Thursday 05 September 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মাতৃভাষার অতন্দ্র প্রহরী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

রহমান রা’আদ
৫ ডিসেম্বর ২০২৩ ১৭:৫৮

‘সমগ্র পাকিস্তানের ৬ কোটি ৯০ লক্ষ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোকেরই ভাষা বাংলা। সুতরাং পাকিস্তান গণপরিষদের আলোচনায় বাংলাকে স্থান তো করিতেই হইবে। বাংলাকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকার করিয়া লওয়া উচিত।’

ধর্মের ভিত্তিতে লাখ লাখ মানুষের জীবন এলোমেলো করে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম নেয়ার মাত্র ৫ মাসের মাথায় ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে মূল প্রস্তাবের সংশোধনীতে স্পষ্ট করে এই কথাগুলো বলেছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তার উত্থাপন করা এই এক সংশোধনী অগ্নি স্ফুলিঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দাবানলের মতন, শুরু হয়েছিল বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবীতে আন্দোলন, যা ক্রমে ক্রমে পরিণত হয়েছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতার এক দফা লড়াইয়ে! জন্মভূমিকে জীবনের শেষমুহুর্ত পর্যন্ত সবটুকু দিয়ে ভালোবাসা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নিজের জীবনটাও উৎসর্গ করেছিলেন আমাদের একটা স্বাধীন সার্বভৌম স্বদেশের পরিচয় উপহার দিতে!

১৮৮৬ সালের ২রা নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের উত্তরে রামরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন আইনজীবী, সমাজকর্মী ও রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ১৯০৪ সালে নবীনগর হাই স্কুল হতে প্রবেশিকা, ১৯০৮ সালে কলকাতা রিপন কলেজ হতে বি.এ এবং ১৯১০ সালে একই কলেজ হতে বি.এল পরীক্ষা পাস করেন কৃতিত্বের সাথে। ১৯১১ সালে কুমিল্লা জেলা বারে যোগ দেন ধীরেন দত্ত, তরুণ বয়স থেকেই মানবকল্যাণে সর্বতোশক্তিতে কাজ করে যাওয়া ধীরেন মহাত্মা গান্ধীর অনুসরণে ‘মুক্তি সংঘ’ নামে একটি সমাজকল্যাণমূলক সংগঠন খুলেছিলেন, যার মাধ্যমে ১৯১৫ সালে ভয়াবহ বন্যার সময় বন্যার্তদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করে প্রভূত সুনাম অর্জন করেন। রাজনীতি ও অধিকার সচেতন ধীরেন একে একে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন, অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে সকল স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনে অগ্রগণ্য ভূমিকায় ছিলেন।

১৯৪২ সালে ভারত ছাড় আন্দোলনে যোগ দিয়ে জেল খাটেন এই প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদ। বাংলার কৃষকদের ন্যায্য দাবী আদায়ে সোচ্চার ধীরেন বঙ্গীয় প্রজাস্বত্ব আইন সংশোধন এবং বঙ্গীয় কৃষিঋণ গ্রহীতা ও বঙ্গীয় মহাজনি আইন পাসের পেছনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় ছিলেন। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন প্রবল বিক্রমে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ ও মন্বন্তরে তিনি ছিলেন জনতার পাশে। সর্বোচ্চ চেষ্টায় সহায়তা করেছেন অনাহারে অর্ধাহারে থাকা মানুষগুলোকে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস দলের পক্ষে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন। পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ঐ বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ হতে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম বাঙ্গালীদের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি।

খুব দ্রুতই পুর্ব পাকিস্তানের জনগণের স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের ভুল ভাঙ্গে। এবং তাতে ধীরেন দত্ত পালন করেন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। পাকিস্তান রাষ্ট্রের গণপরিষদের প্রথম সভা বসে ২৩ ফেব্রুয়ারি। সেখানে ভাষা বিষয়ক মূল প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও পাকিস্তান গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে বিবেচিত হবে। আজীবন জন্মভূমিকে বুকে ধারণ করে চলা ধীরেন্দ্রনাথের চোখে পড়ল বৈষম্যটুকু। তিনি এই মূল প্রস্তাবে আনলেন ছোট্ট একটা সংশোধনী। বললনে, উর্দুর পাশাপাশি বাংলাও পরিষদের সরকারি ভাষারূপে গণ্য হবে।

খেয়াল করে দেখুন পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা হিসেবে বাংলাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার দাবী কিন্তু তোলেননি ধীরেন্দ্রনাথ, যদিও সেটা তিনি চাইলেই তুলতে পারতেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। ধীরেন শুধু চেয়েছিলেন উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকেও পাকিস্তানের সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা দেয়া হোক। তাতেই প্রবল ধাক্কা লাগে পাকিস্তানের শাসনক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু দখল করা উর্দুভাষী নিজেদের আশরাফ মুসলমান ভাবা গোষ্ঠীর,, যাদের চোখে বাঙ্গালী মুসলমানেরা ছিল অচ্ছ্যুত মছলিখোর, মুসলিম নামের কলংক। হিন্দুরা ছিল অভিশপ্ত কাফের মালাউন। এই ছোট্ট সংশোধনী রীতিমত মানসিকতা-ভাষা-শিক্ষা-সংস্কৃতিতে আকাশ-পাতাল তফাত থাকা দুই প্রান্তের দুই দেশকে মিথ্যে ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের মেকি বন্ধনের ক্যানভাসটা ছিঁড়ে দেখিয়ে দেয় আসল বাস্তবতা। সেটা হচ্ছে ব্রিটিশ শোষণের হাত থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীন হতে যে দুর্বার বিপ্লব গড়ে তুলেছিল বাঙ্গালীরা, সেই কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আসেনি, বাঙ্গালী স্বাধীন হয়নি। বরং স্রেফ শোষক পাল্টেছে মাত্র, স্রেফ ধর্মীয় পরিচয়ের খাতিরে সাদা চামড়ার ব্রিটিশ বেনিয়াদের জায়গায় বাঙ্গালীকে শাসন-শোষণের ব্যাটন সুকৌশলে তুলে দেয়া হয়েছে রুক্ষ মরুভূমির পাঞ্জাবীদের হাতে।

ধীরেন্দ্রনাথ সংশোধনীটি দাখিল করেন ২৩ ফেব্রুয়ারিতে আর তা গণপরিষদে আলোচিত হয় ২৫ ফেব্রুয়ারিতে। ‘আজাদ’ পত্রিকায় ৪ মার্চে প্রকাশিত হবীবুল্লাহ বাহারের বিবৃতি থেকে জানা যায় যে, গণপরিষদের আলোচনার আগে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের সভায় বিষয়টি আলোচিত হয়েছিল এবং তিনি ও মুসলিম লীগ দলীয় আরো কোনো কোনো সদস্য—তাঁদের মধ্যে উর্দুভাষী সদস্যও ছিলেন—তা সমর্থন করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত ভোটে তাঁরা হেরে যান এবং সদস্যদের নির্দেশ দেওয়া হয় ওই সংশোধনীর পক্ষে কিছু না বলার জন্যে। তারপরও তিনি এবং আরো দুজন সদস্য কিছু বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাদের কোনভাবেই কিছু বলতে দেয়া হয়নি।

পাকিস্তানের গণপরিষদের সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তিনি বলেন- “আমি প্রস্তাব করি রুল ২৯ এর সাব-রুল (১) এর দ্বিতীয় লাইনে ‘ইংরেজি’ শব্দটির পরে ‘অথবা বাংলা’ শব্দ দুটি বসানো হোক।” একই দিন প্রস্তাবের প্রথম অংশে তিনি বছরে গণপরিষদের অন্তত একটি অধিবেশন পূর্ব বাংলায় করার প্রস্তাব দেন। ২৪ ফেব্রুয়ারি এই প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়। প্রস্তাব উত্থাপন করতে গিয়ে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত আরো দুটো বিষয় তুলে এনেছিলেন, যা পরবর্তীতে শাসক ও শোষক পাকিস্তানী সরকারের মূল মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধীরেন বলেছিলেন, সরকারি কাগজপত্রে—মুদ্রায়, নোটে, মনিঅর্ডার ফরমে, ডাকটিকিটে—বাংলা ভাষা অবহেলিত, উর্দুতে লেখালেখি ও সকল কাজ করতে সাধারণ জনগণের দুর্ভোগ হচ্ছে; আর আরেকটা বিষয় হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের মাতৃভাষারূপে রাষ্ট্রভাষার সম্মান বাংলার প্রাপ্য।
ব্যস, এখানেই গণপরিষদের নেতা লিয়াকত আলি খানের ভুরু কুঁচকে ওঠে। তিনি এই বক্তব্যের মধ্যে পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি এবং ভাষাগত ঐক্যস্থাপনে বাধাদানের উদ্দেশ্য খুঁজে পান। কেন তিনি ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব গ্রহণ করলেন না, সে ব্যাপারে বলতে গিয়ে লিয়াকত সোজাসাপ্টাই জানিয়ে দেন, ‘পাকিস্তান একটি মুসলিম রাষ্ট্র, এর রাষ্ট্রভাষা হবে এদেশের মুসলমানদের ভাষা-উর্দু।’

এভাবেই ধীরেনের এক সংশোধনীতে বেরিয়ে আসে বাঙ্গালীর শাসক হয়ে ওঠা পাকিস্তানীদের শোষণের ধারালো নখর। পরদিন ২৫ ফেব্রুয়ারি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পরিষদের সভায় তার প্রস্তাবের পক্ষে সেই ঐতিহাসিক ভাষণটি দেন।

‘বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মর্যাদা প্রদান করিতে হইবে’ শীর্ষক ওই বক্তব্যে তিনি বলেন, “…আমার মনোভাব এই রূপ যে, যেন সদস্যবর্গ গভীরভাবে বিষয়টি বিবেচনা করেন। এ কথা আমি জানি বাংলা একটি প্রাদেশিক ভাষা। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রের কথা যদি আমরা চিন্তা করি তাহলে দেখিব যে রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা হইতেছে বাংলা। কাজেই প্রাদেশিক হইলেও যেহেতু রাষ্ট্রের অধিকাংশ অধিবাসীর ভাষা বাংলা, সেকারণে বাংলা ভাষা ভিন্ন মর্যাদার দাবিদার। রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা ৬ কোটি ৯০ লক্ষ এর মধ্যে চার কোটি ৪০ লক্ষ বাংলা বলে। এই যদি অবস্থা হয় তা হইলে রাষ্ট্রভাষা কোনটি হওয়া উচিত? সেই ভাষারই দেশের রাষ্ট্রভাষা হওয়া উচিত দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক যে ভাষায় কথা বলে, আর সেজন্যই আমার বিবেচনায় বাংলা ভাষাই হচ্ছে আমাদের দেশের ‘লিংগুয়া ফ্রাঙ্কা’। আমি জানি আমার এ মনোভাব দ্বারা আমাদের রাষ্ট্রের বিপুল সংখ্যক মানুষের অনুভূতিকে প্রকাশ করিতেছি।…”

এতো স্পষ্টভাবে ধীরেন্দ্রনাথ তার বক্তব্য ব্যাখা করেছিলেন যে বুঝতে আর কোন সংশয় ছিল না। কোনো ধরণের প্রাদেশিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বাংলাকে পাকিস্তানের বাকি ভাষাভাষী গোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দিতে নয়, বরং বাস্তব কারণে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকার আদায়েই ধীরেন বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করছেন। কিন্তু তার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে গণপরিষদের সদস্যদের অপ্রত্যাশিত ভূমিকায় স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে বাংলা কোনভাবেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা পাবে না। এ বিষয়টাই আরো গুছিয়ে বিস্তারিত লেখেন বাঙ্গালী জাতির জনক তৎকালীন ছাত্রনেতা শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীর ৯১ নম্বর পৃষ্ঠায় লেখেন,

“করাচিতে পাকিস্তান সংবিধান সভার (কন্সটিটিউয়েন্ট এ্যাসেম্বলি) বৈঠক হচ্ছিল। সেখানে রাষ্ট্রভাষা কি হবে সেই বিষয়ও আলোচনা হচ্ছিল। মুসলিম লীগ নেতারা উর্দুকেই রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষপাতী। পূর্ব পাকিস্তানের অধিকাংশ লীগ সদস্যেরও সেই মত। কুমিল্লার কংগ্রেস সদস্য বাবু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত দাবি করলেন বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা করা হোক। কারণ, পাকিস্তানের সংখ্যাগুরুর ভাষা হল বাংলা। মুসলিম লীগ সদস্যরা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। আমরা দেখলাম, বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে বাংলাকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্রভাষা উর্দু করার।”

অবিশ্বাস্য হলেও সত্য গণপরিষদের ৭৯ জন সদস্যের মধ্যে সেদিন ৩৮ জন ছিলেন পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত এবং ভাষাগত পরিচয়ে বাঙালি সদস্য। গণপরিষদে পাকিস্তান জাতীয় কংগ্রেসের কয়েকজন সদস্য শুধু ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব সমর্থন করেছিলেন। মুসলিম লীগ করা বাঙালি সদস্যরা সেদিন নিশ্চুপ ছিলেন। বাঙ্গালী নেতারা যেখানে গণপরিষদের পদের লোভে হোক আর ক্ষমতার কাছাকাছি থাকার লোভ থেকে হোক, নিশ্চুপ থেকে মৌন সম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন, সেখানে পাকিস্তানের পাঞ্জাবী শাসকগোষ্ঠী ঠিকই টের পেয়েছিলেন ধর্মের নামে পোকায় কাটা পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকিয়ে রাখার ও বাঙ্গালীদের শোষণ করবার যে নীলনকশা প্রণয়ন করেছিলেন তারা, সেই জারিজুরি ফাঁস হয়ে গেছে। পাকিস্তানের উর্দুভাষী আরোপিত ঐক্য নির্ভর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নের মূলে কুঠারাঘাত ছিল ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ওই প্রস্তাব।

গণপরিষদে সেই প্রস্তাব নাকচ হওয়ার পর উর্দুভাষী পাকিস্তানী সরকারের ষড়যন্ত্র প্রকাশ্য হবার সাথে সাথেই বাংলার ছাত্ররা গর্জে ওঠেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্ররা ধর্মঘট করে। বিশ্বিবদ্যালয়-প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত সভায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে অভিনন্দন জানানো হয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি সারা প্রদেশে ছাত্র ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই দিনই ‘আজাদ’ পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে বলা হয় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কথাঃ

(ক) পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই তার রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বাদানুবাদ হয়েছিল;
(খ) দেশের ৬১ শতাংশ মানুষের ভাষা বাংলা পাকিস্তানে উপেক্ষিত হতে পারে না, বরঞ্চ তা রাষ্ট্রভাষা হবার যোগ্যতা রাখে;
(গ) ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব সম্পূর্ণ যৌক্তিক;
(ঘ) প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পাকিস্তানকে মুসলিম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করলেও কায়েদে আজম বহুবার দেশকে ‘secular state’ বলে ঘোষণা করেছেন,
(ঙ) তবে তিনি যে উর্দুকে মুসলমানের জাতীয় ভাষা বলে অভিহিত করেছেন, এর কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই;
(চ) গণপরিষদের সিদ্ধান্তে পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে নিষ্ঠুর আঘাত দেওয়া হয়েছে, ন্যায্য দাবির প্রতি উপেক্ষায় পূর্ব বাংলা আজ বিক্ষুব্ধ।

এভাবেই আগুন ছড়িয়ে পড়ে সবখানে। তমদ্দুন মজলিস ও পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথ সভায় ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অত্যন্ত সফল এই ধর্মঘট ও হরতাল কর্মসূচী থেকে গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, শওকত আলী, অলি আহাদসহ বেশ কজন ছাত্রনেতাকে। পরবর্তী তিন বছর অর্থাৎ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত ১১ মার্চ দিনটি পালিত হয়েছিল ভাষা দিবস হিসেবে, আমাদের প্রথম মাতৃভাষা দিবস ছিল ১১ মার্চ।

পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল খাজা নাজিমুদ্দীন দেখলেন অবস্থা বেগতিক। তিনি সাথে সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর এক চুক্তি স্বাক্ষরিত করলেন। ৮ এপ্রিল পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে পূর্ব বাংলায় সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাকে গ্রহণ এবং যথাসম্ভব শীঘ্রই বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার প্রস্তাব উত্থাপন করেন খাজা নাজিমুদ্দীন। কিন্তু আবারো সেখানে বাধ সাধলেন পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর তৎকালীন এক নম্বর মাথাব্যাথা ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত।

তিনি তার পুরোনো দাবী থেকে এক বিন্দু পিছু হটলেন না। নাজিমুদ্দিনের প্রস্তাবে সংশোধনী দিয়ে বললেন, বাংলাকে স্রেফ পূর্ব বাগ্লার সরকারী ভাষা বা শিক্ষার মাধ্যমই নয়, করতে হবে পুরো পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। তিনি গণপরিষদের সদস্যদের, বিশেষ করে, পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের, যারা আগেরবার মুখে ক্ষমতার দন্ড পুরে নিশ্চুপ ছিলেন, তাদের অনুরোধ করেন বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবীতে সোচ্চার হতে।

দুঃখজনক হলেও সত্য, এবারো তার অনুরোধে গণপরিষদের বাঙলাভাষী প্রতিনিধিরা কেউ সাড়া দেয়নি, তার সংশোধনী প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয় নিদারুণ অবহেলায়। ফলে আমরা ক্রমেই এগিয়ে যাই ভাষা আন্দোলনের দুর্বার গতিস্রোতে, যেখানে বাঙ্গালী বুকের তাজা রক্ত ঢেলে আদায় করে মাতৃভাষায় কথা বলার, রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবী। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে পূর্ব বাংলার প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিন প্রস্তাব উত্থাপন করেন, পাকিস্তান গণপরিষদের কাছে পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদ সুপারিশ করছে যে, বাংলাকে পাকিস্তানের একটি রাষ্ট্রভাষা করা হোক। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলি চালানোর পর ব্যবস্থাপক পরিষদে প্রথম ওয়াকআউট করেছিলেন প্রথমে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ ও তারপরেই ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ধীরেন বলেন, গুলিতে ছাত্রহত্যার পরিপ্রেক্ষিতে পরিষদের কাজে অংশগ্রহণ করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়েছে। বিরোধী দলের মুলতবী প্রস্তাব অগ্রাহ্য হলে তাঁরা পরিষদ ছেড়ে চলে যান।

কিন্তু ধীরেন থামেননি। বায়ান্ন সালের এপ্রিলে গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নটি উত্থাপন করেন মুসলিম লীগ দলীয় সদস্য নূর আহমদ। কিন্তু মুসলিম লীগেরই এক পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য তাৎক্ষণিক প্রস্তাবটি মুলতবী রাখার উদ্দেশ্যে সংশোধনী আনেন। সেটিই গৃহীত হয়। সেদিনও ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছিল বাংলা ভাষার দাবির সমর্থনে এবং মুসলিম লীগ-দলীয় সদস্যদের নিন্দায়। এরপরে অবশেষে দীর্ঘ ৬ বছর পর ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদ বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণীত হলে ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি পায়।

এভাবে ধর্মরাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানকে গড়ে তোলার ভিত্তিমূলে সর্বপ্রথম সবচেয়ে শক্তিশালী আঘাতগুলোর একটা হানবার প্রধান কারিগর ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে পাকিস্তান কখনই ভোলেনি। তাই দফায় দফায় তারুপর নির্যাতন নিপীড়ন চলেছে একাত্তর পর্যন্ত। পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর ১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর ‘এবডো’ (Elective Bodies Disqualification Order) প্রয়োগ করা হয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তাঁকে গৃহবন্দি করা হয় এবং সকল প্রকার সক্রিয় রাজনীতি থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা হয়। ধীরেন্দ্রনাথ তার পরিণতি জানতেন। কিন্তু পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান শত্রু হয়েও একবিন্দু ভয় না পেয়ে তিনি সেই পরিণতির মুখোমুখি হয়েছিলেন অসম সাহসিকতায়!

একাত্তরের ২৯ মার্চ ছেলে দিলীপকুমার দত্ত সহ তাঁকে চোখ বেঁধে পাকিস্তানী সেনাদের হাতে তুলে দেয় পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সেবক কুমিল্লা শহরের কুখ্যাত রাজাকার অ্যাডভোকেট এম এ করিম। তার বাবা ছিল মুসলিম লীগ নেতা ও রাজাকার জহিরুল হক লিল মিয়া। কুমিল্লার ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। মার্চের শুরু থেকেই এমনকি ২৫ মার্চের পরেও তাঁকে আত্মীয়স্বজন থেকে শুরু করে পরিচিত সবাই বারবার ভারতে চলে যেতে বলেছিলেন। কিন্তু সারাজীবন পাকিস্তানী ধর্মান্ধ পিশাচগোষ্ঠীর সাথে তিনি চোখে চোখ রেখে সম্মুখসমরে লড়ে গেলেন, তিনি তো এতো সহজে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করবেন না, তাই না? তাই তিনি রয়ে গিয়েছিলেন তার নিজের বাড়িতেই। পরিচিতদের বলতেন, এটা আমার মাতৃভূমি, এইখানে আমার জন্ম, এই আলো-হাওয়ায় পার করে দিলাম পুরা জীবন। এই মাটি ছেড়ে কোথায় যাবো?

অবর্ণনীয় বর্বরোচিত নির্যাতন চালিয়েছিল পাকিস্তান সেনারা ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর। তার হাঁটু দুটো ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছিল, তার হাত দুটো টুকরো করে ফেলা হয়েছিল, ফাউন্টেন পেন দিয়ে গেলে দিয়ে উৎপাটন করা হয়েছিল তার দুই চোখ। চোখ-হাত-পা বেঁধে উনাকে ব্রিগেড অফিসে আনা হত। মাথায় ছিল ব্যান্ডেজ। শরীরের ক্ষতে লাগানো থাকতো তুলা। নির্যাতনের কারণে শেষ কয়েকটি দিন হামাগুড়ি দিয়ে চলাফেরা করতে হয়েছিল তাঁকে। ৮৫ বছর বয়সের বৃদ্ধ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত চাইলেই দেশভাগের সময় চলে যেতে পারতেন ভারতে, হতে পারতেন বড় নেতা, জীবনের শুরু থেকেই যে মানবকল্যাণে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তিনি, জীবনের বাকিটা সময় কল্যাণমুখী নানা কর্মকান্ডে নিজেকে জড়িয়ে রেখে নিরাপদে নিশ্চিন্তে তার হতে পারত নিজের বাড়িতে নিজের বিছানায় পরম শান্তিময় এক মৃত্যু। তার বদলে ধীরেন্দ্রনাথ যে জীবন বেছে নিয়েছিলেন, তার পরিণতি ছিল অকল্পনীয় অত্যাচারে তিলে তিলে কষ্ট পেয়ে মৃত্যু। কি আশ্চর্য, আমাদের একটা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, একটা সত্যিকারের স্বাধীন নাগরিকের পরিচয় এনে দিতে পাকিস্তানীদের হাতে নিজের যন্ত্রণাদায়ক বীভৎস মৃত্যুর কথা নিশ্চিতভাবে জেনেও অসম সাহসিকতায় এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি, উৎসর্গ করেছিলেন তার জীবন আমাদের জন্য, বাংলা ভাষার জন্য, বাঙ্গালী জাতির জন্য, বাংলাদেশের জন্য।

এই অকুতোভয় বীর দুঃসাহসী দেশপ্রেমিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তার উত্তরসূরী হিসেবে কতটুকু স্মরণে রেখেছি আমরা? তার জীবন আর কর্মের অভাবিত কীর্তি আজ পঞ্চাশ বছর পর কতটুকু আন্দোলিত করে আমাদের? দেশটাকে কি আমরা আজ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের মত করে ভালোবাসতে চাই?

তথ্যসূত্রঃ
১। অসমাপ্ত আত্মজীবনী/ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
২। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: আমাদের কালের চোখে/ আনিসুজ্জামান
৩। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ/ ক্ষৌরকার রমণী শীল
৪। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: এক বিস্মৃত মহানায়ক/ মিঠুন চৌধুরী

লেখক: একটিভিস্ট

সারাবাংলা/এসবিডিই

ফিচার মাতৃভাষার অতন্দ্র প্রহরী ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত মুক্তিযুদ্ধ রহমান রা'আদ


বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ

ধানমন্ডি থেকে গ্রেফতার শাজাহান খান
৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪ ০২:৪৫

সম্পর্কিত খবর