে ঘর থেকে বের করে নিয়ে ঠাণ্ডা মাথায় নির্মমভাবে হত্যা করে।

এদিকে, ১৪ ডিসেম্বর ঢাকার উপকণ্ঠ সাভার মুক্ত হয়। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গেরিলা গ্রুপের মাধ্যমে সাভার শত্রুমুক্ত হয়েছিল। ১৪ ডিসেম্বর সকালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৩০ থেকে ৪০ জনের একটি দল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নাস্তানাবুদ হয়ে টাঙ্গাইল থেকে বিতাড়িত হয়ে ঢাকার পথে জিরাবো এলাকার ঘোষবাগ গ্রামের এসে পৌঁছালে ঝাঁপিয়ে পড়ে অ্যামবুশ পেতে থাকা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর গেরিলা বাহিনী। উচ্ছ্বসিত কিশোর টিটু সহযোদ্ধাদের নিষেধ উপেক্ষা করে গুলি করতে করতে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। হঠাৎ একঝাঁক তপ্ত বুলেটের আঘাত ঝাঁঝরা করে দেয় কিশোর প্রাণটিকে। কিশোর মুক্তিযোদ্ধা দশম শ্রেণির ছাত্র গোলাম মোহাম্মদ দস্তগীর টিটুর রক্তে মুক্ত হয় সাভার। মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে শত্রুমুক্ত হয় দিনাজপুর, বগুড়ার শিবগঞ্জ, জয়পুরহাটের পাঁচবিবিসহ চট্টগ্রামের বান্দরবান।

১৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার ভোর থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাঞ্ছারামপুরে পলায়নপর হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে চলতে থাকে মরণপণ রক্তক্ষয়ী তুমুল সংঘর্ষ। আমরা মুক্তিযোদ্ধারা (লেখকের গ্রুপ) রুপসদী মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প থেকে ডাবল মার্চ করতে করতে বৃষ্টির মতো প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে ক্রলিং করে করে পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতি গুলিবর্ষণ করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। পাকিস্তানিরাও এমএমজি (মিডিয়াম মেশিন গান) দিয়ে ননস্টপ পাল্টা ফায়ার করতে করতে পিছু হটছিল।

পলায়নপর পাকিস্তানি সৈন্যরা ধাওয়া খেয়ে তাদের কাছে থাকা একটি ছোট লঞ্চ দিয়ে তিতাস নদী পেরিয়ে তিতাসের পার ঘেঁষে ঘাগুটিয়া গ্রামে একটি বড় পাকা মসজিদে শক্ত অবস্থান নেয়। তখনও পাকিস্তানি সৈন্যদের অনেকেই নদী অতিক্রম করতে পারেনি। তিতাস নদী অতিক্রমের সময় আমাদের গুলিতে বেশকিছু পাকিস্তানি সৈন্য মারা যায় ও আহত হয় এবং তিতাস নদীতে ডুবে মরে।

আমরা পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে প্রচুর গুলিসহ (চেইনের মধ্যে সেট করা) পাকা জলপাই রঙের একটি এমএমজি উদ্ধার করি। প্রচণ্ড গোলাগুলিতে প্রকম্পিত হয়ে উঠে বাঞ্ছারামপুর-হোমনার বিরাট এলাকা; কেঁপে কেঁপে ওঠে শান্তশিষ্ট কাজলকালো তিতাস নদীর জল। ১৪ তারিখে যুদ্ধের মধ্যেই উজানচর গ্রামের এক নারী আমাদের থেকে একটি পাকিস্তানি সৈন্যের লাশ নিয়ে যায়। পরে শুনেছি নারীরা ওই পাকিস্তানি সৈন্যের লাশকে ঝাড়ু দিয়ে পিটিয়েছে; বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যদের প্রতি এমনই আক্রোশ ছিল গ্রামবাংলার নারীদের।

এদিকে, মিত্র-মুক্তিবাহিনী তখন বিজয়ীর বেশে চার দিক থেকে ঢাকার দিকে এগিয়ে আসছে। যৌথ বাহিনী তথা ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল মানেকশ বিভিন্ন ভাষায় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণের বাণী লিফলেট করে আকাশে ছড়িয়ে দেন। ১৪ ডিসেম্বর বিকেলে ভারতীয় মিগ-২১ জঙ্গি বিমান কোনো ধরনের প্রতিরোধ ছাড়াই ঢাকার নীলাকাশে উড়তে থাকে। প্রচারপত্রে পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে আত্মসমর্পণ করার আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, তারা আত্মসমর্পণ করলে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী তাদের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ।

একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর এবং তার আগে যে কয়েকজন স্বনামধন্য বুদ্ধিজীবী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরদের হাতে প্রাণ হারান তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন—

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক: (১) ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব (দর্শনশাস্ত্র), (২) ড. মুনির চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), (৩) ড. মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী (বাংলা সাহিত্য), (৪) ড. আনোয়ার পাশা (বাংলা সাহিত্য), (৫) ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), (৬) ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (ইংরেজি সাহিত্য), (৭) ড. সিরাজুল হক খান (শিক্ষা), (৮) ড. এ এন এম ফাইজুল মাহী (শিক্ষা), (৯) হুমায়ূন কবীর (ইংরেজি সাহিত্য), (১০) রাশিদুল হাসান (ইংরেজি সাহিত্য), (১১) সাজিদুল হাসান (পদার্থবিদ্যা), (১২) ফজলুর রহমান খান (মৃত্তিকা বিজ্ঞান), (১৩) এন এম মনিরুজ্জামান (পরিসংখ্যান), (১৪) এ মুকতাদির (ভূ-বিদ্যা), (১৫) শরাফত আলী (গণিত)। (১৬) এ আর কে খাদেম (পদার্থবিদ্যা), (১৭) অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য (ফলিত পদার্থবিদ্যা), (১৮) এম এ সাদেক (শিক্ষা), (১৯) এম সাদত আলী (শিক্ষা), (২০) সন্তোষচন্দ্র ভট্টাচার্য (ইতিহাস), (২১) গিয়াসউদ্দিন আহমদ (ইতিহাস), (২২) রাশীদুল হাসান (ইংরেজি), (২৩) এম মর্তুজা (চিকিৎসক)।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক: (১) ড. হবিবুর রহমান (গণিত বিভাগ), (২) ড. শ্রী সুখারঞ্জন সমাদ্দার (সংস্কৃত), (৩) মীর আবদুল কাইউম (মনোবিজ্ঞান)।

চিকিৎসক: (১) অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি (হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ), (২) অধ্যাপক ডা. আলিম চৌধুরী (চক্ষু বিশেষজ্ঞ), (৩) অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, (৪) ডা. হুমায়ুন কবীর, (৫) ডা. আজহারুল হক, (৬) ডা. সোলায়মান খান, (৭) ডা. আয়েশা বদেরা চৌধুরী, (৮) ডা. কসির উদ্দিন তালুকদার, (৯) ডা. মনসুর আলী, (১০) ডা. মোহাম্মদ মোর্তজা, (১১) ডা. মফিজউদ্দীন খান, (১২) ডা. জাহাঙ্গীর, (১৩) ডা. নুরুল ইমাম, (১৪) ডা. এস কে লালা, (১৫) ডা. হেমচন্দ্র বসাক, (১৬) ডা. ওবায়দুল হক, (১৭) ডা. আসাদুল হক, (১৮) ডা. মোসাব্বের আহমেদ, (১৯) ডা. আজহারুল হক (সহকারী সার্জন), (২০) ডা. মোহাম্মদ শফী (দন্ত চিকিৎসক)।

অন্যান্য: (১) শহীদুল্লাহ কায়সার (সাংবাদিক), (২) নিজামুদ্দীন আহমেদ (সাংবাদিক), (৩) সেলিনা পারভীন (সাংবাদিক), (৪) সিরাজুদ্দীন হোসেন (সাংবাদিক), (৫) আ ন ম গোলাম মুস্তফা (সাংবাদিক), (৬) আলতাফ মাহমুদ (গীতিকার ও সুরকার), (৭) ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত (রাজনীতিবিদ), (৮) রণদাপ্রসাদ সাহা (সমাজসেবক এবং দানবীর), (৯) যোগেশ চন্দ্র ঘোষ (শিক্ষাবিদ, আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক), (১০) জহির রায়হান (লেখক, চলচ্চিত্রকার), (১১) মেহেরুন্নেসা (কবি), (১২) ড. আবুল কালাম আজাদ (শিক্ষাবিদ, গণিতজ্ঞ), (১৩) নজমুল হক সরকার (আইনজীবী), (১৪) নূতন চন্দ্র সিংহ (সমাজসেবক, আয়ূর্বেদিক চিকিৎসক।

লেখক: মুক্তিযোদ্ধা; যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী লেখক

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

ইতিহাস-ঐতিহ্য কেমন ছিল একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর? ফারুক ওয়াহিদ ফিচার মুক্তিযুদ্ধ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর