Friday 06 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘মাকে’ মুক্ত করতে গিয়েছিলেন মিনু রাণী, মা কী মুক্ত হয়েছে আদৌ?

রমেন দাশগুপ্ত
১৬ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:৫৬

১৯৭১ সালে মিনু রাণী দাশ ছিলেন সদ্য কৈশোর পার করা তরুণী। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পর একদিন মায়ের কাছে লেখা একটি চিরকুট ঘরে রেখে চলে যান রণাঙ্গনে। সেই চিরকুটে লেখা ছিল, ‘মাকে মুক্ত করতে চললাম, তোমাদের ঈশ্বরের ভরসায় রেখে যাচ্ছি।’ অস্ত্র চালানো, গ্রেনেড নিক্ষেপের প্রশিক্ষণ নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন যুদ্ধে। গেরিলা বাহিনীর হয়ে চট্টগ্রাম শহরে অস্ত্র হাতে সরাসরি কয়েকটি অপারেশনে অংশ নেন এই তরুণী।

চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন নারী মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই কণ্ঠযোদ্ধা, সরাসরি অস্ত্রযোদ্ধা হাতেগোণা যে কয়েকজন নারী ছিলেন, তাদের মধ্যে মিনু রাণী একজন।

বিজয় দিবসকে সামনে রেখে বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজারের বাসিন্দা মিনু রাণী দাশের সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার। বয়স এখন ৭১। লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত। বয়সের ভার কেড়ে নিতে পারেনি স্মৃতিকে। মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর চট্টগ্রাম শহরের পরিস্থিতি জীবন্ত হয়ে ওঠে তার কথায়।

চট্টগ্রাম শহরের পাথরঘাটায় ছিল তাদের বাড়ি। ১৯৫২ সালে জন্ম নেয়া মিনু শৈশবেই বাবাকে হারান। মা ও চার ছোট বোনসহ পাঁচজনের ভরণপোষণের ভার এসে পড়ে বড় সন্তান মিনু রাণীর ওপর। ১৯৬৮ সালে এসএসসি পাস করেন। এরপর সিটি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়ে জড়িয়ে পড়েন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। সিটি কলেজ ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সুলতানুল কবির চৌধুরী ও ছাত্রী বিষয়ক সম্পাদক জাহানারা আঙ্গুরের সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যেতেন।

‘দেশে তখন রাজনৈতিক আন্দোলন তুঙ্গে। নিয়মিত মিছিল-মিটিংয়ে যাই। কোনো পদে ছিলাম না, একজন সাধারণ কর্মী হিসেবেই ছাত্রলীগে সক্রিয় ছিলাম। ঊনষত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর বঙ্গবন্ধু জেল থেকে বের হয়ে একদিন চট্টগ্রামে এলেন। ফিরিঙ্গিবাজারে দোভাষ ভবনে মহিলা সম্মেলন করেছিলেন। সেখানে জাহানারা আঙ্গুর আপার সঙ্গে আমিও যাই। সভা শেষে আমি বঙ্গবন্ধুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করি। বঙ্গবন্ধু মাথায় হাত রেখে আর্শীবাদ করেন।’

স্মৃতির ঝাঁপি খুললেন মিনু রাণী- সংসারে অভাব-অনটন। দিনান্তে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। সিটি কলেজে পড়া অবস্থায় ১৯৭১ সালের ১ মার্চ রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ণ ক্যাবলসে জুনিয়র ক্লার্কের চাকরিতে যোগ দেন।

‘দেশ তখন খইয়ের মতো ফুটছে। চট্টগ্রাম হয়ে গেল মিছিল-সমাবেশ, অবরোধের শহর। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণাই দিয়ে দিলেন। চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্র নিয়ে সোয়াত জাহাজ এল। বন্দরের শ্রমিকরা জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসে অসম্মতি জানিয়ে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করল। ছাত্র, যুব, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা অস্ত্র নেয়া ঠেকাতে রাস্তা অবরোধ করল। গাড়ি চলছে না, পতেঙ্গায় আর অফিসে যেতে পারলাম না। এর মধ্যে ২৫ মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধরপাকড়, গুলি, নির্যাতন শুরু করল। শহরে আর থাকতে পারলাম না। মা ও চার বোনকে নিয়ে চলে গেলাম বোয়ালখালীর শাকপুরা গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে যাই।’

মিনু রাণী জানালেন, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। এপ্রিলের শুরুতে তিনি শাকপুরা থেকে আবার শহরে ফেরেন। নালাপাড়ায় এয়াকুব গেইট এলাকায় বান্ধবী ফতেমার বাসায় ওঠেন। ফাতেমার ভাই শফি একদিন জানালেন, তারা বন্ধুরা সবাই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিচ্ছেন। মিনু যুদ্ধে যাবার আগ্রহ প্রকাশ করেন। মায়ের অনুমতি নেয়ার জন্য আবার শাকপুরায় যান।

‘সেখানে রাতটা কাটাই। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের জন্য একটি চিঠি লিখে আমি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাই। বোয়ালখালীর মিলিটারি পুলে গিয়ে সাম্পানে করে শহরে কর্ণফুলী নদীর অভয়মিত্র ঘাটে চলে আসি। শফিদের সঙ্গে এক নম্বরের সেক্টরের অধীন কর্ণফুলী কোম্পানি-৩ এ যোগ দিই। আমাদের সেক্টর কমান্ডার ছিলেন ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম। কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন নুরুল আলম মন্টু এবং সহকারী কমান্ডার নুরুদ্দীন চৌধুরী। এই কোম্পানিতে মোট ৯০ জন ছিলাম, আমি মেয়ে একজনই ছিলাম। ফিরিঙ্গিবাজারে টমাস ডায়াসের বাসা ছিল আমাদের আস্তানা। পরে অবশ্য আমাদের আরও কয়েকটি আস্তানা বদলাতে হয়েছে।’

ছাত্রলীগ নেতা মৌলভী সৈয়দ ও রেলওয়ের নিরাপত্তা পরিদর্শক রেজাউল কোম্পানির সদস্যদের রাইফেল চালানো, গ্রেনেড নিক্ষেপসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেন। আগ্রাবাদের পানওয়ালা পাড়ায় তাদের প্রশিক্ষণ হয়। এছাড়া গেরিলা যুদ্ধের নানা কৌশল শেখানো হয় তাদের। প্রশিক্ষণ শেষে গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী সদস্যদের নিজ নিজ এলাকায় বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে দায়িত্ব দেয়া হয়।

‘প্রথমে আমাকে মূলত ইনফর্মারের দায়িত্ব দেয়া হয়। এক ক্যাম্প থেকে আরেক ক্যাম্পে খবরাখবর পৌঁছানো, অস্ত্র পৌঁছে দেয়া এগুলো ছিল আমার কাজ। আমি খুব পাতলা ছিলাম। চুল ছোট করে কেটে ফেলা হয়। সবসময় শার্ট-প্যান্ট পরে থাকতাম, কেউ বুঝতো না আমি মেয়ে। বিভিন্ন ক্যাম্পে যাবার সময় সেনাবাহিনীর চেকপোস্ট কিংবা ক্যাম্পের সামনে দিয়ে যেতে হলে ঝাড়ুদারের বেশ নিতাম। রাস্তা ঝাড়ু দিতে দিতে সেই ক্যাম্প পার হয়ে যেতাম।’

আগস্টে এসে কর্ণফুলী কোম্পানি-৩ এর সদস্যরা শহরের বিভিন্নস্থানে অপারেশন শুরু করেন। মিনু রাণী তখনও তথ্য সংগ্রহ এবং অপারেশনে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র-গ্রেনেড পৌঁছে দেয়ার কাজ করছিলেন। পাথরঘাটায় ক্যাথলিক ক্লাবের সামনে রাজাকারদের একটি ক্যাম্প থেকে অস্ত্র লুটের মধ্য দিয়ে মিনু সরাসরি অপারেশনে অংশগ্রহণ শুরু করেন।

‘রাজাকারদের ক্যাম্পে আক্রমণের নির্দেশ দিলেন কমান্ডার। আমাদের চারজনকে দায়িত্ব দেয়া হল। আমি ঝাড়ুদার, একজন বাদাম বিক্রেতা, আরেকজন ভিক্ষুক এবং চতুর্থজন টেক্সিচালকের বেশে ওই এলাকায় গিয়ে প্রথমে রেকি করি। আমরা উর্দুতে কিছু কথা বলতে পারতাম। বাংলায় বললে হিন্দু আর মুক্তিবাহিনী বলে ধরে নির্যাতন করতো। বাঙালি রাজাকারদের ছয়জন ক্যাম্পে বসা ছিল। আমি ঝাড়ু নিয়ে তাদের কাছে গিয়ে বললাম- বহুতদিন সাফসুরন নেহি করে গা, তোমলোক ভি বাহার যাও গা, সাফসুরত করতা। তারা ভাবল, আমি পাকিস্তানের পক্ষের লোক। তারা আমাকে ঢুকতে দিল।’

মিনু রাণী জানালেন, তিনি মরিচের গুঁড়া নিয়ে গিয়েছিলেন। ঢুকেই আগে একজনের চোখে মরিচের গুঁড়া ছিটিয়ে দেন। তাকে নিয়ে অন্যরা ব্যস্ত হয়ে পড়লে বাইরে থেকে বাকি তিন গেরিলা যোদ্ধা ক্যাম্পে প্রবেশ করেন। তখন বাকি পাঁচ রাজাকারের চোখেও মরিচের গুঁড়া মেখে দেয়া হয়। ক্যাম্পে থাকা ছয়টি রাইফেল নিয়ে তারা দ্রুত বেবিটেক্সিতে করে পাথরঘাটা থেকে চলে যান।

এর আনুমানিক ১৫ দিন পর জামালখানে সেন্টমেরিস স্কুলের পাশে পাকিস্তানি সেনাদের বহনকারী ট্রাক গ্রেনেড ছুঁড়ে ধ্বংস করে গেরিলা দল, যাতে অংশ নেন মিনুও।

‘প্রতিদিন সকালে জামালখানে ডিপোতে এসে ট্রাকে তেল নিত পাকিস্তানি সেনারা। আমরা কয়েকদিন ধরে তাদের তথ্য সংগ্রহ করি। এক সকালে আমরা চারজন একটি বেবিটেক্সিতে করে খাস্তগীর স্কুলের সামনে যাই। কিছুক্ষণ পর ট্রাক আসে। আমরা কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ট্রাকে পরপর চারটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে বিভিন্ন রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যাই। দূর থেকে দেখছিলাম, ট্রাক জ্বলছে। তবে কেউ হতাহত হয়েছিল কি না সেই খবর আর নিতে পারিনি।’

এরপর ডিসেম্বরে শহরের ফিশারিঘাট এলাকায় আরেকটি বড় অপারেশন করে গেরিলা বাহিনী, যার নেতৃত্বে ছিলেন মিনু রাণী। তখন দেশের বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর আসছিল। পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে পাকবাহিনী। কিন্তু চট্টগ্রামে তাদের দাপট ছিল অক্ষুন্ন। এক নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার থেকে নির্দেশ আসে, একইদিন একইসময়ে একইসঙ্গে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চট্টগ্রাম শহরের সব ট্রান্সফরমার বিকল করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে হবে।

‘রাত ১০টার দিকে আমি সাম্পানে করে অভয়মিত্র ঘাট থেকে ফিশারিঘাটে পৌঁছাই। সেখান থেকে আমি ইকবাল রোডের বাসায় চলে যাই। রাতে কোম্পানি কমান্ডার নুরুল আলম মন্টু ও চারজন সদস্য আমার বাসায় আসেন। আমার হাতে একটি রেডিয়াম ঘড়ি লাগিয়ে দিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে চলে যান কমান্ডার। আমরা পাঁচজন রাতে বাসায় থাকলাম। ভোর সাড়ে ৪ টার দিকে বাসা থেকে বেরিয়ে হেঁটে ফিশারিঘাট গেলাম। আমার হাতে ছিল সবজিভর্তি ব্যাগ, ভেতরে গ্রেনেডের রাসায়নিক টিএনটি স্ল্যাব ও কয়েকটি গ্রেনেড।’

দুঃসাহসিক সেই অভিযানের বর্ণনা দিয়ে মিনু রাণী বললেন, ‘কমান্ডারের নির্দেশ অনুযায়ী, প্রথমে ফিশারিঘাটে ট্রান্সফরমারের সামান্য দূরে কয়েকটি ঢিল ছুঁড়ি। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যারা সেটার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন তারা আওয়াজ কোথা থেকে এল, সেটা দেখতে গেল। তখন আমরা ট্রান্সফরমারের কাছে পৌঁছাই। আমি হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে ট্রান্সফরমারের সঙ্গে টিএনটি স্ল্যাব যুক্ত করি। সেখান থেকে লাইন নিয়ে রাস্তার পাশে খাদে চলে আসি। পাশেই ঝোপঝাঁড় ছিল, সেখানে আশ্রয় নিই।’

‘অন্ধকারে আমার রেডিয়াম ঘড়িতে দেখা গেল ৫টা ২৬ মিনিট। নির্দেশনা ছিল সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড নিক্ষেপ করার। সহযোদ্ধা কামাল সিগারেটে আগুন দিল। সেই আগুন টিএনটি স্ল্যাবের লাইনে ধরে দ্রুত ছড়িয়ে সঙ্গে সঙ্গে ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। সারা শহরজুড়ে ট্রান্সফরমার বিস্ফোরণের বিকট শব্দ। হতবিহ্বল সেনারা এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে থাকে। আমরা মাটির সঙ্গে লেপ্টে থাকি। কারণ, প্রশিক্ষণের সময় বলা হয়েছিল, মাটি থেকে অন্তঃত এক হাত ওপর দিয়ে গুলি যায়। প্রাণে বেঁচে যাই। তখন ভোরের আলো ফুটছিল। পাক সেনারা গুলি বন্ধ করে। আমরা তাদের ওপর চারটি গ্রেনেড ছুঁড়ে দ্রুত ফিশারিঘাট থেকে রিজার্ভ করা সাম্পানে চড়ে অভয়মিত্র ঘাটে চলে যাই।’

এরপর আসে ১৬ ডিসেম্বর। পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। চট্টগ্রাম শত্রুমুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর। সেদিন মিনু রাণীসহ একই কোম্পানির সব মুক্তিযোদ্ধা ট্রাকে করে লাল-সবুজের পতাকা নিয়ে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে সারা শহর প্রদক্ষিণ করেন। পরদিন তারা কোম্পানি কমান্ডারের কাছে অস্ত্র জমা দেন।

ফিশারিঘাটে গণকবরের মর্মন্তুদ স্মৃতিও তুলে ধরলেন তিনি, ‘সেখানে বোম্বাইঅলার লাল বিল্ডিংয়ের সামনে ছয়টি কূপ করেছিল পাকবাহিনী, সাথে ছিল রাজাকার- আলবদররা। সারাদিন শহর থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন, বিশেষ করে হিন্দু এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে ধরে রাতে সেখানে নিয়ে যেত। এরপর গুলি করে কূপে ফেলে দিয়ে চলে যেত। আমরা কয়েকবার সেখানে গিয়ে গুলিবিদ্ধ কয়েকজনকে কাতরাতে দেখি। জীবিত থাকা কয়েকজনকে নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিই।’

প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী হিসেবে মিনু রাণী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত টিমকে সেই গণকবরের সন্ধান দিয়েছিলেন বলে জানান।

জানতে চাইলে সেই কোম্পানি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আলম মন্টু সারাবাংলাকে বলেন, ‘মিনু আমাদের কোম্পানিতে ছিল। তাকে প্রথমে আমরা ইনফরমারের দায়িত্ব দিই। পরে প্রশিক্ষণ নিয়ে সে কয়েকটি অপারেশনেও অংশ নেয়। শহরে আমাদের অধীন এলাকাগুলোতে ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটানো একটা বড় দুঃসাহসিক অভিযান ছিল। সেই অভিযানে মিনুও ছিল।’

একজন তরুণী হয়েও কীভাবে যুদ্ধে যাবার সাহস পেলেন, জানতে চাইলে মিনু রাণী বলেন, ‘যেহেতু ছাত্রলীগ করতাম, নেতারা বিভিন্নভাবে আমাদের উজ্জীবিত করেছেন। বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, বঙ্গবন্ধু মাথায় হাত রাখার পর থেকে আমার মধ্যে অসীম সাহস তৈরি হয়। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাইনি। সেই সাহসেই ভর করে যুদ্ধে যোগ দিই। সাতই মার্চের ভাষণ আমাদের মতো তরুণ বয়সীদের রক্তে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।’

মুক্তিযুদ্ধের পর ইস্টার্ন ক্যাবলসের চাকরি ছেড়ে ১৯৭৮ সালে আনসার বাহিনীর অ্যাডজুটেন্ট পদে যোগ দেন তিনি। ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকে কয়েন-নোট পরিদর্শক পদে যোগ দেন। সহকারী ব্যবস্থাপক পদ থেকে ২০১০ সালে অবসরে যান। স্বামী, এক ছেলে ও দুই মেয়ে নিয়ে তার পরিবার।

মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি মিললেও রণাঙ্গনের সম্মুখ সারির এই নারী গেরিলা যোদ্ধা পাননি কোনো রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। অসুস্থ, শয্যাশায়ী হয়ে এখন মৃত্যুর প্রহর গুণছেন। কোনো পদ-পদবিতে নেই, তবুও যতদিন সক্ষম ছিলেন আওয়ামী লীগের মিছিল-মিটিংয়ের খবর পেলেই চলে যেতেন।

রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মান না পাওয়ার কথা বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি, ‘মনে হচ্ছে জন্মই আমার আজন্ম পাপ। কেউ কোনোদিন জানতেও চাইল না। ভাতা দিচ্ছে সরকার, ভাতার জন্য তো যুদ্ধে যাইনি।’

মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ নিয়ে অনেক আক্ষেপ মিনু রাণীর, ‘যে স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলাম, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সেই স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ আর উঠে দাঁড়াতে পারল না। আমাদের প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির মধ্যে বিস্তর ফারাক। বঙ্গবন্ধুর কন্যা চেষ্টা করছেন। কিন্তু যে অসাম্প্রদায়িক দেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ করেছিলাম, সেই দেশ এখনও পেলাম না। এই আক্ষেপ নিয়েই হয়তো চলে যাব।’

সারাবাংলা/আরডি/এএসজি

‘মাকে’ মুক্ত করতে গিয়েছিলেন মিনু রাণী চট্ট-মেট্রো ফিচার মুক্তিযুদ্ধ রমেন দাশগুপ্ত


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ
সম্পর্কিত খবর